1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

ব্যাংক খাতের দুর্দশা যেন দীর্ঘায়িতই হচ্ছে

৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সময় যতো গড়াচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সংকট যেন ততো বাড়ছে৷ বিভিন্ন সূচকে যেমন এর প্রতিফলন ঘটছে, তেমনি বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহেও তার সমর্থন মিলছে৷

Flash-Galerie Bengalische Banknoten
ছবি: DW

যদিও নীতি-নির্ধারক মহলের কাছে ব্যাংক খাতের সংকটের বিষয়টি তেমন উদ্বেগজনক নয় বলে পরিলক্ষিত হয়৷ তার অন্যতম কারণ হলো, বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংকে লালবাতি জ্বলেনি বা কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে বসে যায়নি৷

অবশ্য লালবাতি না জ্বলার বিষয়টা পুরোপুরি ঠিক নয়৷ ২০০৬ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে লালবাতি জ্বললেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রশাসক বসিয়ে ও পরবর্তীতে বেশিরভাগ শেয়ার বিক্রি করে নতুন মালিকানায় আইসিবি ইসলামী ব্যাংক নামে জিইয়ে রাখে৷ ২০১৩ সালে চালু হওয়া ফারমারস ব্যাংক অল্প সময়ের মধ্যে ডুবতে বসেছিল৷ সরকার পাঁচটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করে ৭১৫ কোটি টাকায় ফারমার্স ব্যাংকের ৬০ শতাংশ শেয়ার কিনে নিতে৷ ব্যাংকের নাম বদলে হয় পদ্মা ব্যাংক৷  দেখা যাচ্ছে, চোখের সামনে দিনের পর দিন অনিয়ম-দুর্নীতি ঘটে গেলেও তা রোধ করার সক্রিয় পদক্ষেপ থাকে সীমিত৷ বরং, ভরাডুবির শেষ পরযায়ে গিয়ে কোনোভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য টাকা ঢালা হয়৷

বাংলাদেশে এখন ৬১টি ব্যাংক সক্রিয়৷ এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক আছে নয়টি৷ বেসরকারি খাতের ব্যাংকের সংখ্যা ৪৩৷ এসব ব্যাংক গড়ে উঠেছে ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগে৷ এর মধ্যে ১০টি ইসলামী ব্যাংক৷  পাশাপাশি দেশে নয়টি বিদেশি ব্যাংকের কার্যক্রম রয়েছে ৷

তবে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর একটা বড় অংশই বিভিন্নরকম অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে দুর্বল ও নাজুক হয়ে পড়ছে যার পেছনে আবার রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে৷ কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা একটি বড় শিল্পগোষ্ঠীর কব্জায় চলে যাওয়া এবং ইসলামী ব্যাংকের মতো দেশের অন্যতম সেরা ও প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংককে দ্রুত বিপরযয়ের দিকে ঠেলে দেয়ার মধ্য দিয়েও প্রতীয়মান হয় যে রাজনৈতিক প্রভাবের বিস্তৃতি কতোটা ক্ষতি করে দিচ্ছে৷

এ বছরের আগস্ট মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করেছে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০২২ (ফাইনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০২২) ৷ এই প্রতিবেদন থেকে ব্যাংকখাতের দুর্দশা সম্পর্কে অনেকটা ধারণা করা যায়৷ এতে দেখা যায় যে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের মোট সম্পদের পরিমাণ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে কিছুটা বাড়লেও সম্পদ বাড়ার হার কমে গেছে৷ ২০২১ সালে যেখানে এই হার ছিল ১১ শতাংশ সেখানে ২০২২ সালে তা হয়েছে সাড়ে সাত শতাংশ৷ এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ব্যাংকখাতের সম্পদের সার্বিক গুণগত মান কিছুটা হলেও কমে গেছে৷ আর এর মূল কারণ হলো মোট খেলাপি ঋণের অনুপাত বেড়ে যাওয়া৷ ২০২১ সাল শেষে যেখানে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছিল খেলাপি ঋণ, তা ২০২২ সালের শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ৷ 

আবার মোট খেলাপি ঋণের ৮৮ দশমিক ৬৭  শতাংশই হলো মন্দ ও লোকসানি স্তরের৷ বাকি প্রায় সাত শতাংশ নিম্নমানের আর সাড়ে চার শতাংশ সন্দেহজনক স্তরের ঋণ৷ গত এক দশকে এই হার ক্রমাগত বেড়ে ২০২২ সাল শেষে এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ ২০১২ সালে মোট খেলাপি ঋণের ৬৬ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল মন্দ ও লোকসানি স্তরের৷

আসজাদুল কিবরিয়া, পরিকল্পনা সম্পাদক, দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেসছবি: Privat

পরিমাণগতভাবে ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা৷ তবে খেলাপির তুলনায় ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ চার গুণ বেশি৷ বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি, পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা৷ শুধু ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পাঁচ বছরেই ব্যাংকগুলো এক  লাখ ২০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে৷

