‘বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় কোনো অগ্রগতি নেই'
২৮ জুলাই ২০২৫
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন সমাজের যে স্বপ্ন দেখেছিল দেশের মানুষ, তার কোনো অগ্রগতি হয়নি, রাজনীতিতে কিছু গুণগত পরিবর্তন এলেও সেটা ক্ষণস্থায়ী - ডয়চে ভেলেকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমনটিই বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান৷
এছাড়াও তিনি কথা বলেছেন, নির্বাচন, ছাত্রদের রাজনৈতিক দল, উগ্র ডানপন্থা, মব সহিংসতাসহ নানা বিষয়ে৷
ডয়চে ভেলে: যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আমরা দেখেছি, তার বর্ষপূর্তির দ্বারে দাঁড়িয়ে আমরা৷ জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে?
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা—এটাকে একেকজন একেকভাবে ডিফাইন (সংজ্ঞায়ন) করে৷ এর যে একটা পারফেক্ট সংজ্ঞায়ন হবে, সেটা ডিটারমাইন (নির্দিষ্ট) করা খুব ডিফিকাল্ট (কঠিন)৷ একটা পার্সপ্রেক্টিভ (দিক) হচ্ছে, শেখ হাসিনার পতন হয়েছে৷ সো দ্যাট'স ইট৷ সেটাই হচ্ছে সর্বোচ্চ ইস্যু৷ সেই দিক থেকে উই হ্যাভ অ্যাচিভড এভ্রিথিং (আমরা সবকিছুই অর্জন করেছি)৷
কিন্তু গণঅভ্যুত্থান বা আপরাইজিং আমরা যেটাকে বলছি, সেটা তো আসলে শুধু শেখ হাসিনার পতনের যে আকাঙ্ক্ষা সেখানে (সীমাবদ্ধ) ছিল না৷ প্রথমত, বৈষম্যবিরোধী জায়গা থেকে এমন একটা রাষ্ট্রকাঠামো গঠন করার কথা ছিল, যেখানে অথরিটেরিয়ান (কর্তৃত্ববাদী) একটা সরকারকে আর কখনো ফেরত আসতে দেয়া হবে না, চেক অ্যান্ড ব্যালান্স (নিয়ন্ত্রণ এবং ভারসাম্য) তৈরি করা হবে৷
দ্বিতীয়ত, বৈষম্যবিরোধিতার যে মূল মন্ত্র, সিটিজেন অ্যান্ড সার্ভিস অ্যাক্সেস (নাগরিক সেবার সুযোগ)-এর জায়গা, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিশ্চিত করা৷ কারণ, বিভিন্ন সময় এর সঙ্গে সাধারণ মানুষ যে যুক্ত হয়েছেন, তারা তো এই বৈষম্যবিরোধী শব্দটার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পেরেছিলেন৷
আমি যদি এই দুটো জায়গা দেখি, তাহলে এখন পর্যন্ত আমরা সেই রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তন করে আর কখনো স্বৈরাচার আসবে না, সেক্ষেত্রে কিছুটা সফলতা পেয়েছি৷ কিন্তু জনগণের জন্য বৈষম্যহীন একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা, জনসেবা সহজলভ্য করা, জনগণের অংশগ্রহণের রাস্তাটা উন্মুক্ত রাখা, সেই জায়গাটায় আমরা আসলে কিছুই করতে পারিনি৷ এটাই আমার কাছে মনে হয়েছে, মোটা দাগে৷
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কাঠামোগত এবং গুণগত পরিবর্তন কি এসেছে?
