নারী বিদ্বেষের কারণে কোনো গোষ্ঠী কোনো বাস্তবতা অস্বীকার করলে, আর সেই গোষ্ঠীকে গুরুত্ব দেয়ার মানে হলো ওই গোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ করা অথবা কোনো গোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের জন্য তাদের অন্যায় আবদার মেনে নেয়া।
বিজ্ঞাপন
লিঙ্গভিত্তিক সমতার দাবিতে সম্প্রতি ঢাকায় সমাবেশের আয়োজন করে মৈত্রী যাত্রা ছবি: Harun Ur Rashid/DW
অপরাধ ঘটছে কীনা সেটা আগে জানা দরকার। আর না ঘটলেও যদি প্রবণতা দেখা যায় তাহলেও সেই প্রবণতা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান একটি জটিল মামলায় বাদীর আইনজীবী হিসাবে কাজ করছেন। মামলাটির বাদী একজন বিবাহিত নারী। মামলাটি যে পর্যায়ে যাচ্ছে তাতে হয়তো আইনি প্রতিকার শেষ পর্যন্ত পাবেন, কিন্তু কত সময় লাগবে তা নিয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়ছেন। কারণ মামলার আসামি নারীর সাবেক স্বামী বাংলাদেশে আইন না থাকার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছেন।
এবার একটু খোলাসা করে বলি। তারা দুইজনই পেশায় চিকিৎসক। স্ত্রীকে তালাকের নোটিশ পাঠান স্বামী এবং তারা আলাদা বসবাস করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের আইনে তালাক কার্যকর হতে তিন মাস সময় লাগে, যদি কোনো পক্ষ কোনো সমঝোতার উদ্যোগ না নেন।
এই ঘটনায় তালাকের নোটিশ পাঠানোর একমাস পর স্বামী তার ওই স্ত্রীকে (তালাকের নোটিশ দেয়া) ডাকেন এবং ধর্ষণ করেন। স্ত্রী আদালতে ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ হলে বিচারিক আদালত বিচারের জন্য চার্জ গঠন করেন। কিন্তু তার আগেই আইনজীবীর পরামর্শে তালাকের নোটিশের তিন মাস সময় পার হওয়ার আগেই স্বামী তার স্ত্রীকে দেয়া তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার করে নেন। ফলে তালাক আর কার্যকর হয়নি।
এখন স্বামী বিচারিক আদালতের বিচারিক কার্যক্রমকে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছেন বিচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য। প্রমাণের চেষ্টা করছেন, তারা স্বামী-স্ত্রী। উচ্চ আদালত এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। তবে যদি প্রমাণ হয় যে ঘটনার সময় তালাক কার্যকর হয়নি এবং সেই বিবেচনায় তারা স্বামী-স্ত্রীই ছিলেন, তাহলে আদালত কী রায় দেবেন তা আমি জানি না।
এবার আইনে ধর্ষণকে কিভাবে ভাগ করা হয়েছে তা একটু দেখার চেষ্টা করি।
১. বাংলাদেশের আইনে বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে যেকোনো বয়সের নারীর অসম্মতিতে বা জোর করে, মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণের অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়।
২. স্বামী-স্ত্রী হলেও ১৩ বছরের কম বয়সি নারীর সম্মতি বা অসম্মতি যাই হোক না কেন, স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকেও ধর্ষণ হিসাবে গণ্য করা হয়।
৩. বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে ১৬ বছরের কম বয়সি কোনো নারীর সম্মতি বা অসম্মতি, প্রলোভন যাই হোক না কেন যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণ হিসাবে গণ্য করা হয়।
আইনেই স্পষ্ট যে বিবাহিত নারীর বয়স ১৩ বছর বা তার অধিক হলে তিনি যদি তার স্বামীর দ্বারা যৌন সন্ত্রাসের শিকারও হন, ধর্ষণের মামলা করতে পারবেন না। সেই প্রতিকার বর্তমান আইনে নেই। বিবাহিত নারীর বয়স ১৩ বছরের কম হলেই কেবল তিনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করতে পারবেন।
তবে বাস্তবতা হলো এই ধরনের মামলার কোনো নজির নেই বললেই চলে। এইসব ঘটনায় পরিবার না চাইলে বা সহায়তা না পেলে ওই নারী কীভাব মামলা করবেন?
