1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘বৈধতার সংকট কাটাতে উন্নয়ন আগ্রাসন ঋণগ্রস্ত করে ফেলে’

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৫ জুলাই ২০২২

করোনা মহামারি শেষের আগেই শুরু হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ৷ এই দুইয়ের প্রভাবে অনেক দেশই এখন বিপর্যস্ত৷ বড় উদাহরণ শ্রীলঙ্কা৷

নারায়ণগঞ্জে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রির ট্রাকের সামনে ক্রেতাদের লাইন
মার্চে নারায়ণগঞ্জে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রির ট্রাকের সামনে ক্রেতাদের লাইনছবি: Munir uz Zaman/AFP

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর জন্য কেমন সময় অপেক্ষা করছে? ডয়চে ভেলের সঙ্গে এ নিয়েই কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান৷

ডয়চে ভেলে :  এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে রাজনীতি না অর্থনীতি, কোনটি বেশি অস্থির মনে হচ্ছে আপনার কাছে?

অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান : আমি যেহেতু রাজনৈতিক অর্থনীতির ছাত্র, তাই আমি এই দুটোকে কখনোই আলাদা করে দেখি না৷ রাজনীতি অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে, আবার অর্থনীতি রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে৷ তার মানে হচ্ছে, এই দুটোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো উপায় নেই৷ যদিও অর্থনীতিবিদরা বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই দুটোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেন, কিন্তু আমি সেভাবে দেখি না৷

তাহলে বর্তমান যে সংকট সেটা রাজনৈতিক কারণে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ,না অর্থনৈতিক কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা?

এটাকে আমি বলব, রাজনৈতিক কারণে অর্থনৈতিক আবার অর্থনৈতিক কারণেও রাজনৈতিক৷ রাজনীতি তো অর্থ ছাড়া চলে না, আবার অর্থের জন্য তো রাজনীতিরও দরকার, যার ফলশ্রুতিতে এই দুটোকে আপনি কখনোই আলাদা করে দেখতে পারেন না৷ যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটকে আপনি অর্থনৈতিক হিসেবেও দেখতে পারেন, আবার রাজনৈতিক সংকট হিসেবেও দেখতে পারেন৷ আমি যেহেতু রাজনৈতিক অর্থনীতির ছাত্র, তাই এটাকে বলি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সংকট৷

শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?

প্রভাব ফেলার চেয়ে আমার কাছে মনে হয়, এটা এক ধরনের সতর্কবার্তা৷ বিশেষ করে আমি এটাকে উন্নয়ন আগ্রাসন বলি৷ আমাদের যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাসীন থাকে, তাদের সঙ্গে সমাজের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে৷ সেই দূরত্বের জায়গায় একটা বৈধতার সংকট থাকে৷ এই বৈধতার সংকট কাটানোর জন্য তাকে কোনো কিছু প্রদর্শন করতে হয়৷ এই প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে উন্নয়ন আগ্রাসনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়৷ শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও এটা একই রকম সত্য৷ এই যে জিডিপিভিত্তিক উন্নয়নের প্রদর্শনী এবং এটা নিশ্চিত করতে গিয়ে ভয়ানকভাবে ঋণগ্রস্থ হয়ে যাওয়া, এটার সঙ্গে যে অনেক বহির্ঝুঁকি থাকে, এই মুহূর্তে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সেই ঝুঁকিটা দেখছি৷ তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ শ্রীলঙ্কায় অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় যে অব্যবস্থাপনা, সেটার একটা বড় প্রভাব আছে৷ পরবর্তীতে কোভিড এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এই অবস্থাটা তৈরি হয়েছে৷

‘বাংলাদেশকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত অনেক পরিবর্তন এসেছে’

This browser does not support the audio element.

জ্বালানি সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, লোডশেডিং ইত্যাদি মিলিয়ে যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

আমাদের যারা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তারাও একই রকম৷ তাদের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রকৃতি এবং মানুষ নেই৷ এই কারণে আমরাও জিডিপি প্রবৃদ্ধিভিত্তিক যে উন্নয়ন, সেই দিকে মনোযোগী৷ আমাদের সম্প্রতি যে বাজেটটা হলো, সেখানেও শ্রীলঙ্কা আমাদের যে বার্তাটা পৌঁছে দিলো, সেটাকে মাথায় রেখেই বাজেটে যে ধরনের প্রস্তুতি থাকার কথা ছিল, সেটা আমরা দেখলাম না৷ বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে এক ধরনের মন্দার মধ্যে প্রবেশ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের বাজেট দেখলে মনে হয় অর্থনীতিতে আমরা ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছি৷ সব মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে, সামগ্রিক দূরদর্শিতার একটা অভাব আছে৷ সামনে বড় ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলায় এটা একটা দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে৷

বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আঞ্চলিক জোটগুলো একে অপরকে সহযোগিতা করে৷ আমাদের এখানেও সার্ক ছিল, যেটা প্রায় অকার্যকর৷ সার্কের অধীনে একটা অভিন্ন ব্যাংক হওয়ার কথা ছিল, যেন কোনো দেশ সংকটে পড়লে সেখান থেকে ঋণ নিতে পারে৷ সেটাও হয়নি৷ এটা না হওয়াকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ক্ষেত্রে চীন এবং ভারত ফ্যাক্টর, যার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনাস্থা আছে৷ শক্তির ভারসাম্য নিশ্চিত করতে গিয়ে কখনো আমরা চীনমুখী হচ্ছি, আবার কখনো আমরা ভারতমুখী হচ্ছি৷ যার ফলশ্রুতিতে এক ধরনের অনাস্থা সবার মাঝেই আছে৷ এই অনাস্থাই সার্ককে অকার্যকর করে রেখেছে৷ শেষ পর্যন্ত যে অভিন্ন ব্যাংকটি হলো না, সেটা তো অনাস্থারই প্রকাশ৷

বর্তমানে জ্বালানি সংকট কেবল ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?

