বোরকা বা হিজাব না পরলে সৌদি আরবে মেয়েদের জেল পর্যন্ত হয়৷ এতই কড়া আইন৷ তবে সম্প্রতি সে দেশের যুবরাজ সালমান বলেছেন, মেয়েরা নিজের সম্মানজনক পোশাক নিজেরাই বেছে নিতে পারবেন৷
বিজ্ঞাপন
কেউ বলছেন, যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত৷ কেউ বলছেন, ব্যাখ্যা স্পষ্ট নয়৷ কেউ বলছেন, সংস্কারের আরো এক পদক্ষেপ৷ কেউ বলছেন, এখনো অনেক পথ চলার বাকি৷ তবে সকলেই আশাবাদী৷ সৌদি আরবে মেয়েদের ওপর যে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, ক্রমশ তা শিথিল হচ্ছে৷ এবং তার জন্য একমাত্র ধন্যবাদ প্রাপ্য সে দেশের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের৷
সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমকে ১ ঘণ্টার এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন যুবরাজ সালমান৷ সেখানে তিনি বলেছেন, সৌদি আরবের মেয়েরাই ঠিক করবেন, তাঁরা কী পরবেন৷ তিনি বলেছেন, আবায়া বা বোরকা পরা মোটেই বাধ্যতামূলক নয়, কারণ, শরিয়তে তার কোনো উল্লেখ নেই৷ শরিয়া থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, সেখানে বলা আছে, মেয়েরা পুরুষের মতো সম্মানজনক পোশাক পরবেন, যাতে তাঁদের শরীর ঢাকা থাকে৷ কিন্তু কোনো বিশেষ পোশাকের কথা সেখানে বলা নেই৷
বস্তুত, বিভিন্ন দিক থেকেই নারীদের ওপর নানারকম অসম্মানজনক বিধিনিষেধ চালু আছে আরবে৷ জনসমক্ষে আসতে হলে মেয়েদের সেখানে কালো বোরকা পরতে হয়৷ মাথা এবং মুখও ঢেকে রাখতে হয়৷ অন্যরকম পোশাক পরার জন্য সেখানে মেয়েদের জেলও হয়েছে৷ পুলিশ এবং প্রশাসন এ বিষয়ে খুবই কড়া৷
হিজাববিরোধী প্রচারণা #মেনইনহিজাব
১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরানে জনসমক্ষে নারীদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক হয়েছে৷ সম্প্রতি ইরানের পুরুষরা নারীদের হিজাববিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে অভিনব প্রচারণা শুরু করেছেন৷ সেই প্রচারণার কিছু অংশ থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Twitter/Lola Oltra
নিঃশব্দ প্রতিবাদ
ইরানের বেশিরভাগ পুরুষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেদের হিজাব পরা ছবি শেয়ার করেছেন, যা এই মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়া জগতের সর্বত্র৷ ‘মাই স্টিলথি ফ্রিডম’ নামে এই প্রচারণার অংশ হিসেবে তারা এটা করছেন৷
ছবি: facebook/my stealthy freedom
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল
নারী অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে নিজেরা মাথা ঢেকে নারীদের সঙ্গে ছবি তুলে তা পোস্ট করছেন ফেসবুক-টুইটারে৷ এভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন পুরো দেশে৷ তাঁরা বলছেন, হিজাব নারী স্বাধীনতার লঙ্ঘনের প্রতীক৷
ছবি: facebook/my stealthy freedom
হিজাববিরোধী আন্দোলনের উদ্যোক্তা
এই প্রচারণা শুরু হয় সাংবাদিক ও নারী আন্দোলন কর্মী মসিহ আলিনেজাদের উদ্যোগে৷ তিনি ইরানের পুরুষদের হিজাব পরার এই বাধ্যতামূলক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেন৷
ছবি: facebook/my stealthy freedom
নিউ ইয়র্ক থেকে আন্দোলন
পুরুষদের আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে বসবাসরত আলিনেজাদ বলেছেন, পুরুষদের নিজেদের হিজাব পরে দেখা উচিত তাদের কেমন লাগে৷
ছবি: facebook/my stealthy freedom
মাথা না ঢাকলে শাস্তি
