৩১ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে ৪২তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা৷ গত মঙ্গলবার এই মেলার উদ্বোধন করেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব দিয়ে সম্মানিত করবে ফ্রান্স৷
বিজ্ঞাপন
৪২তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা এবার পঠন-পাঠনের বাইরে সম্পূর্ণ অন্যতর এক কারণে বিশিষ্টতা অর্জন করেছে৷ এবারের কলকাতা বইমেলার‘থিম' দেশ ফ্রান্স৷ শুধু বইমেলা নয়, এর আগে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সময়ও ‘ফোকাল থিম' হিসেবে দর্শক-নজরের কেন্দ্রে ছিল ফরাসি চলচ্চিত্র৷ আর এ সবই ছিল ভারত-ফ্রান্স সম্পর্কের ৭০ বছর পূর্তি উৎসব ‘বোঁজুর ইন্ডিয়া' উদযাপনের অঙ্গ৷ কলকাতা বইমেলায় এই উৎসবের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটবে৷ তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এবার বইমেলার বৃহত্তম প্যাভিলিয়নটি করেছে ফ্রান্স এবং এই মেলা চলাকালীন ফরাসি সরকার তাদের দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘লিজিয়ন অফ অনার' দেবে বর্ষীয়ান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে৷ কোনো বাঙালি, এমনকি কোনো ভারতীয়ের পক্ষেও বিরলতম এই সম্মান শেষবার পেয়েছিলেন চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়৷ সৌমিত্র তাঁরই প্রিয়তম অভিনেতা ছিলেন৷ আন্তর্জাতিক স্তরে পুরস্কৃত সত্যজিতের একাধিক ছবিতে কাজ করেছেন৷
মমতা ব্যানার্জি
তাঁর এই সম্মান প্রাপ্তি কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গকেও গর্বিত করেছে৷ মঙ্গলবার বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ এবং বিশেষ সম্মান হিসেবে ভারতে ফরাসি রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার সিগলার-এর উপস্থিতিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই এ দিন প্রথামাফিক কাঠের হাতুড়ি ঠুকে বইমেলার সূচনা ঘোষিত করেন৷ তার আগে তাঁকে রাজ্য সরকারের তরফেও সম্মাননা জানানো হয়৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবারের বইমেলায় ফরাসি প্রতিনিধিত্বের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, ফ্রান্সকে যেমন সারা বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে মনে করা হয়, তেমনই কলকাতা হলো ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী৷
এদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ইতিহাস ও তথ্যের বিকৃতির যে অপচেষ্টা চলছে দেশজুড়ে, তার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেন৷ বলেন লেখক-সাহিত্যিকদের এক্ষেত্রে দায়িত্ব অনেক৷ তাঁদের সচেতন হতে হবে, অন্যদের সচেতন করতে হবে৷ লেখক-পাঠক, সবার উদ্দেশেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বইকে পাহারা দিন আপনারা৷ যাতে কেউ বই বিকৃত করতে না পারে৷ রাজনীতি, সাহিত্য, সমাজ, সব ধরনের বইয়ের ক্ষেত্রেই সজাগ থাকতে হবে৷''
৪২তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা এবার ফের জায়গা বদলে হচ্ছে সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ক লাগোয়া মেলা প্রাঙ্গনে৷ ১২ দিনের এই মেলায় জায়গা পেয়েছে ৫৮০টি স্টল এবং ২০০টির মতো লিটল ম্যাগাজিন৷ ফরাসি লেখকরা ছাড়াও মেলায় অংশ নিচ্ছেন রাশিয়া, কলম্বিয়া, স্পেন, স্কটল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, অ্যামেরিকা, গুয়াতেমালা এবং বাংলাদেশের লেখক ও প্রকাশকরা৷ এবার ৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি পালিত হবে বাংলাদেশ দিবস হিসেবে৷ বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকরা উপস্থিত থাকবেন দিনভর নানা অনুষ্ঠানে৷ পরদিন, অর্থাৎ ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হবে শিশু সাহিত্য দিবস হিসেবে৷
