জঙ্গি গোষ্ঠী বোকো হারামের হামলায় উত্তর নাইজেরিয়ার এক গ্রামে বেশ কয়েকজনের প্রাণ গেছে৷ এই গোষ্ঠীর দুর্বল হয়ে যাওয়ার যে খবর এতদিন শোনা গেছে সেটা যে ঠিক নয়, এই হামলা তার প্রমাণ বলে মনে করেন ডিডাব্লিউ-র গ্রেহেম লুকাস৷
বিজ্ঞাপন
নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চল ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে বোকো হারামের হামলায় গত ছয় বছরে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷ নাইজেরিয়ার সবশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও দেশটির সেনাবাহিনীর কাছে বোকো হারামের কয়েকবার পরাজিত হওয়ার ঘটনায় মনে হয়েছিল যে, এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি হয়ত দুর্বল হয়ে পড়েছে৷ এমনও ভাবা হয়েছিল যে দুই বছর আগে অপহরণ করা স্কুল ছাত্রীরা হয়ত শিগগিরই মুক্তি পাবে৷ কিন্তু ঐ ছাত্রীরা এখনও মুক্ত হয়নি, আর হামলাও চলছে৷ মনে হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ মালিতে সক্রিয় আল-কায়েদার সঙ্গে জড়িত জঙ্গি গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড তাদের উৎসাহিত করছে৷ পশ্চিম আফ্রিকায় ইসলামি শরিয়া ভিত্তিক সমাজ গড়তে নেতৃত্ব দেয়া নিয়ে দুই জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে৷
যে লড়াই আজও চলছে...
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলমান সংঘাত নিয়ে গবেষণা করছে হাইডেলবার্গ ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল কনফ্লিক্ট রিসার্চ (এইচআইআইকে)৷ তাদের হিসেবে, গত বছর গোটা বিশ্বে চারশোর মতো সংঘাত ঘটেছে, যার বিশটি সরাসরি যুদ্ধ৷ এই নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Reuters
শান্তির কোনো লক্ষণ নেই
ধর্মান্ধতা, দুষ্প্রাপ্য খনিজ পদার্থের লোভ কিংবা ক্ষমতা দখলের বাসনা – হাজার হাজার বছর ধরে যুদ্ধ, সংঘাতের কারণ ঘুরে ফিরে এগুলোই৷ ২০১৩ সালেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ হাইডেলবার্গ ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল কনফ্লিক্ট রিসার্চ (এইচআইআইকে) গত বছরের উল্লেখযোগ্য কিছু সংঘাত, যুদ্ধের কথা প্রকাশ করেছে ‘কনফ্লিক্ট ব্যারোমিটার ২০১৩’ শিরোনামে৷
ছবি: Reuters
ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো
গত বছর কিভু-তে সেনাবাহিনী নিয়মিত এম২৩ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে৷ ২০১৩ সালের শেষের দিকে অবশ্য সরকার ঘোষণা দেয়, বিদ্রোহীদের দমনে সক্ষম হয়েছে তারা৷ অন্যদিকে এম২৩ গোষ্ঠীর ঘোষণা, এখন থেকে রাজনৈতিক পথে দাবি আদায়ের চেষ্টা করবে তারা৷
ছবি: Melanie Gouby/AFP/GettyImages
মালি
মালিতে উগ্র ইসলামপন্থিরা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে৷ ২০১২ সালে সে দেশের উত্তরাঞ্চলের একটা বড় অংশ তাদের দখলে চলে যায়৷ ফলশ্রুতিতে মালি সরকারকে যুদ্ধে সহায়তায় এগিয়ে আসে ফ্রান্স৷ এরপর পিছু হটতে বাধ্য হয় উগ্র ইসলামপন্থিরা৷ বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মালিতে শান্তি রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে৷ তবে সে দেশে বিভিন্ন জঙ্গি এবং আত্মঘাতী হামলার খবর মাঝে মাঝেই শোনা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নাইজেরিয়া