দেখুন, ইনিশিয়ালি (প্রাথমিকভাবে) একটা কোয়ালিটেটিভ চেইঞ্জ (গুণগত পরিবর্তন) ছিল৷ আপনি যদি শুরুর দিকে দেখেন, ৫, ৭, ৮ (আগস্টের) তারিখের দিকে বা আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ওই সময়টাতেও দেখেন, দেখা যাবে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছে৷ তারা একটা কমন গ্রাউন্ডে একমত হয়েছে৷ সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে৷ সুতরাং, এটা একটা বড় কোয়ালিটেটিভ চেইঞ্জ (গুণগত পরিবর্তন)৷ কারণ, আমরা যদি ইতিহাসের দিকে দেখি, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কনফ্রন্টেশনাল পলিটিক্যাল কালচার (দ্বান্দ্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি) ছিল৷ সেই সংস্কৃতিতে সরকারি দল, বিরোধী দল বা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কখনো কোনো অবস্থাতে ঐকমত্য হয়নি৷
যেটা হয়েছে, শেখ হাসিনার পতনটা, যেহেতু একজন কমন এনিমি (অভিন্ন শত্রু)-র বিরুদ্ধে সবাই এক জায়গায় এসে লড়ছেন, সেই জায়গায় তাদের মধ্যে একটা ঐকমত্য তৈরি করেছিল৷ পরবর্তীতে আমরা যত বেশি সংস্কারের আলোচনায় ঢুকেছি, যখন আমরা নির্বাচন নিয়ে কী হবে, কবে হবে—এসব নিয়ে কথা বলেছি, একটা পর্যায়ে গিয়ে নির্বাচন বনাম সংস্কার—এই বিতর্কগুলোতে ঢুকেছি, তখন এই ঐক্যের জায়গাগুলোতে ফাটল ধরা শুরু হয়েছে৷ এটা খুব স্বাভাবিক৷ কারণ, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিজস্ব ইন্টারেস্ট (স্বার্থ) অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করেছে৷ এখন পর্যন্ত পজিটিভ চেইঞ্জ যদি বলেন, তাহলে আপনি ওটুকুই দেখবেন৷
পলিটিক্যাল সায়েন্সে আমরা যেটাকে ‘ন্যাস্টি পলিটিক্স' বলি, সেই পলিটিক্সে আমাদের যাত্রাটা শুরু হয়ে গেছে৷ কিন্তু এখনো রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের সঙ্গে বসছে, পরস্পরের সঙ্গে কথা-বার্তা বলছে, এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ডাক দিলে তারা বসছেন—এইটুকু পজিটিভ চেইঞ্জ৷
কিন্তু এটা আসলে কতটা সাসটেইনঅ্যাবল (টেকসই বা স্থায়ী) হবে, আজকে থেকে চার মাস, ছয় মাস, সাত মাস বা নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে, এটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে৷ তারপরও যদি বলেন পজিটিভ চেইঞ্জ, তাহলে এটুকুই, কিন্তু সেটাকে আমার কাছে এখনো ক্ষণস্থায়ী মনে হচ্ছে৷
জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা যে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, তা নিয়ে কতটা আশাবাদী আপনি?
যখন রাজনৈতিক দলটি তৈরি হয়েছে, আমি সত্যিই খুব আশাবাদী ছিলাম৷ আমারঅনেক উচ্চ প্রত্যাশা ছিল৷ এর অনেকগুলো কারণ আছে৷ আপনি যখন আমাদের পলিটিক্যাল স্পেকট্রাম-এর দিকে তাকান, তখন দেখা যায় লিবারেল (উদার), কনজারভেটিভ (রক্ষণশীল), লেফট-রাইট (বাম-ডান) যেভাবে ভাগ করি, সেখানে লেফট সাইডটা কমপ্লিটলি এম্পটি (সম্পূর্ণ ফাঁকা)৷
বিএনপি নিজেকে কখনও লেফট বা সেন্টার-লেফট দাবি করেনি৷ তারা সেন্টার-রাইট বা সেন্ট্রিস্ট পার্টি - এরকম দেখানোর চেষ্টা করেছে৷ অন্যদিকে, রাইটে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে৷ অনেকগুলো রাজনৈতিক দলের মধ্যে আমরা দেখছি পলিটিক্যাল স্পেস দখল করার চেষ্টা শুরু হয়েছে৷ সেই জায়গায় এসে আমাদের একটা সেনসিবল বিরোধী দল দরকার, যে দলটি একটা সেন্ট্রিস্ট পজিশন নিলে বিএনপি হয়তো সেন্টার থেকে খানিকটা বামে সরতে বাধ্য হবে৷
ওই রাজনৈতিক দলটি (এনসিপি) যদি অন্তত নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে একটু লিবারেল পজিশন নেয়, তাহলে সে একটা নতুন ধরনের ডিসকোর্স রাজনীতিতে নিয়ে আসতে পারবে, যা আমাদের ভবিষ্যতের নীতি নির্ধারণসহ সবক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা রাখবে৷ যখন নতুন রাজনৈতিক দলটা গঠিত হয়, তখন তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটা হচ্ছে, দে উইল বি এ সেন্ট্রিস্ট পার্টি (তারা মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল হবে)৷ তাই আমি আশাবাদী হয়েছিলাম৷
কিন্তু, তারা আজ পর্যন্ত এটাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করেনি৷ রাজনীতিতে সেন্ট্রিজম বা মধ্যপন্থা বলতে—আসলে উনারা কি বুঝাতে চাচ্ছেন, এইটার কোনো ক্লিয়ার গাইডলাইন (পরিষ্কার ধারণা) আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি৷ পার্টির একটা আইডিওলজিকাল পজিশন (আদর্শিক অবস্থান) থাকবে৷ নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে আমার পজিশনটা কী? সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারব কিনা? রাষ্ট্রের একজন নাগরিক তার ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, এথনিসিটি যে পরিচয় থাকুক না কেন, রাষ্ট্র তার কিছু বেসিক রাইটস বা মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে কিনা৷ তার বেঁচে থাকার অধিকার, তার মত প্রকাশের অধিকার, তার বিভিন্ন সার্ভিস অ্যাক্সেস করার অধিকার—এই ন্যূনতম জায়গাগুলো রাষ্ট্র করবে কিনা—এই প্রশ্নগুলোর কোনো সুস্পষ্ট উত্তর আমরা কিন্তু এই নতুন রাজনৈতিক দলটির কাছ থেকে পাইনি৷
কীভাবে মূল্যায়ন করবেন এনসিপিকে?
