ব্যবস্থাপনায় রোল মডেল হয়েও দুর্যোগে নাকাল হওয়ার কারণ
২৭ মে ২০২২বাংলাদেশে এখনো আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয় বন্দরের জন্য৷ সতর্ক সংকেতগুলো সাধারণ মানুষ বোঝেন না৷ দেশের সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যায় আগাম কোনো পূর্বাভাস দিয়ে কৃষকদের ফসল রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া যায়নি৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ পেরেছে৷
উপকূলীয় বাঁধগুলো ভাদ্রমাসের জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়৷ উপকুলীয় সবুজ বেষ্টনী রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে উজাড় হয়ে যাচ্ছে৷ বজ্রপাত প্রতিরোধে লাগানো তালগাছ কেতাবে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই৷ উপকূলের ৩২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় দুই লাখ ৫৬ হাজার মানুষ এবং প্রায় ৪৪ হাজার গবাদি প্রাণীর আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ আছে৷ কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষ আশ্রয় নিতে চায় না৷
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘‘একটি আশ্রয় কেন্দ্রে একজন মানুষের জন্য দুই বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ৷ সেই জায়গায় একজন মানুষ কতক্ষণ থাকতে পারে৷ এখন তো ৫৬ ঘন্টা আগে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বলা হয়৷ নারী আছে, শিশু আছে তারা কি অতটুকু জায়গায় থাকতে পারে? ফলে তারা যায় না৷ এর ফলাফল অনেকের মৃত্যু হয় ঘূর্ণিঝড়ে৷’’
তিনি বলেন, একটি আশ্রয় কেন্দ্রের অর্থ দিয়ে ৪০টি দোতলা বাড়ি করা সম্ভব নীচতলা ফাঁকা রেখে ৷ কিন্তু সেটা করা হয়নি৷ তাই অবকাঠামো থাকলেও দুযোর্গে কাজে লাগে না৷
বাংলাদেশে কৃষক ও কৃষিকে সামনে রেখে কোনো আবহাওয়ার পূর্বভাস দেয়া হয় না৷ কখন বৃষ্টি হবে, কখন পানি বাড়বে এগুলো কৃষক জানেন না৷ ফলে তার ফসল ডুবে যায়, বাড়ি ডুবে যায়, ঢলে সব শেষ হয়ে যায়৷ গওহার নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘‘শুধু যদি এবার কৃষকদের জানানো হতো যে, অমুক তারিখে বৃষ্টি হবে, অমুক তারিখে পানি বাড়বে, তাহলে কৃষকদের ধান নষ্ট হতো না৷ আমাদের কাছে তথ্য ছিল, আমরা জানাইনি৷ পশ্চিম বাংলা কৃষকরা ধান রক্ষা করতে পেরেছেন৷ একই জায়গা থেকে তথ্য পেয়েও আমরা পারিনি৷’’
বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রশংসনীয় সফল্য অর্জন করলেও আরো অনেক দূর যেতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম৷ চলতি দশকে বাংলাদেশের ১১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছেন৷
গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স বলছে, বাংলাদেশে গত ২০ বছরে ১৮৫টি আবহাওয়াজনিত তীব্র দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে৷ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের৷ আর শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ বিপদাপন্নতায় পৃথিবীতে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে রয়েছে৷
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্যোগ হিসেবে সামনে এসেছে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু৷ এছাড়া ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যেও রয়েছে বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশে বছরে এখন প্রায় তিনশ' মানুষ বজ্রপাতে মারা যান৷ আর এই বজ্রপাত ঠেকাতে সারা দেশে তালগাছ লাগানোর প্রকল্প নেয়া হয়েছিল৷ এখন ৩৮ লাখ তালগাছ লাগানোর প্রকল্প বাতিল করে এখন বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে৷
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-এর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, ‘‘আসলে তালগাছ বিষয় নয়, আমাদের দরকার উঁচু গাছ৷ আমরা নিজেরাই গাছ কেটে ফেলেছি৷ নিজেরাই নিজেদের বিপর্যয় ডেকে এনেছি৷ আর তাল গাছ তো সব জায়গায় লাগানো যাবে না৷ শহরে তালগাছ লাগাবেন কিভাবে?’’
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ এখন ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা৷ সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ঢাকা শহরের অধিকাংশ ভবন ধ্বসে পড়বে৷ কারণ, বিল্ডিং কোডে এখন ভূমিকম্প সহনীয় শর্ত রাখা হলেও এর আগে তো অধিকাংশ ভবন তৈরি হয়েছে৷’’
এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কিছু বিষয় আছে, আগে থেকে আঁচ করা যায় না ৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ কিন্তু এসব মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন তিনি৷
বাংলাদেশে সব মিলিয়ে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি বাঁধ আছে৷ কিন্তু এবারের হাওরের বন্যায় বাঁধ টেকেনি৷ আর ভাদ্র মাসের পানির চাপ নিতে পারে না অধিকাংশ বাঁধ৷ প্রতি বছরই বাঁধ নির্মাণের পিছনে শত শত কোটি টাকা অপচয় হয়৷ খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, ‘‘এই বালুর বাঁধগুলো আসলে টেকসই নয়৷ পানির ঢল এরা ঠেকাতে পারে না৷’’
এই বাঁধ নির্মাণে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রণ নেই৷ তাদের প্রয়োজনীয়তার কথাও বিবেচনায় নেয়া হয়নি৷
উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের শতকরা ৫০ ভাগ গাছের এখন আর অস্তিত্ব খূঁজে পাওয়া যাবে না৷ রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে সেই গাছগুলো হাওয়া হয়ে গেছে৷ ফলে ৭৭৫ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা লবণাক্ততা ও ঝড় জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে৷ গওহার নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘‘কী গাছ লাগাতে হয় তা-ও আমরা জানি না৷ আর গাছ লাগানোর পর আমরা খোঁজও রাখি না৷’’
কৃষি অর্থনীতির এই দেশে দুর্যোগবার্তা এখনো কৃষি ও কৃষককেন্দ্রিক নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কম্যুনিকেশন (বিএনএনআরনি)-র প্রধান এ এইচ এম বজলুর রহমান৷
আবহাওয়ার ৫, ৬, ৭ সতর্ক বার্তা যে একই সতর্কতার তা কি আমরা জানি? তাহলে কৃষক জানবে কীভাবে? এটা কৃষকের জন্য নয়, বন্দরের জন্য৷ আর আবহাওয়ার এই তথ্য কৃষি অধিদপ্তর বা মন্ত্রনালয়ের অধীনে নয়৷ গত ১০ বছরের বৃষ্টিপাতের তথ্য চাইলে গওহার নাঈম ওয়ারাকে ‘রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য’ বলে দেয়া হয়নি বলে জানান তিনি৷ কিন্তু ভারতে এই তথ্য উন্মুক্ত৷
বজলুর রহমান বলেন, ‘‘এখন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আবহাওয়ার সতর্ক বার্তার ব্যাপারে আগের চেয়ে সচেতন হয়েছে৷ কিন্তু ভারত থেকে যে পানি আসে বা যে ঢল হয়, তা নিয়ে আগাম কিছু জানতে পারে না উত্তরাঞ্চলের মানুষ৷ আর সংকেত আরো সহজ করার দরকার আছে৷’’
তার কথা, কখন বৃষ্টি হবে, কখন পানির ঢল আসবে, কখন পানি বাড়বে- এই তথ্যগুলো পাওয়া গেলে কৃষক ও সাধারণ মানুষ অনেক বড় বড় দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতো৷