বাংলাদেশে নারীদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। পুরুষের ক্ষেত্রে সেটা ২১ বছর। কিন্তু বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ এখনো প্রকট আকারে রয়েছে। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ অনুযায়ী দেশে বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ। যে হারে বাল্য বিবাহ কমছে, সেভাবে চললে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করতে সময় লাগবে ২১৫ বছর।
আইনে ১৩ বছরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে বেশি বয়সের স্ত্রীরা বৈবাহিক ধর্ষণের মামলার কোনো সুযোগও পাচ্ছেন না। এ কারণেই যেকোনো বয়সে বৈবাহিক ধর্ষণের প্রতিকার চেয়ে আইন প্রণয়নের দাবি উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনও সেই আইন করার প্রস্তাব করে এখন তোপের মুখে পড়েছে।
যে আইন যুক্তরাজ্যে হয়েছে ১৯৯১ সালে। সেই আইনের দাবি তুললে এখন বাংলাদেশে উলটো বিপদে পড়তে হয়।
’বৈবাহিক ধর্ষণ’ : বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী, পুরুষ যা ভাবছেন
‘ম্যারিটাল রেপ’ অর্থাৎ ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে ডয়চে ভেলে৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Maya Alleruzzo/AP Photo/picture alliance
পক্ষে-বিপক্ষে কথা হলে আইন তৈরি ও সংজ্ঞায়িত করা সহজ হবে: কামরুন নাহার, সদস্য, নারীপক্ষ
‘‘বিবাহের পর যৌন সম্পর্ক স্থাপনে জোরজবরদস্তির মতো ‘অপরাধটি’ যেন বেড়ে না যায় এবং নারী-পুরুষ সকলেই আইনের সহায়তা পায় সেই কারণেই সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে তো কথা হবেই এবং হওয়া উচিত বলেও মনে করি।এতে আইন তৈরি করা এবং সম্মতি ও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’কে সংজ্ঞায়িত করা সহজ হবে। কোন প্রেক্ষিতে এটিকে অপরাধ ধরা হবে তার ব্যাখ্যায় বয়স নির্ধারণ করা আছে।’’
‘‘সংবিধানের ২৭ নম্বর ধারায় বলা আছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ৩২ নম্বর ধারায় ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। বিবাহ মানেই তো সম্মতির অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়। বিয়ের আগে একজন নাগরিকের যেসব অধিকার থাকে, বিয়ের পরও ঠিক তাই থাকে। এই অধিকার রক্ষা করতে না পারলে তা সংবিধানের সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ।আধুনিক যুগে দেশের 'বৈবাহিক ধর্ষণ' নিয়ে সরাসরি আইন না থাকা হতাশার।’’
ছবি: Privat
বৈবাহিক ধর্ষণ ও সম্মতির গুরত্ব নতুন প্রজন্ম কিছুটা বুঝতে পারছে : জাওয়াদ বিন মিজান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাওয়াদ বিন মিজান বলেন, ‘‘বন্ধু ও সমসাময়িক পরিচিতজনদের মধ্যে এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছুটা কথা হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখি তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আলোচনা করেন। সম্পর্কে থাকলেই সব কিছু স্বাভাবিকভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত- এই ধারণায় কিছুটা বদল এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল। তাই নারী ও পুরুষ উভয়রই এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত।’’
ছবি: Privat
'ম্যারিটাল রেপ' পরিভাষাটি বলা বাদ দিয়ে বরং নারীর অধিকার রক্ষার আলাপ করা উচিত: মীর হুযাইফা, গবেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করা এবং বর্তমানে গবেষক হিসেবে কর্মরত মীর হুযাইফা বলেন, ‘‘হাদিসের আলোকেই বিবাহ পরবর্তী প্রতিবার মেলামেশায় দুজনেরই সম্মতির প্রয়োজন আছে। দেশে বিবাহ পরবর্তী সহিংসতার হার বেশি। নারীরা এ বিষয়ে কথা বলতে ভয় পান। তাই সামাজিক আলাপ ওঠা উচিত। তবে ‘ম্যারিটাল রেপ’ বা ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ পরিভাষাটির পরিবর্তে নারীর অধিকার রক্ষা- এভাবে আলোচনা জরুরি।’’