এই রাজনৈতিক দলটার ক্ষেত্রে আমরা যেটা দেখেছি, তাদের অনেক ক্ষেত্রেই একটু ডানপন্থি অবস্থানে বেশি আগ্রহী মনে হয়েছে৷ এটা একটা কনসার্নের (উদ্বেগ) জায়গা আমার কাছে৷ আরেকটা হচ্ছে, দলটা গঠন হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে বা ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে৷ তাদের প্রধান কাজ ছিল মানুষের কাছে যাওয়া৷ আমার মনে হয়েছে, সেটা শুরু করতে একটু দেরি হয়ে গেছে৷ কারণ, আমি যদি আমার বয়ানটা তৈরি করতে চাই, আমি যদি আমার ন্যারেটিভটা তৈরি করতে চাই, তাহলে তো আমি যদি বলি যে আমি এই গণঅভ্যুত্থান থেকে উদ্ভূত দল, তাহলে তো এই গণঅভ্যুত্থানের কাছে মানুষের প্রত্যাশা কী ছিল সেটা তো মানুষের কাছে যেয়ে বোঝার দরকার ছিল৷ রাষ্ট্র সংস্কার বলতে মানুষ কী বুঝে, সেটা তাদের বোঝা দরকার ছিল৷ এখন তারা পদযাত্রা শুরু করেছেন, এটা আরো আগে শুরু করা দরকার ছিল৷
আমি এবার একটু সামারাইজ করি: তাদের আদর্শিক অবস্থানটা পরিষ্কার হয়নি৷ নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলটি কেমন যেন একটা পপুলিস্ট ডিসিশান (জনতুষ্টি প্রভাবিত সিদ্ধান্ত) নিচ্ছে৷ এটা আমার কাছে খুব বড় বিষয়৷ কারণ, আপনি যদি রাজনীতি করতে চান, আপনি অভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা দল, আপনি যেন-তেন রাজনৈতিক দল না, তাহলে আপনাকে তো বোল্ড স্ট্যান্স (সাহসী অবস্থান) নিতে হবে, অধিকারের জায়গাগুলোতে৷ এই বোল্ড স্ট্যান্স নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি পপুলিস্ট ডিসিশান দিয়ে প্রভাববিত হয় তারা৷ যে জনগোষ্ঠীকে তারা মনে করে তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তারা আসলে কী মনে করছে সেটার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তারা৷ কিন্তু ব্যাপারটা হওয়া উচিত ছিল অন্যরকম৷
আমি মনে করি, এনসিপি শুড ফরগেট অ্যাবাউট হোয়াট উইল হ্যাপেন ইন দ্য ইলেকশন৷ এই নির্বাচনে এনসিপি কয়টা আসন জিতবে, সেটা নিয়ে তাদের বিচলিত হওয়া উচিত হবে না৷ তার রাজনীতি যদি করতে হয়, একটা নির্বাচন দিয়ে তার আসলে কিছু হবে না৷ তার যেটার উপর জোর দেয়া উচিত, এই নির্বাচনের আগে আমি আমার পজিশনটা তৈরি করতে পারছি কিনা, মানুষকে বোঝাতে পারছি কিনা৷ একটা রাজনৈতিক দল দাঁড় করানো একটা লম্বা সময়ের ব্যাপার৷
নির্বাচন কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা, আমি কাকে কোথায় প্রার্থী মনোনয়ন দিলাম, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার প্রতি মানুষের যে প্রত্যাশাটা ছিল, সেটার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সেভাবে বক্তব্য দেয়া৷ এটা যদি আনপপুলার ওপিনিয়ন (অজনপ্রিয় মতামত) হয়, হোক আনপপুলার৷ সেটা তাকে করতে হবে৷ কারণ, দলটি গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশাকে প্রতিনিধিত্ব করে৷ এতে যদি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে আনপপুলার হয়, তাকে সেই আনপপুলার অবস্থান নিতে হবে৷ এতে যদি ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের জন্যও ক্ষতিকর হয়, তাকে সেই আনপপুলার বক্তব্যটা দিতে হবে৷ কারণ দায়িত্ব হচ্ছে, প্রত্যেকটা জিনিস চেকের মধ্যে রাখা৷ কারণ, এই রাষ্ট্রকাঠামোই তো আপনি চাচ্ছেন৷ তাহলে তার সঙ্গে মিল রেখে আপনাকে বক্তব্য দিতে হবে৷
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আপনি কি সংসদ নির্বাচন দেখতে পান?
