1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বৈবাহিক ধর্ষণ: ছত্তিসগড় হাইকোর্টের রায়ে হতাশ সমাজকর্মীরা

শময়িতা চক্রবর্তী
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

'অস্বাভাবিক যৌন মিলনের' ফলে স্ত্রীর মৃত্যুর পরেও ছত্তিসগড় হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর মুক্তি পেলেন এক যুবক। এই রায় ঘোষণার পরে নতুন করে বিতর্ক।

পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে আন্দোলন
ফাইল চিত্রছবি: Saikat Paul/Pacific Press/picture alliance

ভারতে বৈবাহিক ধর্ষণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। এমনকি, বিনা সম্মতিতে সেই 'অস্বাভাবিক' যৌন মিলনের ফলে যদি স্ত্রীর মৃত্যু হয়, তাহলেও বেকসুর মুক্তি পেতে পারেন স্বামী। গত সোমবার ছত্তিসগড় হাই কোর্টের এমনই এক রায়ে স্তম্ভিত গোটা দেশ। এই রায় ঘোষণার পরে নতুন করে শুরু হয়েছে মানবাধিকার, নারী সুরক্ষা বনাম ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিবাহের 'পবিত্র' বন্ধনকে মর্যাদা দেওয়ার বিতর্ক।

মূল ঘটনা

২০১৭-র ডিসেম্বরে ছত্তিসগড়ের হাসপাতালে এক তরুণীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালীন জবানবন্দীতে তিনি জানিয়েছিলেন, স্বামী তার অনুমতি ছাড়াই 'অস্বাভাবিক' যৌনমিলনে বাধ্য করেছেন। ধর্ষণের পর পেরিটোনাইটিস এবং পায়ুদ্বারে সংক্রমণের কারণে তার মৃত্যু হয়। নিম্ন আদালত স্বামীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও, সোমবার হাইকোর্ট তাকে মুক্তি দেয়।

সোমবার হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের বিচারক নরেন্দ্র কুমার ভ্যাস তার রায়ে জানান, "স্ত্রীর বয়েস ১৫ বছরের বেশি। ফলত স্বামীর সঙ্গে কোনো যৌনমিলনকেই ধর্ষণ বলা যায় না। সেক্ষেত্রে অস্বাভাবিক যৌনমিলনের ক্ষেত্রেও স্ত্রীর সম্মতির প্রসঙ্গটি অবাস্তব।"

স্তম্বিত সমাজ, হতাশ সমাজকর্মীরাও

নারীসুরক্ষা এনজিও স্বয়মের কর্মী অমৃতা দাশগুপ্ত ডিডব্লুকে বলেন, "নারীসুরক্ষা নিয়ে ভারতবর্ষে এত কাজ হওয়ার পরেও ম্যারিটাল রেপকে আমরা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ করতে পারিনি। সমস্যা হলো আমাদের সমাজে, ধর্ম-মত নির্বিশেষে, বিবাহকে কঠোর পুরুষতান্ত্রিকতার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা হয়। মেয়েদের স্বামীর কাছে সমর্পণ করেন বাবা। ফলে এই সমর্পণের কারণেই ধর্ষণকে দণ্ডনীয় করাতে বাধা আসে। ছত্তিসগড়ের এই রায় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, আমদের এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি। আমাদের দেশে যৌনশিক্ষা নেই কিন্তু প্রভূত পর্নোগ্রাফি পাওয়া যায়। পর্নোগ্রাফি দেখার হার ঊর্দ্ধগামী। ফলে স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক যৌনমিলনের পার্থক্য, সম্মতি অথবা ব্যক্তিগত পরিসরের সীমারেখা, এই সব নিয়ে কোনো চেতনা তৈরি হয় না।"

পারিবারিক সহিংসতা রোধে নারীদের পাহারা

02:33

This browser does not support the video element.

সম্মতিতে মিলন এবং যৌন দমন

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দোপাধ্যায় ডিডব্লুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "এত সংলাপ এত আন্দোলনের পরে আদালত যদি ধর্ষণ এবং যৌনতাকে আলাদাভাবে দেখতেই না পায়, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং ভয়ংকর প্রবণতা। আমরা জানি গার্হস্থ্য হিংসার যে আইন আছে তার মধ্যে বলপূর্বক যৌনতা, এমনকি জোর করে পর্নোগ্রাফি দেখানোও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাহলে এই ঘটনাকে আদালত লঘু করে দেখে কীভাবে? এই ঘটনা কেবলমাত্র নারী সুরক্ষাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয় না, মানবাধিকারের দিক দিয়ে এটি একটি লজ্জাজনক বিষয়।"