ইরানে নারীদের মাথা ঢাকার বিষয়টি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়৷ বিশেষ করে সেখানকার নৈতিক পুলিশ বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখে৷ হিজাব না পরলে বা মাথায় কাপড় না দিলে জেল-জরিমানা হতে পারে৷
ছবি: facebook/my stealthy freedom
নারী স্বাধীনতার লঙ্ঘন
সম্প্রতি ইরানের নারীরা এই কঠোর নিয়মের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক লেখালেখি করছেন৷ তাদের দাবি, এটা নারী স্বাধীনতার লঙ্ঘন৷ তাদের স্বাধীনতা যেন ফিরিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: facebook/my stealthy freedom
‘মেন ইন হিজাব’
২০১৪ সালে আলিনেজাদ ফেসবুকে একটি পাতা বানিয়েছিলেন যার নাম ‘মেন ইন হিজাব’৷ সেই থেকে ফেসবুক ও টুইটারে ইরানি পুরুষেরা মাথায় হিজাব পরে ছবি তুলে পোস্ট করতে থাকেন৷
ছবি: facebook/my stealthy freedom
সমালোচনা
পুরুষের হিজাব পরা বা না পরাটা কোনো বিষয় নয়, যদিও এটাকে সমাজ ভালো চোখে দেখে না৷ ইরানেও পুরুষের এ ধরনের কাজের সমালোচনা করেছেন আইন প্রণেতারা৷
ছবি: facebook/my stealthy freedom
মডেলদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
সম্প্রতি ইরানের সরকার ইন্টারনেটে ইসলামবিরোধী পোস্টের জন্য দেশের কয়েকজন নামি-দামি মডেলের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিয়েছে৷ এই মডেলরা ইন্টারনেটে এমন কিছু ছবি পোস্ট করেছেন, যেগুলোতে তাদের মাথায় কাপড় ছিল না৷
ছবি: FARS
9 ছবি1 | 9
কিন্তু যুবরাজের ঘোষণার পর অনেকেই মনে করছেন, সেই ব্যবস্থা এবার শিথিল হবে৷ মেয়েরা পোশাকের স্বাধীনতা পাবে৷ তবে সে দেশে নারী স্বাধীনতা নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেন, তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, যুবরাজ বিষয়টি ভাসিয়ে দিয়েছেন৷ বলেছেন, মেয়েদের সম্মানজনক পোশাক পরতে হবে৷ আইনে এর ব্যাখ্যা কী হবে সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন৷ বস্তুত তাঁদের মতে, কিছুদিনের মধ্যেই যুবরাজ যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন৷ সেখানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও তাঁর দেখা হওয়ার কথা৷ সেখানে গিয়ে যাতে কোনো অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে না হয়, তার জন্যই সালমান এমন সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বলে অনেকের ধারণা৷
তবে অনেকেই বিষয়টিকে সদর্থক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন৷ তাঁদের বক্তব্য, এর আগেও বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ করেছেন সালমান৷ এ বছরের গ্রীষ্ম থেকে সে দেশের মেয়েরা গাড়ি চালাতে পারবেন৷ বিভিন্ন খেলার অনুষ্ঠানেও মেয়েরা যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন৷ যদিও সেখানে তাঁকে কোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গে যেতে হবে৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এখনো অনেক পথ চলার বাকি৷ কিন্তু সংস্কার হচ্ছে৷ সেটাই আশাব্যঞ্জক৷ তাঁদের বিশ্বাস, যুবরাজের ঘোষণার পর নারীদের পোশাকের বিষয়ে আইনও বদলাবে৷ উল্লেখ্য ইরানে বছরখানেক ধরে বোরকা এবং হিজাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন সেখানকার নারীরা৷ বহু নারী ইতিমধ্যে জেলে গিয়েছেন৷ এমন সময়ে যুবরাজ সালমানের এহেন বক্তব্য আশা জাগায়৷
সৌদি ক্ষমতাকেন্দ্রে তারুণ্য
সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ বাদশাহ মহম্মদ বিন সালমান ‘এমবিএস’ নামেও পরিচিত৷ গত কয়েক বছরে ক্ষমতাকেন্দ্রে তাঁর উত্থান সবার নজর কেড়েছে৷ এই তরুণ নেতা সম্পর্কে এই তথ্যগুলো কি জানা আছে?
