বৈরুতে সমকামী জীবনযাপন: স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অভাব
২৬ নভেম্বর ২০২১
গত গ্রীষ্মে একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিয়েছিল বৈরুতের স্বাভাবিক জীবনযাপন৷ এরপর সবার সাথে সাথে সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনেও নানা পরিবর্তন এসেছে৷
ছবি: Getty Images/I.Chalhoub
বিজ্ঞাপন
আগস্ট মাসের সেই বিস্ফোরণ ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল লেবাননের ‘হেলেম’ কার্যালয়, যদিও সেই সংস্থার কর্মীরা অক্ষত ছিলেন৷ হেলেম নিজেদের ‘আরব বিশ্বের প্রথম এলজিবিটিকিউআইএ বা তৃতীয় লিঙ্গ ও সমকামীদের অধিকার বিষয়ক প্রথম সংগঠন’ বলে দাবি করে৷
হেলেম এর পরিচালক তারেক জেইদান বলেন, ‘‘ভাগ্যিস আমরা কেউ আহত হইনি৷ আমাদের অফিস পুরো নষ্ট হয়ে যায়৷ আমরা আমাদের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, ফাইল হারিয়ে ফেলি৷ শুধু তাই নয়, বৈরুতের ভিন্ন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের কাছে এটা একটা নিরাপদ স্থান ছিল৷ সেটা নষ্ট হয়ে গেলো৷’’
কিন্তু এর ঠিক ১৫ মাস পরেই হেলেম তার অফিস ফিরে পায়৷
সবার জন্য নিরাপদ পাড়া
হেলেমের অফিসের ঠিক পাশেই মার মিখায়েল ও গেমমায়জেহ পাড়া দু'টি, যেখানে বিস্ফোরণ ঘটে৷ এই পাড়া দু'টি বৈরুতের সব জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ, পানশালা, ক্যাফেতে সাজানো ছিল৷ এই পাড়াগুলিতে অন্যান্য পাড়ার তুলনায় বাসার ভাড়া বেশি হওয়ার কারণে কিছুটা নিরাপদও ছিল৷ ফলে, যেসব তৃতীয় লিঙ্গের বা সমকামী মানুষ রীতিমত সচ্ছল, তারাই সেখানে থাকতে পারতেন৷
বিস্ফোরণের ফলে সেই চিত্রেও পরিবর্তন এসেছে৷
বিধ্বস্ত বৈরুতে
বিস্ফোরক দ্রব্যের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ফলে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দর এক অংশ এখন ধ্বংসস্তূপ৷ ৪ বাংলাদেশিসহ অন্তত ১৩৫ জন নিহত এবং চার হাজারের বেশি মানুষ আহত হলেও ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরছে সেখানে৷ দেখুন ছবিঘরে....
ছবি: Reuters/A. Taher
বিধ্বস্ত মসজিদে
বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত এক মসজিদের কার্পেট থেকে ভাঙা কাঁচ কুড়াচ্ছেন এক জন৷
ছবি: Reuters/A. Taher
গির্জাও বিধ্বস্ত
রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণের ফলে এক গির্জার এখন এই অবস্থা৷
ছবি: Reuters/A. Taher
শহর লন্ডভন্ড
বিস্ফোরণে লন্ডভন্ড শহরের এক বিধ্বস্ত ভবনের পাশ দিয়ে মোটর সাইকেলে এগিয়ে চলেছেন দুজন৷
ছবি: Reuters/A. Tahir
বিস্ফোরণস্থল
৫ আগস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতের ঠিক এই জায়গাটায় হয়েছিল বিস্ফোরণ৷তাই ভবনগুলো যেন শুধু রডের কঙ্কাল৷
ছবি: Reuters/A. Taher
হাসপাতালের হাল
বিধ্বস্ত এক হাসপাতাল গোছানোয় ব্যস্ত কর্মীরা৷
ছবি: Reuters/M. Azakir
লড়াকু দুজন
নিজের মুদির দোকানটা প্রায় শেষ, বিস্ফোরণে নিজেও আহত৷ বৈরুতের এই নারী তবু সামান্য কিছু বেচাবিক্রির আশায় দোকান খুলে বসেছেন৷ পাশে তার স্বামী৷
ছবি: Reuters/A. Taher
এ কোন ঘর!
নিজের সাজানো গোছানো ঘরের অবস্থা দেখে এই নারী যেন বুঝতে পারছেন না কোথায় আছেন তিনি!