ছবি: Privat
‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বড় একটি জনগোষ্ঠীর কাছে ট্যাবু : জুবায়দুল হক রনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়দুল হক রনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর ফলে নারী মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু তবুও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বড় একটি জনগোষ্ঠীর কাছে ট্যাবু। বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন করা হলে সে আইন শুধু নারীর জন্য নয়, পুরুষের জন্যও হবে। কোনো পুরুষ যদি ‘বৈবাহিক ধর্ষণের’ শিকার হন, তাহলে তিনিও আইনের সহায়তা নিতে পারবেন। ’’
ছবি: privat
সেই ক্ষত ও ট্রমা দীর্ঘ বছরেও ভুলতে পারিনি : ভুক্তভোগী নারী
বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার এক ভুক্তভোগী নারী বলেন, ‘‘নিজের পছন্দে বিয়ে করলেও বিয়ের রাতেই স্বামীর জোরজবরদস্তির শিকার হয়েছি। এটিকে যে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বলে সেটাও জানতাম না। কিন্তু বহুবার একই ধরনের ঘটনা ঘটার পরে বুঝতে পারলাম,পরিবারকে জানালেও সবাই সংসার চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেন। অনেক সহ্য করার পর সে সম্পর্ক থেকে তালাক দিয়ে বেরিয়ে আসি। কিন্তু সেই ক্ষত ও ট্রমা দীর্ঘ বছরেও ভুলতে পারিনি।’’
ছবি: Colourbox
অনেক নারী ও পুরুষের কাছেই ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর অস্তিত্ব নেই : নওশিন নাবিলা, চাকরিজীবী
চাকরিজীবী নওশিন নাবিলা বলেন, ‘‘পরিবার থেকেই নারীদের শিখানো হয় স্বামীকে খুশি রাখতে হবে। এই প্রথাগত ধারণা থেকে এ সময়ে এসেও নারীরা বের হতে পারেননি। আর বেশির ভাগ পুরুষও এর বাইরে ভাবতে চান না। তাই ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর অস্তিত্ব অনেক নারী ও পুরুষের কাছেই নেই। কোনো নারী তার অধিকার নিয়ে কথা বললেই সে খুব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘নারীবাদী’ বলে বিবেচিত হন।’’
ছবি: Rifat Parveen Anny/DW
পুরুষ তার চাহিদাই শুধু বোঝে : মাসুদা, সুপারশপের কর্মী
একটি সুপারশপের কর্মী মাসুদা বলেন, ‘‘পুরুষরা শুধু নিজের চাহিদা বোঝে। স্ত্রীর শরীর খারাপ, ব্যথা বা পিরিয়ড কোনো কিছুই তারা বুঝতে চায় না। স্বামীর সঙ্গে প্রায়ই এ নিয়ে ঝগড়া হয়। আমি যে ছোট বাড়িতে ভাড়া থাকি, সেখানে প্রায় সব মেয়েই একই কষ্টের কথা বলে। আইন হলে নারীদের সাহায্য নেওয়া উচিত, কিন্তু পরিবার, সমাজ কী বলবে। টাকা না থাকলে সে নারী কী খাবে, সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাবে।’’
ছবি: Rifat Parveen Anny/DW
বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে অনেক কিছুই মানতে হয়েছে : সুলতানা, গৃহকর্মী
সুলতানা পেশায় গৃহকর্মী৷ তিনি জানান, ‘‘বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে অনেক কিছুই মানতে হয়েছে। এখন আর স্বামী কোনো কিছু নিয়া জোরাজুরি করে না। আমার অমতে শারীরিক সম্পর্ক করে না। বয়স কম থাকতে তো বুঝতে চায় না। সারা দিন পরিশ্রম করলে মন না-ই চাইতে পারে। বিয়ের পর নিজের মায়ের কাছেও কিছু বলা যায় না। স্বামীর সম্পর্কে কিছু বলাও তো ভালো না।’’
ছবি: Rifat Parveen Anny/DW
কোনো আলোচনা ছাড়া কণ্ঠরোধ সমর্থন করি না : কামরুল হাসান, উদ্যোক্তা ও চলচ্চিত্রকার
