পরিবারের তথাকথিত সম্মান রক্ষার নামে পাকিস্তানের সোশাল মিডিয়া তারকা কান্দিল বালুচকে হত্যার দায়ে তাঁর ভাই মুহাম্মদ ওয়াসিমের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
ওয়াসিমের আইনজীবী সরদার মাহমুদ এএফপিকে বলেছেন, আদালত শুক্রবার তার মক্কেলকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে৷ তবে তাঁর আশা, ওয়াসিম উচ্চ আদালতে খালাস পাবেন৷
কান্দিলের মা আনোয়ার মাই আশা করেছিলেন তাঁর ছেলে খালাস পাবেন৷ তিনি বলেন, ‘‘সে নির্দোষ, সে আমার মেয়ে ছিল আর সে আমার ছেলে৷’’
২০১৬ সালের জুলাইয়ে কান্দিল বালুচকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর ওয়াসিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ তখন ওয়াসিম বলেছিলেন, বোনের আচরণ অসহনীয় হয়ে ওঠায় তাকে তিনি খুন করেছেন এবং এজন্য তার কোনো অনুশোচনা নেই৷
অনার কিলিং: পরিবারের সম্মানের নামে হত্যা
পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে প্রতি বছর সারা বিশ্বে কত কিশোরী, তরুণী ও মহিলাকে অংশত শারীরিক নির্যাতনের পর নির্মম নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ সংখ্যাটা ৫,০০০ থেকে ২০,০০০ পর্যন্ত হতে পারে৷
ছবি: DW
প্রতিবছর কতজন অনার কিলিংয়ের শিকার?
২০০০ সাল থেকে বিক্ষিপ্তভাবে সংগৃহীত ও প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ৫,০০০ অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে থাকে৷ এই সংখ্যা জাতিসংঘের বিবৃতির সঙ্গেও মেলে৷ যেহেতু বহু অনার কিলিংয়ের ঘটনাকে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, সেহেতু বাস্তব পরিসংখ্যান এর চারগুণ হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যাদের হত্যা করা হয়
পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে যাদের হত্যা করা হয়, তাদের গড় বয়স ২৩ ও তাদের ৯৩ শতাংশই মেয়ে৷ দুই-তৃতীয়াংশ প্রাণ হারায় পরিবারের সদস্যদের হাতে৷ নিহতদের অর্ধেক হত্যাকারীর মেয়ে, নয়তো বোন; নিহতদের এক চতুর্থাংশ হত্যাকারীর স্ত্রী কিংবা বান্ধবী৷ হত্যার কারণ ষাট ভাগ ক্ষেত্রে ‘বড় বেশি পশ্চিমি’ হয়ে পড়া; বাকিদের ক্ষেত্রে পুরুষ বা পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Sarbakhshian
পাকিস্তান: ইজ্জতের নামে হত্যা
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫ সালে পাকিস্তানে প্রায় ১,১০০ অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে৷ পাকিস্তানের গ্রামীণ সমাজে অনার কিলিংয়ের প্রতি জনসাধারণেরও সমর্থন থাকার ফলে, এই কুপ্রথা দূর করার যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যহত হয়েছে ও হচ্ছে৷ ইতিপূর্বে নিহতের পরিবার হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিলে সে ছাড় পেতো; এ’বছর আইনের সে ফাঁকটি বন্ধ করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সোশ্যাল মিডিয়া স্টার কান্দিল বেলুচের হত্যা
২০১৩ সালে পাকিস্তানি আইডলের জন্য অডিশন করার পর থেকেই এই পাকিস্তানি তরুণী একজন ইন্টারনেট সেলিব্রিটি হয়ে পড়েছিলেন৷ ২০১৬ সালের ১৫ই জুলাই কান্দিলকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তাঁর নিজের ভাই ওয়াসিম আজিম৷ আজিম বোনকে খুন করার কথা স্বীকার করে বলেছে, পরিবারের ‘ইজ্জতের’ উপর ‘দুর্নাম’ আনছিলেন কান্দিল, তাই...৷
ছবি: Facebook/Qandeel Baloch via Reuters
পাথর ছুঁড়ে হত্যা
২০১৪ সালের ২৭শে মে৷ পাকিস্তানের লাহোর শহরে পুলিশ মর্গের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে শোয়ানো ফারজানা ইকবালের মৃতদেহকে ঘিরে কাঁদছেন প্রবীণারা৷ প্রেমিককে বিয়ে করার দোষে লাহোর হাইকোর্টের সামনে পাথর ছুঁড়ে ফারজানাকে হত্যা করে তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷
ছবি: Reuters
ভারতে অনার কিলিং
গোটা দেশে বছরে হাজার খানেক অনার কিলিং হয় বলে অনুমান করা হয়ে থাকে, যদিও বাস্তবিক সংখ্যা জানা সম্ভব নয়৷ উত্তর ভারতে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানাতেই অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে বেশি, দক্ষিণ ভারত বা মহারাষ্ট্র কিংবা গুজরাটে সে তুলনায় কম৷ অনার কিলিংয়ের খবর পাওয়া গেছে পাঞ্জাব ও বিহার থেকেও৷ পশ্চিমবঙ্গে অনার কিলিং গত একশ’ বছর ধরেই প্রায় নেই বললেই চলে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Saurabh Das
‘বাংলাদেশে অনার কিলিং মানসিকতায়’
বাংলাদেশে অনার কিলিংয়ের খবর এখনো পাওয়া যায়নি৷ তবে পরিবারের পছন্দে বিয়ে না করার কারণে হত্যার ঘটনা বেশ কিছু ঘটেছে৷ তাই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেছেনন, ‘‘অনার কিলিংয়ের মানসিক অবস্থা এখানে (বাংলাদেশে) বিদ্যমান৷ পাকিস্তানের মতো এখানে এটা প্রকট নয়৷ তবে যা হচ্ছে তা ব্যক্তি ও পরিবারের অহংবোধ থেকে৷ এখানে সমস্যাটি হলো ধনী-গরীবের ব্যবধান নিয়ে৷''
ছবি: Meya online netwark
অন্য দেশে...