উগ্র ইসলামপন্থি জঙ্গি গোষ্ঠী বোকো হারাম নাইজেরিয়ায় শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়৷ এই লক্ষ্য পূরণে সে দেশের খ্রিষ্টান এবং মধ্যপন্থি মুসলমানদের উপর হামলা অব্যাহত রেখেছে গোষ্ঠীটি৷ ছবিতে একটি হামলায় নিহতদের জন্য সমাধি খুঁড়ছেন তাদের খ্রিষ্টান আত্মীয়রা৷ নাইজেরিয়ায় আরো একটি সংঘাত চলছে৷ তৃণভূমি ইস্যুতে খ্রিষ্টান কৃষকরা লড়াই করছেন গবাদি পশু পালক মুসলমানদের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সুদান
গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে দারফুর অঞ্চলে বসবাসকারী আফ্রিকার বিভিন্ন গোষ্ঠী সরকারি বাহিনী এবং তাদের অনুসারীদের সঙ্গে লড়াই করছে৷ যুদ্ধের কারণে কয়েক লাখ মানুষ ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে এবং অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আফগানিস্তান
আফগানিস্তানে নিযুক্ত ন্যাটো বাহিনী স্থানীয় বাহিনীর হাতে সে দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পরও সংঘাত অব্যাহত রয়েছে৷ তালেবান এবং অন্যান্য চরমপন্থি গোষ্ঠী সে দেশের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী হামলা এবং ‘বুবি-ট্র্যাপ’-এর মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে৷ বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলে সংঘাত থামার কোন লক্ষণ নেই৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, আফগানিস্তানে ২০১৩ সালে আড়াই হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেক্সিকো
মাদক, মানবপাচার, ব্ল্যাকমেল এবং চোরাচালানের মতো কর্মকাণ্ড মেক্সিকোর মাফিয়াদের অর্থ উপার্জনের উৎস৷ আয়ের এসব উৎস নিরাপদ রাখতে মাফিয়ারা একে অপরের সঙ্গে এবং প্রয়োজনে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়৷ সে দেশে প্রতি সপ্তাহেই দাঙ্গার ঘটনা ঘটে৷ মেক্সিকো সরকারের হিসেব অনুযায়ী, গত বছর সে দেশে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সিরিয়া
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে৷ সেদেশ কার্যত বিভিন্ন অংশে ভাগ হয়ে গেছে৷ কিছু অংশের দখল রয়েছে সে দেশের প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারি বাহিনীর কাছে, বাকি বিভিন্ন অঞ্চল মধ্যপন্থি বিরোধী দল, উগ্র ইসলামপন্থি গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দখলে চলে গেছে৷ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে এখন পর্যন্ত এক লাখের বেশি মানুষ নিহত এবং নব্বই লাখের মতো মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে৷
ছবি: Mohmmed Al Khatieb/AFP/Getty Images
ফিলিপাইন্স
চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিপাইন্সে মোরো সম্প্রদায় স্বাধীনতার দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে৷ মাঝে কিছুদিন অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকার পর ২০১৩ সালে আবারো তারা শুরু হয়েছে সহিংস সংগ্রাম৷ বিদ্রোহী গোষ্ঠী এমএনএলএফ সে দেশের দক্ষিণের দ্বীপগুলোর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে৷ যুদ্ধের কারণে এক লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে৷