উদ্যোক্তা ও চলচ্চিত্রকার কামরুল হাসান বলেন, ‘‘বৈবাহিক সম্পর্কে অধিকার আছে, কিন্তু ধর্ষণ বলে কিছুই নেই- এমন ধারণা অনেক নারী ও পুরুষের। তাই এই বিষয়ে আলোচনা হলে, আইন হলে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ভালো, যদিও আইনের ভুল ব্যবহার যেন না হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা নিয়ে আলাপ হওয়াও জরুরি। কিন্তু কোনো আলোচনা ছাড়া কণ্ঠরোধ সমর্থন করি না। বিশ্বের অনেক দেশেই বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন হয়েছে।’’
ছবি: Rifat Parveen Anny/DW
পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ ও সম্মতি শিক্ষা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই :
নিফাত সুলতানা, শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থী নিফাত সুলতানা মনে করেন, ‘‘পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈবাহিক ধর্ষণ ও সম্মতি শিক্ষা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই।’’ ডয়চে ভেলেকে তিনি আরো বলেন, ‘‘বেশির ভাগ ছেলে বন্ধু এ বিষয়ে কথা বলতে লজ্জা বোধ করেন। তবে কিছু বন্ধু স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা করেন। তাই মেয়ে বন্ধুরা নিজের মধ্যে আলাপ করি, বিবাহিত বান্ধবীদের থেকে জানার চেষ্টা করি।’’
ছবি: privat
বৈবাহিক ধর্ষণ ও সম্মতির বিষয়ে বিবাহিত ও অবিবাহিত সবারই কথা বলা উচিত : তাসফিয়া ফাইরোজ আনান, শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থী তাসফিয়া ফাইরোজ মনে করেন বিবাহিত নারীদের অনেকেই চুপ থাকাতে বৈবাহিক ধর্ষণের মতো বিষয়টি আলোচনায় আসছে না৷ তিনি বলেন, ‘‘সম্মতির বিষয়টি প্রতিটি সম্পর্কেই জরুরি, সে সম্পর্ক বৈবাহিক হোক বা না হোক। একজন মানুষ হিসেবে নিজের শরীর ও সম্মতির অধিকার সবারই থাকা উচিত। এই বিষয়ে কেবল ভুক্তভোগী না, বরং আমাদের সবার, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের খোলাখুলি কথা বলা উচিত, যাতে সচেতনতা বাড়ে এবং সমাজে পরিবর্তন আসে।’’
ছবি: Tasfia Fairoz Anan
স্বামীর ডাকে স্ত্রীকে সাড়া দিতে হবে: মাওলানা কারী রওশন আরা নূরী, প্রিন্সিপাল, ইসলামী মিশন মহিলা কামিল মাদ্রাসা
তিনি বলেন, ‘‘কোরআনের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘স্বামী-স্ত্রী একে অপরের লেবাস (পোশাক) স্বরূপ৷ আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে, যখন তোমার স্বামী ডাকবে, তখন তুমি তার ডাকে সাড়া দেবে৷ এটা হলো ফরজ৷ স্বামী ডাকলে সাড়া দিতে হবে৷ কিন্তু স্ত্রীর কোনো শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা থাকলে সে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে স্বামীকে সেটা বিবেচনা করতে হবে৷ প্রয়োজনে একসাথে বসে আলোচনা করে নেবে। কিন্তু স্বামীর ডাকে স্ত্রীকে সাড়া দিতে হবে।''
ছবি: Sayala Roksana Dina
13 ছবি1 | 13
শিশু নির্ধারণের বয়স নিয়ে একটা জটিলতা সবসময়ই বাংলাদেশে আছে। জাতিসংঘের নিয়ম মেনে এখানে বলা হয় ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিবাহিত হলে শিশু হবে ১৩ বছরের কম বয়সী নারীরা। বিবাহিত না হলে ১৬ বছরের কম বয়সিরা। এই দুই বয়সের নারীদের দুই পরিস্থিতিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
২০২০ সালে এই আইনের জন্য বাংলাদেশ লিগ্যাল সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে রিট করেছিলো। হাইকোর্ট রুলও জারি করেছিল। ২০২০ সালের অক্টোবরে টাঙ্গাইলে ১৪ বছর বয়সি এক নারী (শিশু) তার তার স্বামীর যৌন নিপীড়নের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান বিয়ের এক মাসের মাথায়। তখন সেটাকে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে ধামাচাপা দেয়া চেষ্টা করা হয়।
