দেশে ব্যাংকঋণের সুদহার সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে৷ এই সুদহার আজ থেকে প্রযোজ্য হবে এবং এপ্রিল মাসের জন্য তা বহাল থাকবে৷ গত জুলাই মাসের পর এটাই হবে ঋণের ওপর সর্বোচ্চ সুদহার৷
বিজ্ঞাপন
সুদহার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন একটি নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করছে৷ এর ফলে ঋণের সুদ এখন প্রতি মাসেই বাড়ছে৷ গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ছিল ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ৷ মার্চে তা বেড়ে হয় ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ৷
এর আগে ঋণের ওপর সর্বোচ্চ সুদের হার নির্ধারিত ছিল ৯ শতাংশ৷ গত জুলাই মাসে সুদের হার বেঁধে দেওয়ার ওই পদ্ধতি থেকে সরে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ বর্তমানে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট পদ্ধতিতে ঋণের সুদের ভিত্তি হার নির্ধারিত হয়৷ এই ভিত্তি হারের সঙ্গে এর আগে বাড়তি ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ যুক্ত হলেও এবারে বাংলাদেশ ব্যাংক ৩ শতাংশ সুদ যোগ করতে বলেছে৷ ভিত্তি হার ও বাড়তি সুদ এই দুইয়ে মিলে ঋণের চূড়ান্ত সুদহার নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলো৷
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের চিত্র
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি সবচেয়ে শোচনীয়৷ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত প্রতি ১০০ টাকার ২০ টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে৷ আরো জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO
খেলাপি ঋণ কী
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাহক তার ঋণ বা এর উপর আরোপিত সুদ পরিশোধ না করলে তা খেলাপি ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়৷ বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে৷ ছয় থেকে ১৮ মাসের বকেয়া ঋণকে নিম্নমানের, ১৮ থেকে ৩০ মাসের বকেয়াকে সন্দেহজনক এবং তার বেশি সময় পরিশোধ না হলে তা অনাদায়ের ঝুঁকিতে থাকা মন্দ ঋণ৷
ছবি: Mika Volkmann/picture alliance
আট শতাংশ
আইএমএফ থেকে নেয়া ঋণের শর্ত মেনে আগস্টে প্রকাশিত বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে গত বছরের খেলাপি ঋণের বিশদ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ সেই হিসাবে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের আট শতাংশের বেশি৷ সবশেষ মার্চের হিসাবে তা বেড়ে আট দশমিক আট শতাংশ হয়েছে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি
বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, এই পরিসংখ্যানেও খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না, কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায়ই নানা সুবিধা দিয়ে খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করে৷ সেগুলো তখন আর খেলাপির তালিকায় রাখা হয় না৷ ২০২২ সালে এমন বকেয়া পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা৷ আর বকেয়া খেলাপি ঋণ ছিল ৪৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।
ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO
দেশের বাজেটের অর্ধেক
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা৷ অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের এক বছরের বাজেটের অর্ধেকের সমপরিমাণ৷
ছবি: Xinhua News Agency/picture alliance
৮৮ শতাংশই মন্দ ঋণ
মোট খেলাপি হওয়া ঋণের সাড়ে ৮৮ শতাংশই আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে অনাদায়ী৷ অর্থাৎ, ব্যাংকগুলো গ্রাহককে তাগাদা দিয়েও সেগুলো আদায় করতে পারছে না বা পুনঃতফসিল করা যাচ্ছে না৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের শ্রেণি অনুযায়ী, যা মন্দ বা না পাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ঋণ৷
ছবি: MD Mehedi Hasan/ZUMA Press/picture alliance
পাঁচ ব্যাংকেরই অর্ধেক
বাংলাদেশে এখন মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি৷ এর মধ্য মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৬ শতাংশ ৫টি ব্যাংকের গ্রাহক৷ আর প্রথম দশটি ব্যাংকের প্রায় ৬৫ শতাংশ৷ আটটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের বেশি৷ এর তিনটি সরকারি, তিনটি বেসরকারি, একটি বিদেশি আর একটি বিশেষায়িত৷ ৩৮টি ব্যাংকের খেলাপির হার পাঁচ শতাংশের কম৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সরকারি ব্যাংকে ২০%
সরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত প্রতি ১০০ টাকার অন্তত ২০ টাকাই খেলাপি৷ বিশেষায়িত ব্যাংকে এটি প্রায় ১৩ শতাংশ৷ অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকে এই হার পাঁচ শতাংশের কিছু বেশি৷ তবে বেসরকারি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণ বেশি হওয়ায় তাদের খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ সরকারি ব্যাংকেরই সমান৷ খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে কম বিদেশি ব্যাংকগুলোর যা পাঁচ শতাংশেরও কিছু কম৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সরকারিতে বাড়ছে, বেসরকারিতে কমছে
গত এক বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ এক শতাংশ বেড়েছে৷ কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকে উল্টো দশমিক এক-আট শতাংশ কমেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক
খেলাপি ঋণে সবচেয়ে এগিয়ে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠানগুলো৷ মোট খেলাপির প্রায় ২৭ শতাংশ আছে তাদের কাছে৷ সব মিলিয়ে খেলাপির ৫৫ ভাগই শিল্প খাতের৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ফিরে দেখা
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশে পৌঁছায়৷ সত্তর ও আশির দশকে ব্যাংকগুলো যাথযথ নিয়ম মেনে ঋণ প্রদান না করায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে৷ তবে নজরদারি বৃদ্ধির কারণে ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১১ সালের দিকে খেলাপি ঋণের হার ৬.১ শতাংশে নামে৷ কিন্তু পরের বছর তা দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছায়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অন্যান্য দেশ
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি৷ বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় ভারতে এই হার সাড়ে ছয় শতাংশ, পাকিস্তানে সাত দশমিক তিন, নেপালে দুই দশমিক চার, শ্রীলংকায় প্রায় পাঁচ, মালদ্বীপে প্রায় ছয় শতাংশ৷ যেখানে বাংলাদেশ খেলাপি ঋণের হার আট শতাংশের বেশি৷
ছবি: Indranil Mukherjee/AFP/Getty Images
11 ছবি1 | 11
মার্চ মাস শেষে স্মার্ট হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশে৷ এর সঙ্গে ৩ শতাংশ সুদ যুক্ত করলে ঋণের সুদ দাঁড়ায় ১৩ দশমিক শূন্য ৫৫ শতাংশ৷
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে এখন প্রতি মাসেই ঋণের সুদ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা৷ তাতে বিপাকে পড়ছেন ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাসহ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা৷ কারণ, নতুন করে ব্যাংকঋণ নিতে গেলেই গুনতে হচ্ছে বেশি সুদ৷ ফলে ব্যবসার খরচও বেড়ে যাচ্ছে৷
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বহুল আলোচিত-সমালোচিত ‘৯-৬ সুদহার' উঠিয়ে নেওয়ার পর ঋণের সুদহার বেড়ে এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে৷ ব্যাংকের ঋণের ওপর সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯ শতাংশ, আর আমানতের ওপর সর্বোচ্চ সুদ হার ছিল ৬ শতাংশ৷ ঋণের সুদহার বাড়ার পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এখন আমানতের ওপর সুদের হারও বেড়েছে৷