ছবি: Reuters
সোমালিয়া
সোমালিয়ায় আল-শাবাব জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর যুদ্ধ চলছে গত আট বছর ধরে৷ জাতিসংঘ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের সেনাদের সহায়তায় সোমালিয়া সরকার আল-শাবাবকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে৷ তবে এখনো সে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বড় অংশ জঙ্গি গোষ্ঠীর দখলে রয়েছে৷
ছবি: Mohamed Abdiwahab/AFP/Getty Images
দক্ষিণ সুদান
তিন বছর আগে স্বাধীনতা লাভ করা দক্ষিণ সুদানে এখনো সংঘাত অব্যাহত রয়েছে৷ সে দেশের ভাইস-প্রেসিডেন্টের পক্ষের সেনারা প্রেসিডেন্সিয়াল ফোর্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে৷ এছাড়া প্রতিবেশী দেশ সুদানের দুটি রাজ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত রয়েছে দক্ষিণ সুদানের সেনারা৷
ছবি: Reuters
11 ছবি1 | 11
সপ্তাহান্তে বোকো হারাম যেটা করছে সেটাকে সিরিয়া, ইরাক এবং সম্প্রতি লিবিয়াতে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে৷ পশ্চিম আফ্রিকায় আল-কায়েদা যা করতে পারে, বোকো হারামও তা পারে৷ এই দুই গোষ্ঠীই বর্বরতম হওয়ার চেষ্টা করছে৷ এটি এতটাই খারাপ ও বিকৃত এক বিষয়, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না৷
বোকো হারামের সদস্য ও তিন নারী আত্মঘাতী হামলাকারীর হামলায় কমপক্ষে ৮৬ জন প্রাণ হারিয়েছে৷ এর মধ্যে অনেক শিশুও রয়েছে৷ অনেকের শরীর আগুনে পুড়ে গেছে৷ বোকো হারামের সৃষ্টি যে শহরে সেই মাইডুগুরি থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে এই হামলা চালায় বোকো হারাম৷
হামলার পরপর নাইজেরীয় সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডে মনে হয়েছে যে তারা এ ধরণের জঙ্গি হামলা মোকাবিলায় সক্ষম নয়৷ হামলাস্থলের কাছেই সেনা ক্যাম্প থাকলেও হামলা শুরুর চার ঘণ্টা পর সেখানে সেনাসদস্যরা উপস্থিত হন৷ তবে প্রথমে যে সেনা সদস্যরা সেখানে পৌঁছেছিলেন তাদের চেয়ে অস্ত্রশস্ত্রে বেশি সজ্জিত ছিল হামলাকারী বোকো হারাম সদস্যরা৷ পরে আরও অস্ত্র নিয়ে অন্য সেনা সদস্যরা হাজির হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হয়৷ নাইজেরীয় সেনাবাহিনীর এই প্রতিক্রিয়া এটাই প্রমাণ করে যে দেশটিতে নতুন প্রেসিডেন্ট আসলেও বোকো হারামকে নিয়ন্ত্রণ করার নীতিতে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি৷
সবশেষ হামলা এটাও প্রমাণ করে যে, ইসলামিক স্টেট ও আল-কায়েদার সঙ্গে মতাদর্শে ভিন্নতা থাকলেও বোকো হারাম এখন তথাকথিত ‘সফট টার্গেট'-এ হামলা করছে৷ অর্থাৎ যে সব শহর ও গ্রামে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ততটা শক্ত নয় এবং যে অঞ্চলগুলোতে বিদেশি অতিথিরা যান সে সব জায়গায় হামলার পরিকল্পনা করছে বোকো হারাম৷ অপহরণও তাদের পরিকল্পনার মধ্যে আছে৷ যারা তাদের মতাদর্শ সমর্থন করবে না তাদেরই হত্যা করা হবে৷ সরকারগুলো যদি এখনই তরুণদের এ ধরণের জঙ্গি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারে তাহলে আফ্রিকা, এশিয়া সহ ইউরোপ হামলার হুমকির মুখে থাকবে৷ জঙ্গিরা যা করছে তার সঙ্গে তারা যে ধর্মের কথা বলে তার কোনো সংযোগ নেই৷
বন্ধু, আপনি কি গ্রেহেম লুকাসের সঙ্গে একমত? মন্তব্য করুন নীচের ঘরে৷