নিয়ত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সাথে সমকালে তুলনামূলক অবস্থা বিবেচনায় বৈষম্য সংজ্ঞায়িত হয়৷ এই বৈষম্য আবার ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েই তবে বিলোপ কিংবা সংরক্ষণের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়৷
তবে সহজ কথায় বলা যায়, যে সমাজে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যায় না, সেই সমাজে বৈষম্য কেবল অবশ্যম্ভাবীই নয়, সবসময় তাকে অযৌক্তিকও বলা যায় না৷
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের আবির্ভাব ছিলো চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্য বিলোপের দাবি নিয়ে৷ পরবর্তীতে সেটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকল রকম বৈষম্য বিলোপের দাবিতে একীভূত হয়, এবং এক দফা সরকার পতনের আন্দোলনে পর্যবসিত হয়৷
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, রাষ্ট্রই সরকার, সরকারই রাষ্ট্র৷ সমাজ এই রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু হতে পারে না৷ কিন্তু সমাজ যখন রাষ্ট্র এবং সরকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক রাষ্ট্র বা সরকার হতে পারে না৷ দুয়ের মাঝে বিস্তর দূরত্ব তৈরি হয়৷ এই দুয়ের দূরত্ব আবার একদিনে নয়, বছরের পর বছর ধরে তৈরি হয়৷ সাধারণ মানুষের সাধারণ আর্জি জানানোর পথ রুদ্ধ হয়৷ মানুষ হাঁসফাঁস করে, মুক্তির উপায় খোঁজে৷
কেউ একক কিংবা দলীয় যেভাবেই হোকনা কেন সেই দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তির আহবান কিংবা কর্মপন্থা নিয়ে আসে, সাধারণ মানুষ আশায় বুক বেধে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ প্রয়োজনে জীবন দিতেও দ্বিধা করে না৷ রাজনৈতিক বিশ্বাস কিংবা আদর্শঅনেক সময় বৃহত্তর জাতীয় প্রয়োজনে গৌণ হয়ে পড়ে৷
সাধারণ মানুষ এতোই সাধারণ, এতোই নিষ্পাপ তাদের বিশ্বাস, গত সোমবার বাস থামিয়ে যখন চাঁদা ওঠাচ্ছিল ট্রাফিক পুলিশ, ষাটোর্ধ এক নারী বিস্ময়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করছিলো, ‘‘এখনো চাঁদা তুলে? এখনো গাড়ি আটকায়? ওমা লাভ হলো কী?''
এই যে লাভ হলো কী, এটাই এখন মুখে মুখে প্রশ্ন৷ এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর স্বপ্ন দেখেছিলো৷ ফলে বাধভাঙ্গা স্রোতের মতো সবাই নেমে এসেছিলো রাস্তায়৷ তারা স্বপ্ন দেখেছিল সত্যি এক বৈষম্যবিরোধী সমাজের, রাষ্ট্রের৷ হয়তো সেই স্বপ্ন ছিলো ইউটোপিয়া৷ কিন্তু মানুষের অংশগ্রহণে কোনো ভাণ ছিলো না৷ কোনো সন্দেহ ছিলো না৷
ফলত দেখা গেলো, যে বন্দিশালা ভাঙবে বলে বিশ্বাস হচ্ছিলো না, সেই এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে ভাবা যাচ্ছিলো না, সেই এস্টাবলিশমেন্ট ভেঙে পড়েছে৷ এবার মুক্তি৷
কিন্তু মুক্তি এক অপার সম্ভাবনাময় পরিসর, যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই৷ আদিম সমাজ ছিলো মুক্ত৷ সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে উন্মেষ হয়েছে নানা বন্দিদশার৷ সবসময় তা কেবলই আক্ষরিক বন্দিত্ব নয়৷ বরং যে দায় ও দরদের কথা সম্প্রতি বলা হচ্ছে সেই দায় ও দরদ মানুষের আচরণ ও জীবনকে নানাভাবে সীমায়িত করে, করতে বাধ্য৷
এই জুলাই আন্দোলনে মানুষ কিংবা অন্য অনেক পক্ষ যারা নিজেদের বৈষম্যের শিকার ভেবেছিলো এবং পরিত্রাণের পথ পাচ্ছিল না, তারা সমবেত হয়ে নেমে এসেছিল রাজপথে৷ সবার অধিকার আদায়ের জন্য৷ এই দাবি অনায্য নয়৷ বৈষম্য বিলোপের কালে সে বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজের সুবিচার প্রত্যাশা করবে এটাই স্বাভাবিক৷
কিন্তু শুরু থেকেই বৈষম্যের শিকার কোনো গোষ্ঠী সুবিচার পেয়েছে বলে নিশ্চিত হয়নি৷ ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ কেউ পুনর্বাসিত হয়েছেন এটা ঠিক৷ কিন্তু প্রায় প্রতিটি সেক্টরে লেগে থাকা বৈষম্যের জট খোলার কোনো লক্ষণ প্রতীয়মান হচ্ছে না৷ লক্ষণ থাকলে প্রস্তুতি কিংবা পরামর্শ কিংবা আশ্বাস আশা করা শ্রেয়৷ দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের অতিবাহিত সময় নাতিদীর্ঘ৷ বলা যায় অতিই সামান্য৷ কিন্তু ঐ যে লক্ষণ, প্রস্তুতি, পরামর্শ কিংবা আশ্বাস কিছুই প্রতীয়মান নয়৷ আমরা পুনরাবৃত্তি দেখছি৷ আইন বলে, একজন দাগি আসামিও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায়৷ এখানে আত্মপক্ষ বলে কোনো পক্ষেরই কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়নি৷
শুরু করেছিলাম বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রসঙ্গ দিয়ে৷ হাসিনা সরকার পতনের তিন মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর কোন ক্ষেত্রে কতটা বৈষম্যের বিলোপ হয়েছে, কয়জন তার প্রতি সংঘটিত বৈষম্যের বিলোপে সন্তুষ্ট তার বিবেচনা জনগণ করতে শুরু করেছে৷ রাস্তাঘাটে চললে মানুষের টুকরো টুকরো কথায় টের পাওয়া যায়৷
আন্দোলনের শুরুতে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি শোনা গিয়েছিলো সেটি হচ্ছে ইনক্লুসিভ সোসাইটির কথা৷ যদিও সেই ইনক্লুসিভ সোসাইটির কোনো স্পষ্ট ধারণা দেয়া ছিলো না, তবু আমরা জানি বৈষম্য বিলোপের প্রধান এবং অন্যতম শর্ত সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা৷ এবং সবার জন্য সুযোগ যখন সমান হয় তখন তাকেই ইনক্লুসিভ সমাজ বলা যায়৷
সুবিধা সমান না করে বৈষম্য বিলোপ করার ধারণা সোনার পাথরবাটিই কতকটা৷ হ্যাঁ জনগণ সবার সুযোগ চায়, নাকি বৈষম্যের বিলোপ চায়, নাকি দুটোকে তারা সমার্থক বিবেচনা করে সেটা একান্তই তাদের বিবেচনা৷ সময়ে তার উত্তর মিলবে আশা করা যায়৷