বৈরুত বন্দরের বহু অফিসারকে গৃহবন্দি করল প্রশাসন। দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার কথা জানিয়েছে লেবানন সরকার।
বিজ্ঞাপন
বিস্ফোরণের পর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। বৈরুতে এখনো চলছে উদ্ধার কাজ। বৈরুত প্রশাসনের দাবি, ঘটনায় অন্তত ১৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত চার হাজারেরও বেশি। তার মধ্যে বুধবার রাতে বৈরুত বন্দরের বহু অফিসারকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। কী ভাবে এই বিস্ফোরণ হলো, কাদের গাফিলতিতে এমন ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
বুধবার সকালেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব জানিয়েছিলেন দুই সপ্তাহের জন্য লেবানন জুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হবে। বুধবার রাতে বিশেষ ক্যাবিনেট বৈঠক সেরে দেশের প্রেসিডেন্ট দুই সপ্তাহ জরুরি অবস্থার কথা ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, যারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, তাদের চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হবে।
বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ
লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আহতের সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি৷ লেবাননের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এক গুদামে রাখা রাসায়নিক বিস্ফোরিত হওয়ার কারণে এই বিপর্যয়৷
ছবি: Reuters/M. Azakir
শহর জুড়ে আতঙ্ক
মঙ্গলবার বৈরুতে তখন সন্ধ্যা ৬টা৷ হঠাৎ প্রবল বিস্ফোরণে বৈরুত ও আশপাশের অনেক শহর কেঁপে ওঠে৷ কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় আকাশ৷ আতঙ্কে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকে মানুষ৷ বৈরুতের গভর্নর স্থানীয় এক টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেছেন, ‘‘আমার এই জীবনে আগে কখনো এমন বিপর্যয় দেখিনি৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Ammar
সন্ত্রাসী হামলা নয়
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব জানিয়েছেন, বৈরুত বন্দরের একটি গুদামে দুই হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ছিল৷ সেখানেই বিস্ফোরণের ঘটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এটি কোনো নাশকতামূলক ঘটনা নয়৷’’
ছবি: Reuters/M. Azakir
আহতদের তালিকায় ১৯ বাংলাদেশি
লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত শতাধিক নিহত ও চার হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে৷আহতদের মধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ১৯ জন সদস্যও রয়েছেন৷ বিস্ফোরণের সময় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস বিজয় বৈরুত বন্দরেই নোঙর করা ছিল৷
ছবি: Reuters/K. Sokhn
অগ্রহণযোগ্য
করোনা সংকটে যুদ্ধবিধ্বস্ত লেবাননের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত৷ এ পরিস্থিতিতে একটি গুদামে রাখা দুই হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে এই বিস্ফোরণ সম্পর্কে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘ কোনো রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছাড়া একটি গুদামে দুই হাজার ৭৫০ ম্যাট্রিক টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট রেখে দেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STR
উদ্ধার তৎপরতা
বিস্ফোরণের পর থেকে বৈরুত যেন অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ আর উদ্ধারকর্মীদের ছুটোছুটির শহর৷স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিলে উদ্ধার কাজে ব্যস্ত রয়েছে রেডক্রসের অন্তত ৩০টি দল৷ স্থানীয় হাসপাতালগুলো জানিয়েছে, আসনের চেয়ে রোগী অনেক বেশি হয়ে গেছে, আহতদের জন্য অনেক রক্ত দরকার৷
ছবি: Reuters/M. Azakir
প্রতিবেশী দেশেও কম্পন
বিস্ফোরণে বৈরুতের আশপাশের সব শহর তো বটেই, এমনকি ১৮০ কিলোমিটার দূরের প্রতিবেশী দেশ সাইপ্রাসও কেঁপে ওঠে৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এই ঘটনায় তারা কোনোভাবেই জড়িত নয়৷ হেজবোল্লাহও ইসরায়েলকে দায়ী করেনি৷ গত কয়েক দিন ধরে ইসরায়েল-লেবাননসিরিয়া সীমান্তে উত্তেজনা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/H. Shbaro
রাষ্ট্রীয় শোক ও জরুরি অবস্থা
ঘটনার পর বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার৷ এছাড়া দুই সপ্তাহের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণার কথাও জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
8 ছবি1 | 8
যদিও কাদের গাফিলতিতে এমন ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়ে গিয়েছে। বন্দরের যে অফিসারদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই গুদামের অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সরিয়ে নেওয়ার জন্য আদালত এবং সরকারের কাছে আবেদন করা হচ্ছিল। কিন্তু কোনো পক্ষই জবাব দেয়নি। অফিসারদের দাবি, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত গুদামের বাইরে বিশেষ নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়েছিল। কারণ তাঁরা জানতেন, এই রাসয়নিক থেকে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এত বড় বিস্ফোরণ হতে পারে, তা তাঁরা কল্পনা করতে পারেননি।
বৈরুত প্রশাসন অবশ্য জানিয়েছে, গুদামে যতটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল, ততটা রাখা হয়নি। কী ভাবে এমন ঘটল, তার তদন্ত চলছে। একই সঙ্গে চলছে উদ্ধার কাজ। কারণ, ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও বহু মানুষকে এখনও ধ্বংসাবশেষে আটকে আছেন।