এখন পর্যন্ত আমি যা দেখছি তাতে আমার কিছু শঙ্কা আছে৷ কিন্তু মোটা দাগে আমার মনে হয় ইলেকশন ফেব্রুয়ারিতে হওয়াটাই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা৷ কেন? আমি বলছি৷ তারেক রহমানের সঙ্গে ডক্টর ইউনূসের যখন একটা মিটিং হলো, সেখানে যখন ফেব্রুয়ারির টাইমটা আসলো এবং মোর অর লেস (কমবেশি) আমরা জানি যে উনারা দু'জনই মোটামুটি একটা ঐকমত্যে এসে পৌঁছেছেন যে, ফেব্রুয়ারিতে৷ তো এখন যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটা থেকে পিছিয়ে আসতে চায়, তাহলে তাকে একটা শক্ত লজিক (যুক্তি বা কারণ দাঁড় করাতে হবে) দিতে হবে৷ সেই শক্ত লজিক কী হবে, এটা এখন পর্যন্ত আমার কাছে পরিষ্কার না৷
কিন্তু এক ধরনের আস্থার জায়গা তৈরি হওয়ার পরও তা নিয়ে বিএনপির সংশয় কাটেনি৷ অন্য যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, তাদের মধ্যেও এটা নিয়ে আমরা সংশয় দেখছি৷ এর কারণ আসলে কী? অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দেয়ার পরও কেন রাজনৈতিক দলগুলো আস্থা রাখতে পারছে না?
এখানে কয়েকটা ব্যাপার আছে৷ আমার মনে হয়, রিসেন্ট যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, গোপালগঞ্জের ঘটনাই বলেন বা মাইলস্টোনের ট্র্যাজেডির পরে যেই উদ্ভূত পরিস্থিতি সেটার কথাই বলেন, সেখানে গভর্নমেন্ট আসলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সেটা নিয়ে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে৷
নির্বাচন পেছানোর অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আছে৷ একটা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি৷ যদি না পারে, তাহলে আমরা যে কনফ্রন্টেশনাল পলিটিক্সের কথা বলছিলাম, এখনও যে তারা একসঙ্গে কথা-বার্তা বলছেন, সেই জায়গা থেকে সরে এসে, তারা আবারো কনফ্রন্টেশনে যাবেন কিনা, সেটা একটা সমস্যা৷ তারপর যখন প্রার্থী যাচাই-বাছাই শুরু হবে, তখন সেটা নিয়ে দলগুলোর ভেতরে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তৈরি হতে পারে. সেখান থেকে ভায়োলেন্স তৈরি হতে পারে, সেটাও একটা সমস্যা৷ দলগুলো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভায়োলেন্সে জড়িয়ে পড়তে পারে, সেটাও একটা সমস্যা৷ পুলিশ প্রশাসনের অবস্থা গত ১০ মাসেও খুব একটা যে সঠিকভাবে আমরা সংস্কার করতে পেরেছি, সেটাও বলা যাচ্ছে না৷ আমাদের অনেক বেশি সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করতে হবে৷ ফলে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ এখানে আছে৷
এই এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? কতটা আশা দেখছেন, আর হতাশা কতোটা?
