১৮ বছরে একটি মানুষ সাবালক হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি ৪২ বছরেও সাবালক হয়নি৷ বলা বাহুল্য, রাজনীতি ব্যর্থ না হলে রাষ্ট্র আরো এগিয়ে যেত৷ কারণ রাজনৈতিক দল চলে চাঁদাবাজির টাকায়৷ তাই কেউ কোনোভাবেই ক্ষমতার বাইরে থাকতে চান না৷
বিজ্ঞাপন
বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দলের টানা ৮৪ ঘণ্টা, মানে চার দিনের হরতাল শুরু হয়েছে রবিবার সকাল ৬টা থেকে৷ প্রথম দিনের হরতালে সহিংসতায় ফেনী এবং চট্টগ্রামে দু'জন নিহত হয়েছেন৷ ককটেল বিস্ফোরণ এবং যানবাহনে আগুনও দেয়া হয়েছে যথারীতি৷
ঢাকায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কোনো নেতা-কর্মীকে দেখা যায়নি৷ কার্যালয়ের ভেতরে বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী৷ বলেছেন, পাঁচজন নেতাকে গ্রেপ্তারের পর বাকি শীর্ষ নেতারা আত্মগোপন করেছেন৷ ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না৷ তিনি বাসায় থাকছেনই না, তার ওপর তাঁর মোবাইল ফোনও বন্ধ৷ এমনকি, দা-কুড়াল নিয়ে প্রতিরোধের ডাক দেয়া বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা ‘লা পাত্তা'৷ তাই দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতা তো দূরের কথা সাধারণ নেতা-কর্মীরাও হরতালে মাঠে নেই৷ শুধু কয়েকজন নেতা রবিবার রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা করেছেন৷ তাঁদের মধ্যে একজন ওসমান ফারুক হরতালের মধ্যেই গাড়ি গিয়ে দেখা করতে গেলে খালেদা জিয়া তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি৷ খালেদা জিয়া নেতাদের বলেছেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবেন না তিনি, সে যত গ্রেপ্তার আর নির্যাতনই করা হোক না কেন৷ বরং আন্দোলন আরো তীব্র করা হবে৷ এর বিপরীতে ঢাকায় শনিবার শাসক দল আওয়ামী লীগের হরতাল বিরোধী মিছিল ছিল বড় সড়ক পেরিয়ে, গলি পথেও৷ তাদের অবশ্য কোনো পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়নি৷ ঢাকার বাইরেও হরতাল বিরোধী মিছিলের বেজায় আধিক্য দেখা যায়৷ এছাড়া, ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল রবিবার উত্সবমুখর৷ কারণ সংসদ নির্বাচনের জন্য রবিবার থেকেই দলীয় মনোনয়ন-পত্র বিক্রি শুরু হয়েছে৷ সারাদিন বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে মানোনয়ন-পত্র কিনেছেন দলের নেতারা৷ বলা বাহুল্য, প্রথম মনোনয়ন-পত্রটি কেনেন শেখ হাসিনা৷ তাঁর পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মনোনয়ন-পত্রটি কেনার মধ্য দিয়ে ফর্ম বিক্রি শুরু হয়৷ প্রথম দিনেই কোটি টাকার ফর্ম বিক্রি হয়েছে বলে খবর৷ ফর্ম কিনেছেন ৬৭৮ জন মনোনয়ন প্রত্যাশী৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
একদিকে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা আর আরেকদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি৷ একদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রায় শূন্য আর অপরদিকে উত্সবমুখর শাসক দল আওয়ামী লীগের কার্যালয়৷ বাংলাদেশের রাজনীতির কেন এই চিত্র জানতে চাইলে সমসাময়িক রাজনীতির বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ক্ষমতায় যেতে বিএনপি হরতাল আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে৷ অন্যদিকে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সরকার বিএনপির ওপর পাল্টা চাপ দিচ্ছে৷ যার ফল হলো, সাধারণ মানুষের প্রাণহানি আর ভোগান্তি৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো চাঁদাবাজির অর্থে পরিচালিত হয়৷ চাঁদাবাজির জন্য ক্ষমতা একটি মোক্ষম অস্ত্র৷ তাই যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতা ধরে রাখা তাদের প্রধান লক্ষ্য, জনগণ তাদের কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়৷ ফলে রাজনৈতিক সমঝোতা হয় না৷ যে যার অবস্থানে আপোষহীন থাকে৷''
আফসান চৌধুরী বলেন, এই রাজনীতির সঙ্গে দেশের মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই৷ দেশের মানুষ এই রাজনৈতিক আদর্শ ধারণও করেন না৷ তাঁরা তাঁদের মতো করে দেশের জন্য এবং আত্মউন্নয়নে কাজ করছেন৷ সাধারণ মানুষের ঘাম আর শ্রমেই বাংলাদেশ খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ, তৈরি পোশাক শিল্পে এগিয়েছে৷ আর দেশের বাইরে নানা ধরণের কাজ করে ‘রেমিটেন্স' পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা৷ মাথা পিছু আয় বাড়ছে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সূচকে অগ্রগতি হচ্ছে৷ তাই বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থ নয়, বরং সফল৷ ব্যর্থ বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদরা৷ তাঁরা সফল হলে দেশ আরো এগিয়ে যেত৷ তিনি বলেন, দেশের সাবালক সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে আছেন নাবালক রাজনীতির কাছে৷ ১৮ বছরে একজন মানুষ সাবালক হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি ৪২ বছরেও সাবালক হতে পারেনি৷
তাঁর মতে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট কাটার কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না৷ যদি কোনো চাপের কারণে সংকট কেটেও যায়, তা হবে সাময়িক৷ সংকট আবারো ফিরে আসবে৷ কারণ, রজনৈতিক দলগুলোই সংকটের কারণ৷ তারাই সংকট চায়৷ সংকট টিকিয়ে রাখে তাদের স্বার্থে৷