এই যুদ্ধটা জ্বালানি সংকটের কারণ হতে পারে৷ তবে এটাই একমাত্র কারণ না৷ সবচেয়ে দুঃখজনক হলো আমরা ২০১০ সালে পাওয়ার সিস্টেমের মাস্টার প্ল্যান করলাম৷ এটা আমরা করলাম কয়লা এবং এলএমজিনির্ভরতা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে৷ বারবার এটা রিভাইজ করলাম৷ এই পরিকল্পনাটা কে করলো? জাপানের একটা কোম্পানী৷ জাইকার অর্থায়নে আমরা এই মাস্টার প্ল্যানটা করলাম৷ এই পরিকল্পনাটা করার ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের বিশেষজ্ঞদের মতামত নিলাম না, আমরা পুরো জ্বলানিটা আমদানিনির্ভর করে ফেললাম৷ আমরা গ্যাসের নতুন মজুদের সন্ধান না করেই আমদানিনির্ভর করে ফেললাম, যার ফলে আমাদের এই সময়ের সংকটটা হচ্ছে৷ এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করলে বহির্ঝুঁকিটা মাথায় নিয়েই করতে হয়৷ সেটা না করে আমরা একটা কোম্পানি, যারা মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত, তাদের দিয়ে করলাম৷ এখানে কিন্তু স্বার্থের দ্বন্দ্বও আছে৷ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব মালিকানাও নেই৷ এসব কারণে এখন আমরা যে ধরনের সংকটে পড়েছি, সেটা আমরা দূরদৃষ্টির সাহায্যে দেখতে পাইনি৷

এই যে অস্থির পরিস্থিতি, এর প্রভাবে বাংলাদেশের সরকার, না রাষ্ট্রের বেশি ক্ষতি হচ্ছে?

আমাদের সরকার কে? আর রাষ্ট্র কে? সেটা পার্থক্য করাই তো মুশকিল৷ সরকার আর রাষ্ট্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে৷ এক্ষেত্রে সরকার যদি ব্যর্থ হয়, সেটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখতে হচ্ছে৷ আর রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয়, সেটা সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখতে হবে৷

মেগা প্রজেক্ট দেশের অর্থনীতির জন্য সহায়ক, না হুমকি?

53:11

This browser does not support the video element.

বর্তমানে যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, এটা কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন আপনি?

এই বৃদ্ধিটা তো হঠাৎ করেই হয়নি৷ আবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরই যে বেড়েছে তা-ও নয়৷ আমরা পেঁয়াজ নিয়ে দেখেছি, আলু নিয়ে দেখেছি৷ সময় সময় আমরা সিন্ডিকেটের কথা শুনি৷ এগুলোর উপর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে ধরনের প্রভাব থাকার কথা ছিল বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে ধরনের জবাবদিহিতা থাকার কথা ছিল, সেটা না থাকার কারণেই কিন্তু মূল্য বৃদ্ধি৷ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নতুন প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে৷ এটাই একমাত্র প্রভাবক না৷ আমাদের এখানে রাজনীতিবিদরা নিজেরাই ব্যবসায়ী আবার ব্যবসায়িরা নিজেরাই রাজনীতিবিদ৷ ফলশ্রুতিতে কে কাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনবে? এখানে নির্বাচন নিয়ে অনেক রকমের বিতর্ক আছে৷ বৈধতার সংকট আছে৷ সবকিছু মিলিয়ে এখানে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা সেটা অব্যবস্থাপনা বটে৷

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ভবিষ্যৎ বিশ্ব রাজনীতির গতিপথ কতটা বদলাতে পারে?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা দেখেছি ব্রিটেনের উত্থান৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান৷ এই যুদ্ধেও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত তো আছেই৷ বিশেষ করে এনার্জিকে ঘিরে রাশিয়ার যে প্রভাব তৈরি হয়েছে, পাশাপাশি জাতিসংঘে ভোটিং প্যাটার্নটাও দেখি সেখানে কিন্তু রাশিয়া-চীনের মধ্যে যে ঐক্যমত, তাতে মেরুকরণটা খুবই স্পষ্ট৷ এই যুদ্ধটা একটা প্রতিষ্ঠানিক মাত্রা দিয়েছে৷ বিশ্ব-ব্যবস্থা এখন একটা বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থাও কিন্তু সেই অবস্থায় নেই৷

বর্তমানে যে সংকটময় অবস্থা এটা থেকে উত্তরণের পথ কী? বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে?

বাংলাদেশে তো অনেক রকম সংকট আছে৷ এখানে রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা আছে৷ বাংলাদেশকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে ঘিরে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রভাববলয় তৈরির চেষ্টা আছে৷ এই সবকিছু শেষ পর্যন্ত কোনদিকে নিয়ে যায়, তার উপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ৷ এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে যারা আছে, তারা কী ভূমিকা পালন করে, তার উপর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারিত হতে পারে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