আশা তো অনেক দেখেছিলাম, এখন অনেকটা হতাশাই কাজ করছে৷ দেখুন, যদি ভালো দিকগুলো বলি, তাহলে ওইসময়ে, ওই বাস্তবতায় ডক্টর ইউনুস ছাড়া আমাদের যোগ্য কোনো লোক ছিলেন না৷ কারণ, তিনি সবার কাছে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি৷
হতাশার জায়গটা হলো, যখন দেখেন আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ হচ্ছে তখন সরকারকে ডিসাইসিভ অ্যাকশন (নিষ্পত্তিমূলক পদক্ষেপ) নিতে হয়৷ শুরু থেকেই সরকারকে আমরা বায়াস (পক্ষপাতমূলক) দেখেছি৷ মব ভায়োলেন্স দেখেছি৷
দেখুন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতায় এরকম ফ্রিঞ্জ (প্রান্তিক) গ্রুপের উত্থান খুব স্বাভাবিক৷ যে গ্রুপগুলো গত ১৪-১৫ বছর নিজেদেরকে বঞ্চিত মনে করেন, তারা যখন হঠাৎ করে দেখেন যে তারা আসলে এখন বেশ সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে আসতে পারছেন, তাদের একটা গ্রুপ সেটার অতিব্যবহার করার চেষ্টা করে৷ এটা খুব স্বাভাবিক৷ এটা সব দেশে, সবসময়ই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে আমরা এটা দেখেছি৷ যখন এটা মাত্রা অতিরিক্ত করে, যখন আপনার স্বাধীনতার প্রকাশ আরেকজনের স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, আপনি যখন জোর করে আইনি সীমা লঙ্ঘন করে কোনো একটা কিছু পেতে চান, তখন এটা সরকারের রেসপন্সিবিলিটি (দায়িত্ব), সেখানে কড়া বার্তা দেওয়া, দিস ইজ সমথিং দ্যাট উইল নট বি টলারেটেড (এটা এমন বিষয় যা কোনো অবস্থাতে বরদাস্ত করা হবে না)৷
এই ক্ষেত্রে সরকারকে আমরা খুবই দোদুল্যমান অবস্থায় দেখেছি৷ সরকার এই ক্ষেত্রে অনেক সময়ই এই পদক্ষেপটি সরাসরি নিতে পারেনি৷ এটা হচ্ছে আমার একটা হতাশার জায়গা৷
দ্বিতীয়ত, আপনি প্রশাসন দেখুন, পুলিশ দেখুন৷ এই প্রত্যেকটা জায়গার ক্ষেত্রে সরকার বারবার বলছে যে আমরা খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় পেয়েছি৷ কিন্তু দশ মাসে সরকার দৃশ্যমান কী পরিবর্তনটা প্রশাসনে বা পুলিশের মধ্যে আনতে পেরেছে, যাতে মানুষের সামান্য মাত্রায় হলেও তার প্রতি একটা ভরসার জায়গা তৈরি হবে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা তেমন কিছুই দেখতে পাইনি৷
আমরা যেটা দেখেছি, আমলাতন্ত্রকে যখন সাজানোর কথা বলা হয়েছে, তখন সরকার কোনো ডিসাইসিভ অ্যাকশন নিতে পারেনি৷ সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে ছেড়ে দিচ্ছে৷ অনেক সময় রাজনৈতিক লয়্যালিটি বেজ (আনুগত্যের ভিত্তিতে) করে তারা নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছে৷
আপনি হাজার হাজার মানুষের নামে মামলা দিচ্ছেন, তাদেরকে গ্রেপ্তার করছেন৷ এখানে শুধু অপরাধী না, নিরপরাধ মানুষও এইটার ফাঁদে পড়ে জেল খাটছেন৷ এটা তো অধিকার ভঙ্গ করা৷ একইসঙ্গে যে অপরাধী, তারও তো বিচার পাবার অধিকার আছে৷ এই অন্তর্বর্তী সরকারকে আপনি নিশ্চয়ই আশা করেন না তারা দলীয় সরকারের মতো আচার-আচরণ করবে৷ আপনি নিশ্চয়ই আশা করেন, সে একটা উদাহরণ তৈরি করে দিয়ে যাবে, যা দেখে বাকি দলগুলো কাজ করবে৷ এই ক্ষেত্রে কোন প্রক্রিয়াটা আপনি ফলো করছেন? কোন আইনি প্রক্রিয়াটি আপনি ফলো করছেন? কোন অ্যাডমিন্সট্রেটিভ প্রসেসটা আপনি ফলো করছেন? সেই জিনিসপত্রগুলোও তো গুরুত্বপূর্ণ৷ সেইটার সবচেয়ে বড় টেস্ট আমরা গোপালগঞ্জে দেখেছি৷
গোপালগঞ্জে যে ঘটনাটা ঘটেছে, যে অভিযোগগুলো এসেছে, তা নিয়ে সরকারের কাছ থেকে খুব খুব পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা তো আমরা পাচ্ছি না৷ যে অপরাধী হবে তারও অধিকার আছে, সেই অধিকার রক্ষায় আপনি কী করেছেন? আপনি তো এটা বলতে পারবেন, ওদের কোনো অধিকারের দরকার নেই৷