ওই ঘটনাটিকে সামনে এনেই তখন বৈবাহিক ধর্ষণকেও ধর্ষণের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আদালতের কাছে নির্দেশনা চাওয়া হয়। তখন ব্লাস্ট বলেছিল ২৭ দশমিক তিন শতাংশ নারীই তাদের বিবাহিত জীবনে স্বামীর দ্বারা যৌন সহিংসতার শিকার হন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘নারীদের ওপর সহিংসতা শীর্ষক জরিপ ২০২৪' এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবদ্দশায় অন্তত: একবার হলেও স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হন।
জরিপে নারীদের ওপর চার ধরনের সহিংসতার তথ্য তুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে শারীরিক সহিংসতা, যৌন, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা।
সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ৭ দশমিক চার শতাংশ নারী আইনের আশ্রয় নেন। বাকি ৯৩ দশমিক ছয় শতাংশ নারী এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেন না। এ ছাড়া সহিংসতার শিকার ৬৪ শতাংশ নারী তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কখনও কারও সঙ্গে শেয়ারই করেন না।
ফলে বিবাহিত নারীর প্রতি স্বামীর যৌন সহিংসতা এই জরিপেও স্পষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিবাহিত নারীর বয়স ১৩ বছর বা তার বেশি উল্লেখ থাকায় বৈবাহিক ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার শিকার হলে এমন কারো প্রতিকার পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই।
যে নামই দেয়া হোক না কেন, বাংলাদেশে বৈবাহিক ধর্ষণ উচ্চ মাত্রায় হচ্ছে। অবশ্যই বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের জন্য ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় রয়েছে। এটা কোনো ক্রীতদাস ব্যবস্থা নয়। তাই স্বামী বা স্ত্রী কারুর যদি অনিচ্ছা বা অসম্মতি থাকে তাহলে জোর করা বা সহিংসতা করা কোনো আইনেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারো দাম্পত্য জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করলে তিনিও আইনে প্রতিকার পাওয়ার অধিকার রাখেন।
কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন বৈবাহিক ধর্ষণ প্রমাণ হবে কীভাবে? এটা আমার কাছে একটা হাস্যকর প্রশ্ন মনে হয়েছে। ধর্ষণের ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াও তো নানা ধরনের শারীরিক আলামত থাকে।
বাংলাদেশে বৈবাহিক ধর্ষণের বাইরে যে ধর্ষণ আছে তাতেও তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাদি ছাড়া চাক্ষুষ সাক্ষী থাকে না। কারণ ধর্ষক তো আর সাক্ষী রেখে ধর্ষণ করে না। ফরেনসিক প্রমাণ এই ক্ষেত্রে বড় একটি প্রমাণ। এটা নিয়ে আইনে মারপ্যাঁচ করা হয় বলেই ধর্ষণের মামলায় শাস্তির হার খুবই কম।
বৈবাহিক ধর্ষণকে কোনোভাবেই ধর্ষণের বাইরে রাখার সুযোগ নাই। তবে সতর্কতা জরুরি। কারণ ধর্ষণ মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তাই ধর্ষণের মামলার তদন্ত থেকে বিচার সবখানেই সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও সতর্কতা প্রয়োজন। কেউ যেন এর অপব্যবহার করার সুযোগ নিতে না পারে তার জন্য আইনে সেফটি ক্লজও থাকা জরুরি।
নারী তার বিবাহিত জীবনে স্বামীর হাতে যদি যৌন সহিংসতার শিকার হন, তার প্রতিকার পাওয়ার আইনগত ব্যবস্থা তো থাকতে হবে। সেটা তো কোনো আইনেই নাই। সেক্ষেত্রে কী হবে? যারা বৈবাহিক ধর্ষণ আইনের বিরোধিতা করেন তাদের কাছে প্রশ্ন, তাহলে কোন আইনে ওই যৌন সহিংসতার বিচার হবে। আপনাদের জানা আছে?