ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে মূলধন সংকট
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩বিশ্লেষকেরা বলছেন খেলাপি ঋণ, পরিচালকদের ঋণ এবং ব্যবসা বাণিজ্যের মন্দার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে সামনে ব্যাংকের পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানিয়েছেন, যেসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি আছে তাদের মধ্যে সরকারি ব্যাংকই বেশি। তবে তিনি বলেছেন, "এতে গ্রাহকদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ব্যাংকগুলো যাতে তাদের দুর্বল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক সেপ্টেম্বরের যে হিসাব প্রকাশ করেছে তাতে ১০৪টি ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৩৭ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি ছয়টি, বেরসকারি ছয়টি এবং দুইটি বিদেশি ব্যাংক। তবে এর আগে ঘাটতিতে থাকা সোনালী ব্যাংক এখন ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে।
এবারে মূলধন ঘাটতিতে বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষে আছে ন্যাশনাল বাংক। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দুই হাজার ২৪ কোটি টাকা। সরকারি ব্যাংকের মধ্যে ঘাটতিতে শীর্ষে আছে বরাবরের মত কৃষি ব্যাংক। তাদের ঘাটতির পরিমাণ ১৫ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা।
মূলথন ঘটতিতে থাকা ছয়টি সরকারি ব্যাংক হলো: কৃষি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ,বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক।
বেসরকারি ছয়টি ব্যাংক হলো ন্যাশনাল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক। আর বিদেশি ব্যাংক দুইটি হলো: ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং হাবিব ব্যাংক।
আর ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক, ইসলামী ধারার এ পাঁচটি ব্যাংক এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারিতে আছে। ২৮ নভেম্বর ব্যাংক পাঁচটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ২০ দিনের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাবের স্থিতি দীর্ঘদিন ধরে ঋণাত্মক। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চলতি হিসাবের টাকার ঘাটতি পূরণ করতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। না হলে এসব ব্যাংকের লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে মূলধন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের (রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট) ১০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সেই পরিমাণ মূলধন সংরক্ষণে বাধ্য থাকবে। মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংক শেয়ারধারীদের লভ্যাংশ দিতে পারে না।
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন,"ব্যাংকের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়ে। এটা একটা সরল হিসাব। আর মূলধন হলো ব্যাংকের আয়, সম্পদ সব মিলিয়ে। পেইড আপ ক্যাপিটাল হলো যে টাকার শেয়ার আছে বাজারে। বাংলাদেশ ব্যাংক মূলধন ঘাটতি বলতে ব্যাংকের সার্বিক আয় এবং সম্পদ বিবেচনায় নিয়েই বলছে।”
তার কথা,"যে ব্যাংকের আয় কম, ব্যয় বেশি, যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি , ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রভিশন বেশি সেইসব ব্যাংক দুর্বল। তারা মূলধন ঘাটতিতে আছে।”
মূলধন ঘাটতির কারণ হিসেবে তিনি খেলাপি ঋণ ও ব্যবসা বাণিজ্যের মন্দা অবস্থাকে দায়ী করেন। "এর প্রভাব আরো সুদুর প্রসারী হতে পারে। ওই ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকদের আস্থাহীনতার পাশাপাশি অন্য ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি হতে পারে,” বলেন এই ব্যাংকার।
আর পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, "দুইভাবে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে নামে-বেনামে টাকা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন লোককে এবং সেটা আর ফেরত পাওয়া যায়নি। আর ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে যারা এর মালিক বা পরিচালক তারাই বাংকগুলোকে ধ্বংস করছে টাকা পাচারসহ আরো নানা উপায়ে। তারা নামে বেনামে লোন নিয়ে টাকা সরিয়ে ফেলেছে। এই টাকা তারা আর শোধ করবে না। আরও কিছু বেসরকারি ব্যাংকেও একই পরিস্থিতি। ”
তার মতে,"বাংলাদেশ এখন সতর্কতা জারি করে কী লাভ হবে। এখন দরকার এই ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। মালিকানা পরিবর্তন করা। ব্যাংকের ব্যবসার ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রাইভেটাইজেশনের চিন্তা করা যায়। এগুলো না করা হলে আরো সংকট তৈরি হবে। আস্থার সংকট আরো বাড়বে।”
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন,"দেশে সব ব্যাংকের একই অবস্থা থাকে না। যে ব্যাংকের যে ধরনের সমস্যা আমরা সেই সমস্যা কাটাতে সেই ধরনের ব্যবস্থা নিই। এটা আমাদের নিয়মিত কাজের অংশ। আমরা এক বছর আগেও কিছু ব্যাংককে কিছু ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছি। এবার আবারও দিয়েছি। এতে আতঙ্কের কিছু নেই। ওই ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যায়নি। তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। গ্রাহকদের আতঙ্কের কিছু নেই।”
তিনি বলেন, "এই তালিকায় সরকারি ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। তাদের ক্যাপিটাল পেতে সময় লাগে। নানা প্রক্রিয়া শেষে তারা পায়। আর একেক ব্যাংকের একেক ধরনের সমস্যা। কেউ ঋণ খেলাপি নিয়ে, কেউ অন্য সমস্যায় থাকে। আমরা এটা মনিটরিং করে নিয়মিত পরামর্শ ও নীতিমালা করে দিই। কাউকে ব্যবসা পরিবর্তন করতে বলি। কাউকে পরিস্থিতির উন্নয়ন না হওয়া পর্যন্ত ঋণ দিতে নিষেধ করি।”
তার কথা,"ইসলামী ধারার ব্যাংক নিয়ে নানা কথা হলেও বাস্তবে তাদের অবস্থা বেশ ভালো। তারা আয়ের দিক থেকে, আমানতের দিক থেকে, রেমিট্যান্সের দিক থেকে এখনো প্রচলিত ব্যাংকের চেয়ে ভালো করছে।”
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ হাজার কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০.১১ শতাংশ।