সেখানে নিরাপরাধ সাধারণ মানুষ যারা ছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান কী ছিল? তাদের অধিকার আপনি কীভাবে রক্ষা করেছেন? এরকম প্রতিটি ইস্যুতে দেখবেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা পরিষ্কার কোনো উত্তর পাই না৷
মব ভায়োলেন্সের কথা আমরা বলছিলাম৷ সেই ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়, জাতিগত পরিচয়ের মানুষেরা আছেন, তাদের অধিকার হরণের কথা আমরা জেনেছি৷ এসব ক্ষেত্রে সরকার অনেক সময় গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি তা শুধু নয়, আমরা অনেক সময় মব আর প্রেশার গ্রুপের যে পার্থক্য সেটাকে গুলিয়ে ফেলার মতো প্রবণতাও আমরা দেখেছি৷
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ এই সরকারে লেজিটিমেসি (বৈধতা) আসছে কোথা থেকে? আপনি যত বেশি মানুষজনকে তার নিরাপত্তার সেন্স বাড়াতে পারবেন, যত বেশি আপনি সেবা দিতে পারবেন তত বেশি আপনার লেজিটিমেসি বাড়বে, তত বেশি হচ্ছে আপনি সংস্কার এবং অন্যান্য কাজে জোর দিতে পারবেন৷
এই এক বছরে ‘মবের মুল্লুক', ‘মবের সংস্কৃতি', ‘মবোক্রেসি'-এর মতো অনেকগুলো শব্দ ঘুরে ফিরে বারবার উচ্চারিত হয়েছে? তবে কি মব অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে? মোরাল পুলিশিং, মাজার ভাঙা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ, মব সহিংসতা ও রাস্তায় নারী নিপীড়নের মতো ঘটনার বিষয়ে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এই গ্রুপ বা যারা এই ধরনের মন মানসিকতা লালন করেন, তারা আমাদের সমাজে ছিলেন৷ এটা আগে থেকেই ছিলেন৷ আমরা হঠাৎ করে, নতুন করে তাদেরকে আবিষ্কার করিনি৷ যেটা হয়েছে, আগে একটা তীব্র অপ্রেশনের মধ্যে তারাও ছিলেন৷ ফলে, যখন নতুন একটা রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তখন এই গ্রুপের অনেকেই মনে করেছেন যে এটার একটা সুযোগ আমরা নিতে পারি৷ আর যেটা বললাম একটু আগে যে, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সব জায়গায় অনেক সময় বলা যায়, দিস ইজ দা টাইম অব দ্য মনস্টার৷ এই সময়, ইউ উইল সি আ লট অব মনস্টার্স গ্রোয়িং আপ অ্যান্ড গেট ইনটু দ্য থিংস৷ এটা স্বাভাবিক৷ প্রশ্নটা হচ্ছে যে, আপনি এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন কিনা৷
সরকারকে একটু বেনিফিট অব ডাউট দিই, শুরুতে সরকারের দুটো সমস্যা ছিল৷ একটা সমস্যা হচ্ছে, সরকার আসলে খুব বেশি বল প্রয়োগ করতে ইতস্তত করতো৷ কারণ, সবসময় ভয় পেত যে বল প্রয়োগ করলে সেটা মানুষকে আগের শাসনামলের কথা মনে করিয়ে দেয় কিনা৷ দ্বিতীয়ত, পুলিশ তখনও প্রস্তুত না, সেটাও একটা দুর্বলতা ছিল৷
কিন্তু আপনি দেখুন, মাজার ভাঙ্গার কথা বলেন, নারীদের প্রতি নিপীড়নের কথা বলেন, মোরাল পুলিশিংয়ের কথা বলেন, এগুলো ধাপে ধাপে বেড়েছে৷ এই সরকারের মুখপাত্ররা বারবার বলার চেষ্টা করছেন যে এটা একটা খুবই প্রগ্রেসিভ সরকার৷ তাহলে প্রগ্রেসিভ সরকার যদি হয় তাহলে প্রগ্রেসিভিজম তো তার বক্তব্য বা সে মুখে কী বলতেছে সেটার উপর নির্ভর করে না৷ সে কী কাজটা করছে, তারওপর নির্ভর করে৷
ঘটনা ঘটার পর আপনি বলছেন যে এই অ্যাকশনটা নিয়েছি৷ সমস্যা হচ্ছে, আপনি কী অ্যাকশন নিচ্ছেন যেটা কোনো ডিটারেন্স (প্রতিরোধ) তৈরি করছে না৷ ওই গ্রুপের বাকি সদস্যের মধ্যে কোনো রকম ভয় তৈরি করছে না যে, সরকার আছে, সরকার এটা শক্ত হাতে দমন করবে৷
সরকারকে মবকে চিহ্নিত করতেও চাচ্ছে না৷ একটা ক্লিয়ার ইন্ডিকেশন বা বক্তব্য আমরা সরকারের কাছ থেকে পাইনি৷ আমার অ্যাকশন আপনার অপছন্দ হতে পারে৷ সেটার প্রতিবাদ করার রাইট আপনার আছে৷ আপনি জনসভা করতে পারেন, আপনি মানববন্ধন করতে পারেন৷ যেটা আপনি করতে পারেন না, সেটা হচ্ছে আরেকজন নাগরিকের অধিকারে আপনি হস্তক্ষেপ করতে পারেন না৷ এই কঠিন বার্তাটা খুব সুস্পষ্টভাবে সরকার তার বক্তব্যে, তার কাজে কী দেখাতে পেরেছে?
সরকার সংস্কার কতটা করতে পেরেছে?