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের উচ্চহারে খেলাপি ঋণ ও ঋণ সংক্রান্ত অনিয়মের জন্য দায়ী প্রধানত প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের ঘাটতি৷ রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো অনেক আগে থেকেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত৷ তবে দুই দশক আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে সরকার কিছু জোরালো সংস্কার শুরু করেছিল৷ তার ফলে কিছু অগ্রগতিও হয়েছিল৷ তবে এক পর্যায়ে এসে ক্ষমতার পালা-বদলের পর সংস্কারের বাকি কাজ থমকে যায়৷ তার বদলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ঋণ প্রদান বাড়তে থাকে যা আবার খেলাপি ঋণ বাড়ায়, ব্যাংকগুলোকে নাজুক হওয়ার দিকে ঠেলে দেয়৷ পাশাপাশি বেসরকারিখাতের অনেকগুলো ব্যাংক পরিচালকদের মাত্রাতিরিক্ত দৌরাত্ম্যের শিকার হয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে৷ বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণ৷

ব্যাংকের পরিচালকদের দৌরাত্ম্য বাড়ানোর জন্য আইনগতভাবেই সুযোগ তৈরি করা হয়েছে৷  এজন্য গত এক দশকে দু'দফা ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়৷ ২০১৩ সালের সংশোধনীতে একজন পরিচালককে দুই দফায় ছয় বছরের জন্য পদে থাকার বিধান রাখা হয়৷ ২০১৮ সালে সেই মেয়াদ বাড়িয়ে নয় বছর করা হয়৷ আর চলতি বছর জুন মাসে বাজেট অধিবেশনে আইনের এই ধারা আবার সংশোধন করে একজন পরিচালকের মেয়াদ বাড়িয়ে ১২ বছর করা হয়েছে৷ এর ফলে গুটিকয়েক ব্যাংক পরিচালকই বছরের পর বছর পরিচালনা পরিষদে থেকে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবেন যা অনেক বেসরকারি ব্যাংককে আরো সমস্যায় ফেলতে পারে বলে আশংকা রয়েছে৷

অবশ্য এখন আইন অনুসারে একই পরিবার থেকে চারজনের বদলে সর্বোচ্চ তিনজন সদস্য কোনো বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে থাকতে পারবেন৷ এটা প্রতিপালন করার জন্য জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই একটি নির্দেশনা জারি করেছে৷ দেখার বিষয় ব্যাংকগুলো কতো দ্রুত এটা বাস্তবায়ন করে৷ তবে একজন পরিচালকের মেয়াদ নয় বছরের জায়গায় ১২ বছর করার মধ্য দিয়ে পরিবারিক প্রভাব কমানোর প্রয়াস অর্থবহ হবে না, তা বলাই বাহুল্য৷

আবার গত বছরের শেষে দেশের ব্যাংক খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা৷ একই সময়ে মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা৷ সেই হিসাবে মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ৷ আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে দেয়া বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে এই চিত্র পাওয়া গেছে৷

একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এই যে ব্যাংকের সমস্যা, সংকট বা বিপর্যয় নিয়ে চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন হওয়া কেন? উত্তরটা হলো: ব্যাংক খাত অর্থনীতির প্রায় সকল খাতের সাথে জড়িত, জড়িত কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে৷ সাধারণ মানুষ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে কিছু নিরাপদে সঞ্চয় করার জন্য ব্যাংকে জমা রাখে আমানত হিসেবে৷ এই আমানতের টাকা দিয়েই ব্যাংক ব্যবসা ও বিনিয়োগ করে বা ঋণ দেয়৷ আর তাই ঋণ যতো খেলাপি হয়, যত বেশি অনাদায়ী ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়, ততো আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে৷ পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য ঋণ প্রদানের সুযোগ কমে আসে৷ ২০২২ সালে মোট ব্যাংক ঋণের এক চতু্র্থাংশের সামান্য বেশি বা ২৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ কেন্দ্রিভূত ছিল বড় শিল্পখাতে৷ সার্বিকভাবে ঋণ কেন্দ্রিভূত হওয়ার ঝুঁকি ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সামান্য বেড়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷

ব্যাংকখাতের সমস্যা-অনিয়ম-কেলেংকারি-সংকট নিয়ে দীর্ঘ আখ্যান রচনার অবকাশ এখানে নেই৷ যদিও এসব অনিয়মের সামান্যই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় বা হতে পারে৷ তবে সাদাচোখেই এখন বোঝা যায় যে অনিয়ম-দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে গোটা ব্যাংকখাতে এবং সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে৷ আর তাই আশংকা রয়েছে অর্থনীতির চলমান সংকটকে প্রলম্বিত করতে পারে ব্যাংক খাতের দুর্দশা৷

সব ব্যাংকের ব্যাংক ও শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এই দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে যথেষ্ট পরিপক্কতা দেখাতে পারছে বলেও প্রতীয়মান হচ্ছে বার বার৷ বিভিন্ন মহল থেকে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে বলা হচ্ছে যে নিয়ন্ত্রক হিসেবে সঠিক নজরদারিতে পিছিয়ে রয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷

লেখক: পরিকল্পনা সম্পাদক, দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ঢাকা মতামত নিজস্ব৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