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
বাদশাহর আস্থাভাজন
অশীতিপর বাবা বাদশাহ সালমান কার্যত দেশের ক্ষমতা প্রিয় ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন৷ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও তিনি পেট্রোলিয়াম কোম্পানি আরামকো ও দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন৷ উপ প্রধানমন্ত্রী পদও তাঁর দখলে ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Saudi Press Agency
ঝুঁকি নিতে ভয় পান না
প্রচণ্ড পরিশ্রমী বলে পরিচিত মহম্মদ বিন সালমান সৌদি শাসকগোষ্ঠীর এতকালের ধীরস্থির ভাবমূর্তি ভেঙে দিয়েছেন৷ অর্থনৈতিক সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি এতদিনের নানা প্রথা ভেঙে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন৷ তাঁর সমর্থকরা মনে করেন, বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে দেশে এমন নেতারই প্রয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/abaca/Balkis Press
পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন
এতকালের সংযম ভেঙে ফেলে সৌদি আরব গোটা অঞ্চলে নিজস্ব স্বার্থরক্ষায় বেশ কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ ইরানের প্রতি বৈরি মনোভাব, ইয়েমেনে সেনা অভিযান থেকে শুরু করে কাতারকে একঘরে করে ফেলার সিদ্ধান্তের পেছনেও মহম্মদ বিন সুলতানের স্বাক্ষর স্পষ্ট৷ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার স্থপতিও তিনি৷
ছবি: picture alliance / AP Photo
রাজপরিবারে উত্থান
সৌদি রাজপরিবারের জটিল ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোণঠাসা করে বাদশাহর ঠিক পরে শীর্ষ স্থানে পৌঁছানোর মতো অসাধ্যসাধন করেছেন ‘এমবিএস’৷ শুধু তাই নয়, এতকাল মনোনীত ‘ক্রাউন প্রিন্স’ মহম্মদ বিন নায়েফ (বামে) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও উপাধি খুইয়েও তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন৷
ছবি: Reuters/Saudi Press Agency
ব্যতিক্রমী জীবন
সৌদি রাজপরিবারের সন্তানরা সাধারনত বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন, কমপক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছে যান৷ মহম্মদ বিন সালমান সেই পথে না গিয়ে দেশে থেকেই আইন নিয়ে পড়েছেন এবং বাবার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন৷ বাদশাহ সালমান যখন নিজে ক্রাউন প্রিন্স ছিলেন, তখনও তিনি বাবার রাজসভার দায়িত্বে ছিলেন৷
ছবি: Getty Images
পেট্রোলিয়ামের উপর নির্ভরতা
সৌদি অর্থনীতি এতকাল তার বিশাল পেট্রোলিয়াম ভাণ্ডারের উপর নির্ভর করে ছিল৷ মহম্মদ বিন সালমান অর্থনীতির খোলনলচে বদলে ২০৩০ সালের মধ্যে সেই পরিস্থিতি বদলানোর উদ্যোগ শুরু করেছেন৷ ভরতুকিসহ অনেক সুযোগসুবিধা বন্ধ করে তিনি বেশ কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্তও নিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/Ali Jarekji
ধর্মীয় অনুশাসন
সৌদি আরবের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে এখনো কোনো বড় সংঘাতে যাননি মহম্মদ বিন সালমান৷ তবে দেশের বিশাল যুবসমাজের কথা ভেবে তিনি সংগীতের জলসা, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছেন৷ সেইসঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের তত্ত্বাবধায়ক পুলিশের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমিয়েছেন৷