এক্ষেত্রে সরকারে সদিচ্ছা নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই৷ সরকার জেনুইনলি চেয়েছে৷ আমি সংস্কারের ব্যাপারটাকে দুইটা ভাগে ভাগ করি৷ একটা হচ্ছে যেটা সাংবিধানিক সংস্কার৷ আমরা যেটা বলি রাষ্ট্রের রুলস অব দ্যা গেম৷ সেটা চেঞ্জ করার জন্য যেটা লাগবে তার জন্য আপনারা আলাপ-আলোচনা করার দরকার আছে৷ অন দ্য আদার হ্যান্ড, দেয়ার আর সাম বেসিক থিংস৷ সেটাকে অধ্যাদেশ দিয়েই আপনি করতে পারেন৷ আপনি দুদকের ক্ষমতা বাড়াতে চান? আপনি পলিটিসাইজেশন অব ব্যুরোক্রেসি বন্ধ করতে চান? আপনি পুলিশের মধ্যে একটা জবাবদিহিতার কাঠামো তৈরি করতে চান? এসবের জন্য সংবিধান সংস্কারের অপেক্ষা করা লাগে না৷ এগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে, আপনার অ্যাক্টিভিটিজের মাধ্যমে আপনি দেখাতে পারেন৷
আমি সবার প্রতি সম্মান রেখে বলতে চাই, সরকারে সদিচ্ছা থাকলেও এই প্রক্রিয়াটি কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে তাদের বোঝাশোনা ঘাটতি রয়েছে৷ আমার যদি খুব বড় পরিকল্পনা থাকে, তার মধ্যে কোনটি আসলে বাস্তবায়নযোগ্য, কোনটি সম্ভবপর, কোনটি এই মুহূর্তেই করতে পারবো, কোনটির জন্য অনেক কিছু চিন্তা করতে হবে—এই জায়গাগুলো কিন্তু চিহ্নিত করা সরকারের উচিত ছিল৷ এখন সরকার কিছু কিছু কাজ করছে৷ কিন্তু এইটা আসলে শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াবে?
কারণ, যে কাজটা আপনার করা উচিত ছিল দুই/তিন মাসের মাথায়, সেই কাজটা আপনি যখন দশ মাসের মাথায় করেন, তখন আপনার ভেতরকার শক্তির আবারও সংকুচিত হয়৷ আমি একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করি৷ ধরেন, আমরা এখন বারবার শুনছি, প্রশাসন থেকে আমি এই সহযোগিতা পাচ্ছি না৷ সত্য, সরকার পাচ্ছে না৷ কিন্তু দেখেন, যেকোনো ধরনের পরিবর্তন আনতে হলে, রাজনৈতিক পরিবর্তন হলে আমলাতন্ত্র তখন খুব ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে৷ আপনি যদি কোনো পরিবর্তন চান, তাহলে সেই পরিবর্তন করার সবচাইতে উপযুক্ত সময় হচ্ছে সেই প্রথম এক/দুই মাস৷ কারণ, তখন আমলাতন্ত্র প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে না৷ ফলে, আমলাতন্ত্র পরিবর্তনটা গ্রহণ করে৷
আমলাতন্ত্র যেটা করে, সেটা হচ্ছে সে তার ভঙ্গুর অবস্থা দ্রুত কাটিয়ে উঠে৷ ফলে শাসনযন্ত্রের উপর সে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে৷ তখন যদি আপনি বলেন যে সংস্কার করব, তখন আমলাতন্ত্র যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে, তা আপনি আর সামাল দিতে পারবেন না৷ ফলে এটা ইচ্ছা-অনিচ্ছের প্রশ্ন না, এটা প্রক্রিয়াটা বোঝার প্রশ্ন৷ এই প্রক্রিয়া বোঝার ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে একটা সমস্যা আছে৷
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, জনগণের অংশগ্রহণ৷ মানুষ সংস্কার চায়৷ কিন্তু মানুষ তার নিজের ভাষায় চায়৷ মানুষ হয়তো ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংখ্যানুপাতিক' শব্দ বোঝে না, কিন্তু মানুষ বোঝে একই দল যদি এত ক্ষমতাশালী হয়ে যায়, তাহলে আমরা দেখেছি গত ১৪/১৫ বছরে কী হয়েছে৷ ফলে সেটার একটা পরিবর্তন দরকার৷ তার সঙ্গে যদি কথা বলেন, তাহলে তাদের থেকে আইডিয়া পাওয়া যাবে৷মানুষের অংশীদারত্ব, সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা—এ ধরনের কোনো কিছু এই সরকার করেনি৷ পুরো বিষয়টা একদল এলিটের হাতে কুক্ষিগত একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ যার ফলে আমরা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পারছি না৷ ফলে হতাশা আসছে যে আমরা করতে পারছি না৷
ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও ডানপন্থার উত্থান দেখা যাচ্ছে৷ সেটা কি বৈশ্বিক পরম্পরা? নাকি অন্য কোনো কারণ? সমাধানের পথ কী?