জেইদানের মতে, এই সচ্ছল পাড়া ছাড়াও বিস্ফোরণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শহরের অন্যান্য অঞ্চলে থাকা সমকামী জনতাও৷ যাদের বাসা এক সময় এত অভিজাত পাড়ায় না থাকলেও অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল, সেই সব বাসা ভেঙে পড়ায় তারা এখন গৃহহীন৷ অনেকে বাধ্য হয়েছেন স্বাধীন জীবনযাপন ছেড়ে আবার নিজের পরিবারের সাথে থাকতে৷ জেইদানের মতে, ‘‘অনেকে পরিবারের বা পাড়ার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া নানা ধরনের নিপীড়ন, অত্যাচার, সহিংস আচরণ ও মানসিক চাপ থেকে পালাতেই ঘর ছেড়েছিলেন৷’’
মানা জুমানার অবস্থা অনেকটা এমনই৷ বিস্ফোরণের সময় এই সমকামী নারী (নাম পরিবর্তিত) রাতে নিজের বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন৷ এখনও সেই দিনের বিষয়ে কথা বলতে গেলে তিনি চোখে অন্ধকার দেখেন৷ বিস্ফোরণের ফলে নিজের বাসা ও চাকরি হারিয়ে ফেলেন মানা জুমানা৷ আর্থিক স্বাধীনতা হারিয়ে আবার নিজের বাসায়, পরিবারের কাছে ফেরত আসেন তিনি৷ তিন বছর আগে, পরিবারের সাথে মতের মিল না হবার কারণেই ঘর ছেড়েছিলেন তিনি৷
তবে আগের চেয়ে পরিস্থিতি অনেক ভালো হয়েছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানান তিনি৷ বিস্ফোরণের পর থেকে তার জীবনযাপনের প্রতি সহনশীল হয়েছেন জুমানার মা ও বোন৷ কিন্তু এমন সৌভাগ্য হয়নি বৈরুতের সকল ভিন্ন লিঙ্গ ও যৌন পছন্দের মানুষের৷
মানসিক আঘাতের ছাপ
বৈরুতের বিস্ফোরণ এই গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে একটা অংশকে বাধ্য করেছে শহর বা দেশ ছাড়তেও৷ জেইদান এবিষয়ে বলেন, ‘‘সেখানে গিয়েও তারা শান্তিতে থাকতে পারেন না কারণ সেই সমাজেও তাদের অত্যাচারের শিকার হতে হয়৷’’
অনেকে বিস্ফোরণের পর শহরের সাথে নিজের পুরানো সম্পর্কও হারিয়ে ফেলেছেন৷ আবি হায়দার মার মিখায়েল পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত করলেও বিস্ফোরণের পর থেকে সেই পাড়ার আর পুরোনো মেজাজ অনুভব করতে পারেন না তিনি৷ শুধু তাই নয়, এক সময় যে সব বন্ধুদের সাথে মিলে ঘুরে বেড়াতেন হায়দার, সেই বন্ধুরাও দেশান্তরী হয়েছে৷
ফলে, মার মিখায়েলের আগের জৌলুস আর নেই বলেই তার মত৷ তিনি বলেন, ‘‘আগের মতো টান অনুভব করিনা৷ যে পাড়ার হাত ধরে এত সম্পর্ক হয়েছে, এত মানুষকে পেয়েছি, সেই পাড়াকে নতুন করে দাঁড় করানো সহজ নয়৷ বিশেষ করে এখন সমাজ যতটা ভঙ্গুর, তাতে তো এটা আরোই অসম্ভব৷’’
হেলেম সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী শহরের মোট সমকামী জনগণের ৮০ শতাংশই বর্তমানে বেকারত্বের সাথে লড়ছে৷ পাশাপাশি, এই গোষ্ঠীর মানুষের পক্ষে দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার সুবিধা নেওয়াও সহজ নয়৷
বিস্ফোরণ পরবর্তী বাস্তবতা, করোনা অতিমারি, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও সামাজিক অচলাবস্থা - এই সব মিলেই প্রশ্নের মুখে লেবানেনর রাজধানীর বাসিন্দা সমকামী ও ভিন্ন লিঙ্গ পরিচিতির মানুষদের৷
হায়দার তবুও স্বপ্ন দেখেন একদিন বিয়ে করে সংসার সাজানোর৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি জানি লেবাননে আমার জন্য কোনো স্থান নেই৷ আমি জানি আমাকে ভালো থাকতে হলে অন্য কোথাও যেতে হবে৷’’
রামি আল আমিন/এসএস
সমকামী বিয়ে বৈধ যে সব দেশে
এ পর্যন্ত কোন কোন দেশের জনগণ সমকামীদের মধ্যে বিয়ের পক্ষে মত দিয়েছেন বা কোন দেশে সমকামী বিয়ে বৈধতা পেয়েছে, সে তথ্যই তুলে ধরা হলো ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images/AFP/E. Becerra
নেদারল্যান্ডস
বিশ্বে সর্বপ্রথম সমকামী বিয়ে বৈধ হয় এই দেশে৷ ২০০০ সালে বৈধতা পাওয়ার পর ২০০১ সালে সমকামী বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দেশটিতে৷
ছবি: picture-alliance/DUMONT Bildarchiv/T. Linkel
কলম্বিয়া
২০১৬ সালে দেশটিতে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Rubio
আয়ারল্যান্ড
২০১৫ সালে গণভোটের মাধ্যমে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায় এই দেশে৷
ছবি: picture-alliance/empics/N. Carson
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রে সমকামী বিয়ে বৈধ হয় ২০১৫ সালে৷
ছবি: Getty Images/S. Platt
স্কটল্যান্ড
২০১৪ সালে দেশটিতে সমকামী বিয়ে বৈধ হয়৷
ছবি: Reuters/R. Cheyne
ফিনল্যান্ড
২০১৫ সালে দেশটিতে সমকামী বিয়ে বৈধ হয়৷
ছবি: dapd
লুক্সেমব্যর্গ