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কারণে যত দুর্ঘটনা
লেবাননের বৈরুত বন্দরে মঙ্গলবার এক বিস্ফোরণে ১০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন৷ একটি গুদামে মজুদ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে কর্তৃপক্ষ বলছে৷ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কারণে অতীতেও দুর্ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: Getty Images/E. Schlegel
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট কী
এটি একধরনের গন্ধহীন অতি স্বচ্ছ রাসায়নিক উপাদান, যা সাধারণত সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ তবে এর সঙ্গে জ্বালানি তেল মিশিয়ে বিস্ফোরকও তৈরি করা হয়, যা নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে৷
ছবি: Imago Images/Z. Tamanna
সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে জ্বালানি তেল মিশিয়ে বোমা তৈরি করে থাকে অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী৷ ১৯৯৫ সালের ১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা শহরের এক ভবনে হামলায় ব্যবহৃত বোমা তৈরিতে দুই টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করা হয়েছিল৷ ঐ হামলায় ১৬৮ জন নিহত হয়েছিলেন৷ তালেবানও বিস্ফোরক তৈরিতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করে থাকে৷ ছবিটি ঐ বছরের ৫ মে তোলা৷
ছবি: AP
সার কারখানায় আগুন
২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি সার কারখানায় আগুন লেগে ১৫ জন প্রাণ হারান৷ আগুন লাগার কারণ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ছিল বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা৷ ইচ্ছে করেই আগুন লাগানো হয়েছিল বলেও জানান তারা৷ ছবিটি দুর্ঘটনার পরদিন তোলা৷
ছবি: Getty Images/E. Schlegel
চীনে দুর্ঘটনা
২০১৫ সালে চীনের তিয়ানজিন শহরের এক গুদামে অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটও রাখা ছিল৷ গুদামে আগুন লেগে বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ১৬৫ জন মারা যায়৷ আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল এক বিলিয়ন ডলারের বেশি৷
ছবি: Reuters/Str
লেবানন দুর্ঘটনা
মঙ্গলবার দেশটির বৈরুত বন্দরের এক গুদামে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে৷ গুদামে মজুদ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে কর্তৃপক্ষ বলছে৷ প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব জানিয়েছেন, গত ছয় বছর ধরে ওই গুদামে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত রয়েছে৷ ২০১৪ সালে একটি মালবাহী জাহাজে করে ওই রাসায়নিক এসেছিল৷ কাগজপত্রে গণ্ডগোল থাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজের জিনিস বাজেয়াপ্ত করেছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
উত্তর কোরিয়ায় দুর্ঘটনা
২০০৪ সালের ২২ এপ্রিল দেশটির এক রেলস্টেশনে জ্বালানিবাহী দুটি ট্রেনের সংঘর্ষে ১৬১ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন৷ ছবিটি দুর্ঘটনার দুই দিন পর তোলা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Kern
নিরাপদ সংরক্ষণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচণ্ড তাপ পেলে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জ্বলে উঠতে পারে৷ সেজন্য সংরক্ষণের সময় একে জ্বালানি তেল ও তাপের সূত্র থেকে দূরে রাখতে পরামর্শ দেয়া হয়৷ বিপদ কমানোর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে ক্যালসিয়াম কার্বনেট মিশিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক করেছে৷ কারণ এর ফলে ক্যালসিয়াম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট তৈরি হয়, যা একটু বেশি নিরাপদ৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Tumbelaka
যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ম কঠোর করা হয়েছে
১৯৯৫ সালে ওকলাহোমা শহরে হামলায় ব্যবহৃত বোমায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করা হয়েছিল৷ এরপর থেকে সে দেশে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সংরক্ষণে নিয়ম কঠোর করা হয়েছে৷ ফলে ৯০০ কেজির বেশি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থাকা কোনো স্থাপনা পরিদর্শনের নিয়ম করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Robayo
8 ছবি1 | 8
প্রশাসনের একাংশের দাবি, গত সরকারের কাছে বন্দর কর্তৃপক্ষ যে চিঠি লিখেছিলেন, তার উত্তর দেওয়া হয়নি। ফলে এই ঘটনায় তাদেরও যোগ আছে। যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের দাবি, পরমাণু বিস্ফোরণ বাদ দিলে বৈরুতের বিস্ফোরণ বিশ্বের সব চেয়ে শক্তিশালী বিস্ফোরণ। হিরোশিমায় যে পরমাণু বোমা ফেলা হয়েছিল, তার দশ ভাগের এক ভাগ তীব্র ছিল বৈরুতের বিস্ফোরণ। যা ভয়াবহ।
২০১৩ সালে মলডোভার পতাকা লাগানো একটি জাহাজ মোজাম্বিক যাওয়ার পথে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে বৈরুত বন্দরে আসে। বৈরুত বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজের কাগজপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখে তাতে বহু সমস্যা রয়েছে। ফলে জাহাজটিকে আটকানো হয়। জাহাজ সংস্থাটি পরে জাহাজটির দায় ঝেড়ে ফেলে। ফলে জাহাজে মজুত দুই হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত করার জায়গা প্রয়োজন হয়। সরকার এবং আদালতের নির্দেশে একটি গুদামে তা মজুত করেন বন্দরকর্তৃপক্ষ। গৃহবন্দি বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, দীর্ঘদিন ধরেই ওই রাসায়নিক নিলামের জন্য আবেদন জানাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু সরকার গুরুত্ব দেয়নি।