অনুত্তমা স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক যৌনতার বিভাজনে বিশ্বাস করেন না বলে জানিয়েছেন। তার কথায়, "আমি মনে করি যৌনতা একমাত্র সম্মতিক্রমে হতে পারে। অসম্মতিতে যৌনতা যৌনপীড়নের নামান্তর। এক্ষেত্রে দ্বিতীয়টি ঘটেছে। কোনো সম্মতি ছাড়াই ধর্ষণ, নিপীড়ন এবং তার পরে মৃত্যু ঘটেছে। আমাদের নিজেদের মধ্যেই যদি সম্মতিক্রমে যৌনতা এবং যৌনতার নামে দমন নিয়ে স্পষ্ট বিভাজন না থাকে, তাহলে তা আইন, সমাজ মন এবং সম্পর্কের বুনন-– সব কিছুকেই আহত করবে।"

অসহায়তা বনাম আইন 

২০১৭ সালে তিতির বসুর (গোপনীয়তা রক্ষার্থে নাম পরিবর্তিত) বিয়ে হয়। ২০১৮ সালের শেষে তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হন। ছত্তিসগড় হাইকোর্টের রায় তিতিরকে গভীরভাবে বিচলত করেছে। "শুধু এই ঘটনা কেন, আজ ছত্তিসগড়, কাল মধ্যপ্রদেশ পরশু অন্যও কোথাও এই ঘটনা ঘটবে, প্রতিদিন ঘটেই চলেছে। এই ঘটনা প্রতিনিয়ত আমাকে আমার লড়াইয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরে আজও আমি স্বাভাবিক জীবনে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে ফিরতে পারিনি। প্রথম যেদিন থানায় অভিযোগ জানাতে গেছিলাম, পুলিশ অফিসার স্বামীর সঙ্গে মিটমাট করে নিতে বলেছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তারপর অভিযোগ দায়ের করতে পেরেছিলাম।"

আইনের সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে মানবাধিকার আইনজীবী সরসিজ দাশগুপ্ত বলেন, "আমাদের দেশে ম্যারিটাল রেপ আইনত দণ্ডনীয় নয়। আমরা জানি এই নিয়ে অনেক বিতর্ক চলছে। একজন নারী কীভাবে সুরক্ষা পেতে পারেন তা নিয়ে আরো ভাবা দরকার। এক্ষেত্রে, ছত্তিসগড়ে মৃতার পরিজন সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন। আমাদের দেশে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় শাস্তিমূলক অপরাধের এমন অনেক বিধান আছে যা এক্ষেত্রে ঘটেছে। যেমন কালপেবল হোমিসাইড বা অনিচ্ছাকৃত হত্যার আইন। নৃশংসতার মামলাও এক্ষেত্রে রুজু হতে পারে। সব থেকে বড় কথা, এসব ক্ষেত্রে মৃত্যুকালীন জবানবন্দী খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়। দিল্লির নির্ভয়ার ক্ষেত্রে তার জবানবন্দী দোষীদের শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এখানেও মৃতার জবানবন্দীতে জোর করে যৌনমিলনের কথা বলা হয়েছে। ফলে উচ্চ আদালতে আপিল করা যেতেই পারে।"

এ বিষয়ে নির্দিষ্ট আইন না হওয়া পর্যন্ত বিবাহে ধর্ষণের শিকার এমন মহিলারা কি আইনের সাহায্য পেতে পারেন? এ প্রশ্নের উত্তরে সরসিজ বলেন, "আইন পরিবর্তন বা প্রণয়ন না হলেও পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো জরুরি। পুলিশ এফআইআর নিতে অস্বীকার করলে ম্যাজিস্ট্রেট অথবা উচ্চতর আদালতের থেকে নির্দেশ আনানো সম্ভব।"

পশ্চিমবঙ্গের চিত্র           

পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ডিডব্লুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, তাদের কাছে আসা অভিযোগের ১০-১৫ শতাংশই বৈবাহিক ধর্ষণ। "তবে প্রত্যেকটি বৈবাহিক ধর্ষণের পিছনে পারিবারিক সহিংসার উল্লেখ থাকে। আমি অন্তত এমন কোনো বৈবাহিক ধর্ষণের অভিযোগ পাইনি যেখানে পারিবারিক সহিংসা ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে আমরা কাউন্সেলিং করি। তবে বহু সময়েই বিবাহ বিচ্ছেদের পথে হাঁটেন অভিযোগকারিনী।"

ভারতে একাধিক সমাজকর্মী, আইনজীবী, এমনকি বেশ কিছু রাজনৈতিক কর্মীও বহুদিন ধরে বৈবাহিক ধর্ষণকে আইনের চোখে দণ্ডনীয় করার লড়াই চালাচ্ছেন। এই মুহূর্তে, বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