হাজার হাজার মানুষ এ বার পথে নামলেন বৈরুতে। সরকার বিরোধী বিক্ষোভে চলল কাঁদানে গ্যাস। বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে এক জার্মান কূটনীতিকের।
বিজ্ঞাপন
বিস্ফোরণের জের, বৈরুতে শুরু হলো জনগণের বিক্ষোভ। বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টের বাইরে জমায়েত হন সাধারণ মানুষ। সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা স্লোগান দিতে থাকেন। কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পুলিশ সেই বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে পরিস্থিতি যা, তাতে শুক্রবার ফের বিক্ষোভের সম্ভাবনা আছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাধারণ মানুষের দাবি, বর্তমান সরকারের অবহেলার জন্যই বন্দরে বিস্ফোরণ ঘটেছে। অভিযোগ, ছয় বছর ধরে যে ভাবে গুদামে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ফেলে রাখা হয়েছিল, তাতে আরও আগে এমন বিস্ফোরণ ঘটতে পারতো। বস্তুত, বৃহস্পতিবারই বন্দর কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ জানিয়েছিলেন, একাধিকবার সরকারের কাছে এ বিষয়ে চিঠি লেখা হয়েছিল। চিঠি দেওয়া হয়েছিল আদালতকেও। কিন্তু অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সরানো বা বিক্রির বিষয়ে কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অবহেলার কারণেই বৈরুতের সাধারণ মানুষকে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের সাক্ষী থাকতে হলো বলে অভিযোগ।
বিধ্বস্ত বৈরুতে
বিস্ফোরক দ্রব্যের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ফলে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দর এক অংশ এখন ধ্বংসস্তূপ৷ ৪ বাংলাদেশিসহ অন্তত ১৩৫ জন নিহত এবং চার হাজারের বেশি মানুষ আহত হলেও ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরছে সেখানে৷ দেখুন ছবিঘরে....
ছবি: Reuters/A. Taher
বিধ্বস্ত মসজিদে
বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত এক মসজিদের কার্পেট থেকে ভাঙা কাঁচ কুড়াচ্ছেন এক জন৷
ছবি: Reuters/A. Taher
গির্জাও বিধ্বস্ত
রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণের ফলে এক গির্জার এখন এই অবস্থা৷
ছবি: Reuters/A. Taher
শহর লন্ডভন্ড
বিস্ফোরণে লন্ডভন্ড শহরের এক বিধ্বস্ত ভবনের পাশ দিয়ে মোটর সাইকেলে এগিয়ে চলেছেন দুজন৷
ছবি: Reuters/A. Tahir
বিস্ফোরণস্থল
৫ আগস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতের ঠিক এই জায়গাটায় হয়েছিল বিস্ফোরণ৷তাই ভবনগুলো যেন শুধু রডের কঙ্কাল৷
ছবি: Reuters/A. Taher
হাসপাতালের হাল
বিধ্বস্ত এক হাসপাতাল গোছানোয় ব্যস্ত কর্মীরা৷
ছবি: Reuters/M. Azakir
লড়াকু দুজন
নিজের মুদির দোকানটা প্রায় শেষ, বিস্ফোরণে নিজেও আহত৷ বৈরুতের এই নারী তবু সামান্য কিছু বেচাবিক্রির আশায় দোকান খুলে বসেছেন৷ পাশে তার স্বামী৷
ছবি: Reuters/A. Taher
এ কোন ঘর!
নিজের সাজানো গোছানো ঘরের অবস্থা দেখে এই নারী যেন বুঝতে পারছেন না কোথায় আছেন তিনি!
মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৫৭। আহতের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিক্ষোভকারীদের দাবি, এখনও বহু মানুষের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আটকে আছেন কি না, সে প্রশ্ন উঠছে। রাজধানী জুড়ে ধ্বংসাবশেষ সরানোর কাজ এখনও চলছে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, মঙ্গলবারের বিস্ফোরণে এক জার্মান কূটনীতিকেরও মৃত্যু হয়েছে। বিস্ফোরণের সময় তিনি নিজের বাড়িতেই ছিলেন। শোকপ্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ জানিয়েছেন বৈরুতের সংস্কার কাজে ফ্রান্স সবরকম সাহায্য করবে। তবে একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, দেশের সরকার বড় রকমের সংস্কার না করলে লেবানন ক্রমশ ডুবতে থাকবে।
বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছেন, রাজধানীর অধিকাংশ বাড়ি বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে বহু অফিস। সরকার এখনও পর্যন্ত জানায়নি কী ভাবে তার সংস্কার হবে। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, এই সরকার ক্ষমতায় থাকার সমস্ত অধিকার হারিয়েছে। দ্রুত ক্ষমতার পরিবর্তন দরকার।
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কারণে যত দুর্ঘটনা
লেবাননের বৈরুত বন্দরে মঙ্গলবার এক বিস্ফোরণে ১০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন৷ একটি গুদামে মজুদ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে কর্তৃপক্ষ বলছে৷ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কারণে অতীতেও দুর্ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: Getty Images/E. Schlegel
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট কী
এটি একধরনের গন্ধহীন অতি স্বচ্ছ রাসায়নিক উপাদান, যা সাধারণত সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ তবে এর সঙ্গে জ্বালানি তেল মিশিয়ে বিস্ফোরকও তৈরি করা হয়, যা নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে৷
ছবি: Imago Images/Z. Tamanna
সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে জ্বালানি তেল মিশিয়ে বোমা তৈরি করে থাকে অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী৷ ১৯৯৫ সালের ১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা শহরের এক ভবনে হামলায় ব্যবহৃত বোমা তৈরিতে দুই টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করা হয়েছিল৷ ঐ হামলায় ১৬৮ জন নিহত হয়েছিলেন৷ তালেবানও বিস্ফোরক তৈরিতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করে থাকে৷ ছবিটি ঐ বছরের ৫ মে তোলা৷
ছবি: AP
সার কারখানায় আগুন
২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি সার কারখানায় আগুন লেগে ১৫ জন প্রাণ হারান৷ আগুন লাগার কারণ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ছিল বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা৷ ইচ্ছে করেই আগুন লাগানো হয়েছিল বলেও জানান তারা৷ ছবিটি দুর্ঘটনার পরদিন তোলা৷
ছবি: Getty Images/E. Schlegel
চীনে দুর্ঘটনা
২০১৫ সালে চীনের তিয়ানজিন শহরের এক গুদামে অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটও রাখা ছিল৷ গুদামে আগুন লেগে বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ১৬৫ জন মারা যায়৷ আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল এক বিলিয়ন ডলারের বেশি৷
ছবি: Reuters/Str
লেবানন দুর্ঘটনা
মঙ্গলবার দেশটির বৈরুত বন্দরের এক গুদামে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে৷ গুদামে মজুদ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে কর্তৃপক্ষ বলছে৷ প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব জানিয়েছেন, গত ছয় বছর ধরে ওই গুদামে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত রয়েছে৷ ২০১৪ সালে একটি মালবাহী জাহাজে করে ওই রাসায়নিক এসেছিল৷ কাগজপত্রে গণ্ডগোল থাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজের জিনিস বাজেয়াপ্ত করেছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
উত্তর কোরিয়ায় দুর্ঘটনা
২০০৪ সালের ২২ এপ্রিল দেশটির এক রেলস্টেশনে জ্বালানিবাহী দুটি ট্রেনের সংঘর্ষে ১৬১ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন৷ ছবিটি দুর্ঘটনার দুই দিন পর তোলা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Kern
নিরাপদ সংরক্ষণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচণ্ড তাপ পেলে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জ্বলে উঠতে পারে৷ সেজন্য সংরক্ষণের সময় একে জ্বালানি তেল ও তাপের সূত্র থেকে দূরে রাখতে পরামর্শ দেয়া হয়৷ বিপদ কমানোর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে ক্যালসিয়াম কার্বনেট মিশিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক করেছে৷ কারণ এর ফলে ক্যালসিয়াম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট তৈরি হয়, যা একটু বেশি নিরাপদ৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Tumbelaka
যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ম কঠোর করা হয়েছে
১৯৯৫ সালে ওকলাহোমা শহরে হামলায় ব্যবহৃত বোমায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করা হয়েছিল৷ এরপর থেকে সে দেশে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সংরক্ষণে নিয়ম কঠোর করা হয়েছে৷ ফলে ৯০০ কেজির বেশি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থাকা কোনো স্থাপনা পরিদর্শনের নিয়ম করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Robayo
8 ছবি1 | 8
এ দিকে প্রশাসন জানিয়েছে এখনও পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আটক সকলেই বন্দরের কর্মী। বৃহস্পতিবারেই বন্দরের বহু কর্মীকে গৃহবন্দি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে থেকে ১৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছিল। দুই জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ১৬ জনকে আটক করে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অভিযোগ, ওই কর্মীদের অবহেলাতেই এমন ঘটনা ঘটেছে।
তবে সরকার বিরোধী আন্দোলন ক্রমশ দানা বাঁধছে লেবাননে। এক সাংসদও এই ঘটনার পরে পদত্যাগ করেছেন। দাবি করেছেন, নতুন সরকার না আসা পর্যন্ত তিনি পার্লামেন্টে যাবেন না। জর্ডনে লেবাননের রাষ্ট্রদূতও পদত্যাগ করেছেন। তিনিও জানিয়েছেন, লেবাননে ক্ষমতার পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
লেবাননে সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত বছরেই। অর্থনীতির বেহাল দশা, সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। করোনা-কালে সেই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে। করোনার মধ্যেও মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তবে বিস্ফোরণের পরে বিক্ষোভ আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।