বইয়ের কলেজ স্ট্রিট
শুরু হয়ে গিয়েছে কলকাতা বইমেলা৷ ব্যস্ত কলেজ স্ট্রিট পাড়াও৷ কলকাতার বইয়ের আঁতুড়ঘর৷ ছোটবড় প্রায় সমস্ত প্রকাশনার দফতরই এখানে৷ যে পাড়ার রাস্তাঘাটেও ছড়িয়ে থাকে বই৷ বই নিয়ে আড্ডা হয় কফি হাউসে৷ হেঁটে দেখা যাক সেই পাড়া৷
ছবি: Twisha
বইপাড়া
কলেজ স্ট্রিটকে বলা যেতে পারে শিক্ষাসংস্কৃতির সূতিকাগার৷ বাংলা ভাষায় বই প্রকাশের প্রধানতম কেন্দ্র এটিই৷ বই কেনাবেচারও৷ প্রতিদিন নতুন নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে, প্রকাশনার খুঁটিনাটির পরিকল্পনা হচ্ছে এখানে বসেই৷ অল্প দূরেই ছাপাখানা, কাগজের পসরা, সবই কলেজ স্ট্রিটকে ঘিরে৷ স্কুলকলেজের পাঠ্যবইয়ের কেজো দুনিয়াদারি যেমন এখানে, পাশাপাশি রচিত হচ্ছে সাহিত্যের উজ্জ্বল মণিমুক্তোও৷
ছবি: Twisha
হারানো বই
হঠাৎ কোনো হারিয়ে-যাওয়া ফুরিয়ে-যাওয়া বইয়ের খোঁজ মিলে যাবে এখানে৷ কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে বা প্রেসিডেন্সির রেলিঙে৷ গুপ্তধন পাওয়ার উল্লাসের সঙ্গে মিশে যাবে স্মৃতির বিলাস বা বেদনা৷
ছবি: Twisha
এবং দে’জ
চল্লিশের দশকে দে বুক স্টল নামে ছোট বইয়ের দোকান হিসেবে পথ চলা শুরু৷ ১৯৭০ সালে শুরু হয় তাদের প্রকাশনাসংস্থা দে’জ পাবলিশার্স৷ প্রায় পঞ্চাশ বছর কাটিয়ে এখন তাদের প্রকাশনা দপ্তর ও বইয়ের দোকান বিশাল আকার নিয়েছে৷ প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কত হিসেব করা কঠিন৷ এখন তারা পশ্চিমবঙ্গের অগ্রনী প্রকাশক৷
ছবি: Twisha
চক্রবর্তী, চ্যাটার্জি অ্যান্ড কোম্পানি
১০৮ বছর আগে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের তিন ছাত্র ‘চক্রবর্তী, চ্যাটার্জি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন৷ কলেজ স্ট্রিটের ওপরে দু’টি তলা নিয়ে দোকানটি অবস্থিত৷ নীচের তলায় পাঠ্যপুস্তক ও ওপরের তলায় বাকি নানা ধরনের বই৷ বর্তমান মালিকেরা ১৯৭১-এ অধিকাংশ শেয়ার কিনে এর মালিকানা পান৷ ১৯৭৩ থেকে তাঁরা নিয়মিত নানা ধরনের বই প্রকাশ করে আসছে৷
ছবি: Twisha
বেঙ্গল পাবলিশার্স
বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত সাহিত্যিক মনোজ বসু৷ তাঁর রচিত অনেক বইই প্রকাশিত হয়েছিল এই প্রকাশনী থেকে, তার মধ্যে আছে ‘নিশিকুটুম্ব’৷ এ ছাড়াও বাংলা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত লেখকের ও নানা ধরনের বই এঁরা প্রকাশ করেছেন, যেমন ‘সুন্দরবন অমনিবাস’, ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ’৷ ইদানীং তাঁদের প্রকাশনায় ভাটার টান, গত দু’বছর ধরে তাঁরা নতুন বই প্রকাশ করছেন না, বইমেলাতেও থাকছেন না৷
ছবি: Twisha
কফিহাউস
বইপাড়ার ঠিক মাঝখানে কফিহাউস৷ তাকে বলা যাবে না নিছক রেস্তোরাঁ, যদিও খাবার পাওয়া যায়৷ মূলত কফিতে চুমুক দিয়েই চলে এখানকার আড্ডা গল্প আর তা থেকে ছলকে ওঠে সাহিত্যশিল্পের দ্যুতি৷ কে না এসেছেন এখানে! শঙ্খ ঘোষ থেকে শুরু করে কৃত্তিবাসের কান্ডারীরা, নকশাল আন্দোলনের ছোটোবড়ো কর্মীরা, লিটল ম্যাগাজিনের স্বপ্নপাগল ছেলেমেয়েরা৷ এসেছেন, এখনও আসেন। কফিহাউস শিল্পসাহিত্য ভাবাই যায় না!
ছবি: Twisha
বই পাঠানোর ধুম
বই পাঠকের কাছে পৌঁছনোর আগে থাকে লম্বা এক প্রস্তুতিপর্ব, তারই শেষ পর্যায়ে থাকে থাকে বইয়ের প্যাক ছাপা বাঁধাইয়ের পালা শেষ করে রওনা দেয় প্রকাশকের গখরে বা বইয়ের দোকানে৷ টেম্পো ট্রাক ভ্যান বা রিক্সা, কত রকম যে বাহন তার!