উগ্রপন্থার প্রকারভেদ একেক দেশে একেক রকম৷ কোথাও সেটা অভিবাসন কেন্দ্রিক, কোথাও সেটা বর্ণকেন্দ্রিক, কোথাও সেটা ইসলামোফোবিয়া বা কোথাও হয়তো অন্য কারণে হচ্ছে৷ কিন্তু আমাদের দেশের উগ্র ডানপন্থা নিয়ে কথা বলতে হলে, সেটা বুঝতে হবে৷ বিগত সরকার গত ১৬ বছরে দুটো ভয়াবহ কাজ করেছে৷ সমাজের নিজস্ব একটা প্রক্রিয়া থাকে, যেকোনো ধরনের কনফ্লিক্ট রিজলভ করার৷ কখনও সমাজের কিছু নিয়ম-নীতি আছে, সেগুলোর মাধ্যমে করে৷ কখনো কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন ক্লাব, ফ্যামিলির মাধ্যমে করা হয়৷ কিন্তু গত ১৪/১৫ বছরে এগুলোকে দলীয়করণ করা হয়েছে৷ কনফ্লিক্ট দূর করার যে কাঠামো সেগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে৷
বাংলাদেশে যারা উগ্র ডানপন্থি, তাদেরকে কখনোই সমাজের পলিটিক্যাল ডিসকোর্সে যুক্ত করার বা স্থান দেয়ার কোনো ধরনের কোনো চেষ্টা করা হয়নি৷ তাদের সব সময় আলাদা করে রাখা হয়েছে৷ লিবালের সেক্যুলাররা এটা করেছেন, এ দায় তাদের নিতে হবে৷ বিগত সরকারও এটা করেছে৷ কারণ, তার শুধু তাদেরকে ব্যবহার করার দরকার ছিল৷ সেই ব্যবহারটুকু করেছে৷ কওমি জননী টাইটেল নিয়েছে৷ কিন্তু তাদেরকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বা রাজনৈতিক বয়ানে যুক্ত করার সুযোগটি কখনো দেয়া হয়নি৷
আমাদের এখানে উগ্র ডানপন্থি যারা আছেন, তারাও একটা সময় পর্যন্ত নিজেদের ইনভিজিবল মনে করেছেন৷ তারা ভেবেছেন, রাষ্ট্র তাদের দেখছে না, তাদের কথা চিন্তা করছে না, তাদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে না৷ আবার হঠাৎ করে কিছু সুযোগ-সুবিধা তাদের দেয়া হলেও সেটা ব্যবহারের জন্য তারা ঠিক প্রস্তুত নন৷
কিন্তু এটা যে একটা সিভিল ডিসকাশনের ব্যাপার, সিভিল ডিসকোর্সের ব্যাপার, সেই বোঝাপড়াটা বাড়াতে হবে৷ এ কারণে সোশ্যাল ফোর্স গড়ে তুলতে হবে, যাতে বিভিন্ন মানুষ তার বিভিন্ন মতামত নিয়ে আসলেও পরষ্পরের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ থাকে৷ একে অপরকে বোঝার চেষ্টা থাকে৷ তাহলে আমি উগ্রপন্থার বিকাশ দেখি না৷
উগ্র পন্থা ডানদিকেও হতে পারে, বামদিকেও হতে পারে৷ কিন্তু এটা হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে একটা গ্রুপ যখন ফিল করে তারা এলিয়েনেটড (বিচ্ছিন্ন)৷ আপনি যদি এখন কাউকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলে এলিয়েনেটেড করে রাখেন, অ্যাগেইন আপনি আদারিং করছেন৷ কেউ দোষী হলে অবশ্যই তার শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে৷ কিন্তু এলিয়েনেটেড করা মানে তাকে আপনি ঠেলে দিচ্ছেন উগ্রপন্থার দিকে৷ এই অংশটি যখন মনে করবে আমি আইনি প্রক্রিয়ায় কিছু করতে পারব না, উগ্রভাবে কাজ করলেই আমি অনেক কিছু করতে পারব, তখনই সে উগ্রপন্থার দিকে যাবে৷ সেটা আমাদের থামাতে হবে৷
ফলে একদিকে রাষ্ট্রের শক্ত ভূমিকা, আবার সেটাকে কমপ্লিমেন্ট করার জন্য সোশ্যাল ফোর্স গড়ে তোলা, যারা সামাজিক প্রক্রিয়া জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে৷ এই দুটি উপায় আমাদের একইসঙ্গে নিতে হবে৷