ব্রিটেনে অভিবাসীদের মধ্যে অনার কিলিং বিরল নয়৷ কুর্দি, পাকিস্তানি ও সিরীয় বাবারা নিজেদের মেয়েদের স্বহস্তে হত্যা করছেন, এমন ঘটনা বারংবার ঘটেছে৷ ২০১০ সালে এক শিখ পিতা তাঁর কন্যাকে হত্যা করেন৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষিপ্ত হলেও, অভিবাসী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একাধিক অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে৷ জার্মানি ও ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশেও অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. R. Caivano
ক্যানাডায় আফগান বাবার হাতে তিন মেয়ে খুন
ঘটনাটা আলোড়ন তুলেছিল ২০০৯ সালে৷ সে বছর ক্যানাডার অন্টারিও প্রদেশের কিংস্টন শহরের খালে একটি গাড়ি ডুবন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়৷ গাড়িতে ছিল ১৯, ১৭ ও ১৩ বছর বয়সের তিনটি মেয়ে ও তাদের মায়ের লাশ৷ ২০১২ সালের ছবিতে (ওপরে) মেয়ে তিনটির বাবা মোহম্মদ শাফিয়া, তাঁর স্ত্রী তুবা মোহম্মদ ইয়াহিয়া ও পুত্র হামেদকে কিংস্টন আদালতে পৌঁছতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters
বার্লিনে হাতুন সুরুচু হত্যাকাণ্ড
হাতুন সুরুচু ছিলেন তুরস্কের আনাতোলিয়া থেকে জার্মানিতে আসা এক কুর্দ দম্পতির সন্তান৷ বার্লিনের তুর্কি-অধ্যুষিত ক্রয়েৎসব্যার্গ অঞ্চলে মানুষ হয়েছেন৷ ১৬ বছর বয়সে তাঁকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় তুরস্কে৷ জার্মানিতে ফিরে হাতুন পুত্রসন্তানের জন্ম দেন ও স্বাধীন জীবন যাপন শুরু করেন৷ একটি কলহের পর হাতুনকে বার্লিনের এক বাস স্টপে মাথায় তিনবার গুলি করে মারেন তাঁর ভাই আইহান সুরুচু৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে সেই বাস স্টপ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেকে খোলামেলাভাবে প্রদর্শন করে পরিবারের সম্মানহানী ঘটনোয় কান্দিলকে মেরে ফেলাটা আবশ্যক হয়ে পড়েছিল বলে পুলিশকে জানিয়েছিলন ওয়াসিম৷
পরিবারের অমতে বিয়ে, প্রেম এমনকি ধর্মীয় অনুশাসনের বরখেলাপ করা- এমনসব ‘অপরাধে’ আপনজনদের হাতে পাকিস্তানে প্রতিবছর প্রাণ হারান অনকে নারী৷ কান্দিল বালুচও সেই ‘অনার কিলিং’-এরই শিকার হন৷
কান্দিল বালুচকে হত্যার ঘটনা নিয়ে বড় বড় শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়৷ হত্যাকাণ্ডের তিন মাস পর অনারার কিলিংয়ের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে পাকিস্তানের সংসদে নতুন আইন পাস করা হয়৷
কান্দিল বালুচ ২০১৪ সালে নিজের একটি ‘পাউটিং’ ভিডিও আপলোড করে রাতারাতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় বিখ্যাত হয়ে ওঠেন৷ এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে নিজেকে আবেদনময় রূপে উপস্থাপন করেন এবং সাহসি বক্তব্য দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন৷
টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলার সময় পাকিস্তান ভারতকে হারাতে পারলে নগ্ন হয়ে নাচার ঘোষণা দেন তিনি৷ ওই বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে যায় পাকিস্তান৷ তখন ইউটিউবে আরেকটি ভিডিও আপলোড করেন কান্দিল, নগ্ন হয়ে নাচতে না পারার জন্য ওই ভিডিওতে তাঁকে কাঁদতে দেখা যায়৷
এসআই/এসিবি (এএফপি)
২০১৬ সালের জুলাই মাসের ছবিঘরটি দেখুন...