২০১৪ সালে এখানে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: picture-alliance/imageBROKER/J. Pigozne
গ্রিনল্যান্ড
২০১৫ সালে এখানে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: Reuters/L. Jackson
ফ্রান্স
২০১৩ সালে এখানে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: Reuters/R. Duvignau
ইংল্যান্ড, ওয়ালস
২০১৩ সালে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায় এখানে৷
ছবি: Getty Images
ব্রাজিল
২০১৩ সালে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: AFP/Getty Images
উরুগুয়ে
২০১৩ সালে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায় এখানে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. I. Mazzoni
ডেনমার্ক
২০১২ সালে এখানে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: Reuters/A. Kelly
আইসল্যান্ড
২০১০ সালে এখানে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/K. Irlmeier
পর্তুগাল
২০১০ সালে এখানে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J.M. Ribeiro
আর্জেন্টিনা
২০১০ সালে এখানে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: Imago/Agencia EFE/M. Arduin
সুইডেন
২০০৯ সালে এখানে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: picture-alliance/robertharding
নরওয়ে
২০০৮ সালে এখানে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: AFP/Getty Images/O. Morin
দক্ষিণ আফ্রিকা
২০০৬ সালে দেশটিতে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: DW
স্পেন
২০০৫ সালে এখানে সমলিঙ্গের বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিউজিল্যান্ড
২০১৩ সালে এখানে সমলিঙ্গের বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/EPA/Air New Zealand
বেলজিয়াম
২০০৩ সালে এখানে সমলিঙ্গের বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Ghirda
ক্যানাডা
২০০৫ সালে দেশটিতে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷
ছবি: Getty Images/D.Pensinger
অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ায় সমকামীদের বিয়ে বৈধতা পেয়েছে। ২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রতিনিধি পরিষদে এ-সংক্রান্ত বিল পাস হয়৷ এই প্রস্তাবের পক্ষে ১৪৬টি এবং বিপক্ষে পড়ে মাত্র ৪টি ভোট৷ এর আগে ১৫ই নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিকস বা এবিএস ঘোষণা করে যে, দেশটির জনগণ সমকামী বিয়ের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন৷ সমকামী বিয়ে বৈধতা আইনে গণভোটের পক্ষে ভোট দেন ৬১ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Khan
অস্ট্রিয়া
২০১৭ সালে দেশটির সাংবিধানিক আদালত সমকামী বিয়ের অধিকারের পক্ষে রায় দেয়৷ ২০১৯ সাল থেকে তা কার্যকর হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Bruna
জার্মানি
২০১৭ সালের ৩০শে জুন জার্মানিতে সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়৷ অর্থাৎ ইউরোপের ১৫তম দেশ হিসেবে জার্মানিতে সমকামী বিয়ে বৈধতা পেল৷ জার্মান পার্লামেন্টে এর পক্ষে ৩৯৩টি ভোট পড়ে আর বিপক্ষে পড়ে ২২৬টি ভোট৷ চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের রক্ষণশীল খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী পার্টি সমকামী বিয়ের বিপক্ষে থাকলেও, সংসদীয় নির্বাচনের ক’মাস আগে হঠাৎ করেই ম্যার্কেল ঘোষণা করেন যে, এ বিষয়ে ভোটাভুটি হবে৷
ছবি: Reuters/A. Schmidt
মাল্টা
২০১৭ সালের জুলাই মাসে মাল্টায় সমকামী বিয়ে বৈধতা পায়, যদিও এর বিরোধিতা করেছিল ক্যাথলিক চার্চ৷
ছবি: Reuters/D. Zammit Lupi
বলিভিয়া
২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধন করে সমকামী বিয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল বলিভিয়া৷ কিন্তু ২০১৬ সালে তারা ট্রান্সজেন্ডারদের নানারকম অধিকার দেয়াকে সমর্থন করে৷ দুই বছরের আইনী লড়াইয়ের পর ২০২০ সালে দেশটিতে এক সমকামী যুগল বিয়ের স্বীকৃতি পায়৷
ছবি: Reuters/D. Mercado
তাইওয়ান
২০১৯ সালের ১৭ মে এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে তাইওয়ানের সংসদ সমকামী বিয়েকে আইনগত বৈধতা দিয়ে একটি বিল পাস করে৷ ফলে সে দেশের সমকামীরা এখন তাদের বিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন৷