ভাইয়ের হাতে খুন হওয়া পাকিস্তানের সেই বিতর্কিত মডেল
পাকিস্তানে নিজের ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছেন বিতর্কিত মডেল কন্যা কান্দিল বেলুচ৷ ‘অনার কিলিং’ এর শিকার এই নারী সেদেশের ইন্টারনেট জগতে আলোড়ন তুলেছিলেন খোলামেলা ছবি প্রকাশ করে৷
ছবি: Instagram/quandeel_baloch
ফেসবুকে ‘লজ্জাজনক’ ছবি দেয়ায় খুন!
পাকিস্তানের মুলতানে নিজ বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় মডেল কান্দিল বেলুচকে৷ তাঁর ভাই ওয়াসিম আজিম দাবি করেছে, ফেসবুকে ‘লজ্জাজনক’ ছবি প্রকাশ করায় পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য বোনকে খুন করেছেন তিনি৷
ছবি: Facebook/Qandeel Baloch via Reuters
ইন্টারনেটে আলোচিত কান্দিল বেলুচ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত ছিলেন কান্দিল বেলুচ৷ রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা এই মডেলের টুইটার অনুসারীর সংখ্যা পয়তাল্লিশ হাজারের বেশি এবং ফেসবুকে তা প্রায় আট লাখ৷
ছবি: Instagram/quandeel_baloch
পাকিস্তানের ‘কিম কার্দাশিয়ান’
বেলুচকে অনেকে তুলনা করতেন মার্কিন টিভি অভিনেত্রী কিম কার্দাশিয়ানের সঙ্গে৷ ছবি শেয়ার করার ওয়েবসাইট ইন্সটাগ্রামে কার্দাশিয়ানের মতো করে তোলা বেশ কিছু ছবি, ভিডিও শেয়ার করেছিলেন তিনি৷ ছবিগুলো বেশ খোলামেলা৷ এর আগে পাকিস্তানের কোনো মডেলকে এভাবে ছবি পোস্ট করতে দেখা যায়নি৷
ছবি: Instagram/quandeel_baloch
‘নগ্ন’ হওয়ার ঘোষণা
চলতি বছর টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলাকালে পাকিস্তান ভারতকে হারালে নগ্ন হয়ে নাচবেন বলে ঘোষণা দিয়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন বেলুচ৷ পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে হেরে যাওয়ায় নগ্ন না হতে পারার দুঃখে কাঁদার একটি ভিডিও প্রকাশ করেন ইউটিউবে৷ পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা এই মডেল৷
ছবি: Instagram/quandeel_baloch
ইসলামের ‘কলঙ্ক’
তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সকল পদ হারান পাকিস্তানের মুফতি আবদুল কাভি৷ পাকিস্তানের তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতা এবং ধর্মগুরু হিসেবে পরিচিত কাভি-কে ইসলামের ‘কলঙ্ক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন বেলুচ, কেননা, তাঁর দাবি ছিল, টিভিতে ধর্মের কথা বললেও আড়ালে তাঁর সঙ্গে অনৈতিক কিছু করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন কাভি৷
ইন্টারনেটে সাহসিকতার নানা নমুনা রাখলেও ক্রমাগত বিতর্কের মাঝেই এক পর্যায়ে নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যান কান্দিল বেলুচ৷ খুন হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে তাই পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কয়েকজনের কাছেই নিজের নিরাপত্তা দাবি করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/R.S. Hussain
শাস্তি হবে কি?
উল্লেখ্য, পাকিস্তানে প্রতিবছর গড়ে এক হাজারের মতো ‘অনার কিলিং’ এর ঘটনা ঘটে৷ এগুলোকে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই বিবেচনা করে বিচারের ব্যবস্থা থাকলেও পাকিস্তানের আইনে পরিবার চাইলে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয়ার সুযোগ রয়েছে৷ আর এই সুযোগ নিয়ে অনেক সময় হত্যাকারী পার পেয়ে যায়৷