1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

ব্যাংক খাতে লুটপাট নীতি

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের এক নম্বর সমস্যা কী? এই প্রশ্ন যত জন বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করেছি তারা সবাই বলেছেন খেলাপি ঋণ৷ বিশেষজ্ঞ কেন, সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন করলেও একই জবাব পাওয়া যায়৷

Bangladesch | Große Gebäude in Dhaka | Bank
ছবি: Mortuza Rashed/DW

তারা মনে করেন, সাধারণ মানুষের টাকা লুটপাটের সহজ উপায় হলো ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা নেয়া এবং ফেরত না দেয়া৷

বিশ্লেষকেরা এটাকে বলছেন টাকা লোপাটের আনুষ্ঠানিক কৌশল৷ আর দেশের এই অর্থ যারা লুট করেন তারা সেটা আবার পাচার করে দেন দেশের বাইরে৷ কিন্তু এর জন্য থাকতে হবে রাজনৈতিক ক্ষমতা, হতে হবে সপরিবারে ব্যাংকের পরিচালক অথবা থাকতে হবে প্রভাবশালী ও শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক৷

এই সময়ে ব্যাংকের তারল্য সংকট, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে ব্যাংক চালানো, প্রবলেম ব্যাংক এই সবকিছুর মূলে রয়েছে এই খেলাপি ঋণ৷ কারণ এখান থেকেই সব সংকটের উৎপত্তি৷ ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আমানতের বিপরীতে কম সুদ দিচ্ছে৷ আর গ্রাহকরা সেই কারণে ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দিয়েছেন৷ যা থেকে আসছে তারল্য সংকট৷ তারও মূলেও এই খেলাপি ঋণ৷ কারণ খেলাপি ঋণের যে ক্ষতি তা কম সুদ দিয়ে পুষিয়ে নিতে চায় ব্যাংক৷ একই সঙ্গে এই পরিস্থিতি ব্যাংকে আস্থার সংকট তৈরি করে৷ বাংলাদেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা৷

সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘এই সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন খেলাপি ঋণ ছিলো ২২ হাজার কোটি টাকা৷ এখন সেটা এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে৷ এর মূল কারণ ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব৷ এখানে সত্যিকারের ঋণখেলাপি আর ইচ্ছকৃত ঋণখেলাপি আলাদা করা হয়নি৷ যারা ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে ঋণখেলাপি হয়েছেন তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি৷’’

তার কথা,‘‘ব্যাংক খাতে যে সংস্কার করার কথা ছিল তা করা হয়নি৷একই পরিবারের চারজন একটি ব্যংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারছেন৷ আগে ছিলো সর্বোচ্চ দুইজন৷  আর আগে পরিচালকরা সর্বোচ্চ ৯ বছর থাকতে পারতেন সেটা বাড়িয়ে ১২বছর করা হয়েছে৷’’

আত্মীয়-স্বজনেরা মিলে ব্যাংক চালায়: মো. নুরুল আমিন

This browser does not support the audio element.

‘‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো ব্যাংকগুলোর অভিভাবক ৷ আমরা দেখছি তাদের নজরদারি ঠিকমতো হয় না৷  বছরের পর বছর ঋণের এই খেলাপি চলছে৷ কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না৷ আমরা কমিশন করে রিপোর্ট দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য বলেছি৷ কিন্তু হচ্ছে না,’’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ৷

গত জুনের হিসাব বলছে বাংলাদেশের ১১টি ব্যাংক ব্যাংকে মোট ৩৩ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি রয়েছে৷  এসবের মধ্যে আছে কৃষি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক৷ এর পাঁচটি ব্যাংকই হলো রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক৷ গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবলেম ব্যাংক হিসেবে ১০টি ব্যাংককে চিহ্নিত করে৷ যদিও নাম প্রকাশ করা হয়নি৷ এরপর এই ধরনের নয়টি দুর্বল ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক৷

বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম আর লুটপাটের সর্বশেষ উদাহরণ ইসলামী ব্যাংক৷ পরিস্থিতি সামলাতে তাই ইসলামী ব্যাংকের শাখাগুলোর  ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে৷ মন্দার মধ্যেই গত বছর ইসলামী ব্যাংকে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে৷ এস আলম গ্রুপ একাই ওই ব্যাংক থেকে নিয়মের তোয়াক্কা না করে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়৷ এস আলম গ্রুপের কর্ণধারেরাই আবার ব্যাংকটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত৷  ব্যাংকটিকে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ধার দিয়ে সচল রাখাছে৷ ইসলামি ধারার আরো কিছু ব্যাংক এখন সংকটে রয়েছে৷ ইসলমি ব্যাংকসহ শরিয়া ভিত্তিক ছয়টি ব্যাংক এখন বাংলাদেশ ব্যাংককে জরিমানা দিচ্ছে প্রতিদিন৷ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে না পারায় তাদের এই জরিমানা গুণতে হচ্ছে৷ ইসলামী ব্যাংক  ছাড়া অন্য পাঁচটি ব্যাংক হলো: সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক৷ এর মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন৷ এসব ব্যাংক গত বছরের ডিসেম্বর থেকে তারল্য ঘাটতিতে রয়েছে৷

ব্যাংকের টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে অবৈধ উপায়ে৷ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র এই ব্যাংকগুলো দুর্বল হওয়ায় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে এর প্রভাব পড়ছে৷ বিনিয়োগ বাড়ছে না৷  ফলে কর্মসংস্থান বাড়ছে না৷

যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নুরুল আমিন বলেন,‘‘ব্যাংককে হতে হবে ব্যবসায়ী বান্ধব৷ তারা যদি ব্যবসায়, শিল্পে সহায়তা করে তাহলে এই খাত শক্তিশালী হবে৷ অর্থনীতি লাভবান হবে৷ রাজনৈতিক বিবেচনায় তারা কাজ করে বা করতে বাধ্য হয়৷ ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে৷ ব্যাংকগুলো দুর্বল হচ্ছে৷  যারা খেলাপি ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা লুটে নিচ্ছে, দেশের বাইরে পাচার করছে৷ তাদের আমরা শাস্তির আওতায় আসতে দেখিনি৷’’

‘‘আর এখনআত্মীয়-স্বজনেরা মিলে ব্যাংক চালায়৷ তারা নিজেরা ইচ্ছেমত ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়৷ আবার অন্যদের ঋণ পেতে সহায়তা করে তাদের ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়৷ এটা এখন ঋণ লেনদেনের ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে৷ আর যেটা অনেক ক্ষেত্রেই লুটপাট,’’ বলেন এই ব্যাংকার৷

তার কথা,‘‘বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা মনিটরিং করে৷ কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ব সব ব্যাংকে তারা মনিটরিং করতে পারে না৷ আবার প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে কিছু করতে পারে না৷ এখানে মূল বিষয়টি হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব৷’’

বাংলাদেশে এখন মোট ৬১টি তফসিলি ব্যাংক রয়েছে৷ এর মধ্যে ৪৩টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক৷ এছাড়া বিশেষায়িত, তফসিলের বাইরের ও বিদেশি ব্যাংক আছে৷ নতুন আরো পাঁচটি ব্যাংককে অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷ জিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ারও কাজ শুরু হয়েছে৷

সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হেলালউদ্দিন মনে করেন, ‘‘সুশাসনের অভাবে চালু ব্যাংকগুলোর দুরাবস্থা৷ এটা অর্থনীতির যে খারাপ অবস্থা তারই প্রতিফলন৷ সাধারণ মানুষের আমানত ঝুঁকির মুখে আছে৷ তাই  যে ব্যাংকগুলো আছে সেখানে আগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি৷ নতুন ব্যাংকের অনুমতি দিয়ে নতুন প্রবলেম ব্যাংক সৃষ্টির কোনো মানে হয় না৷’’

যারা ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে ঋণখেলাপি হয়েছেন তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি: ড. মোস্তাফিজুর রহমান

This browser does not support the audio element.

ব্যাংকগুলোর এই পরিস্থিতির কারণে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দিয়েছে৷ সাধারণভাবে দেশে মোট অর্থের  ১০-১২ শতাংশ মানুষের হাতে নগদ থাকার কথা৷ এই অর্থ দিয়ে তারা দৈনন্দিন চাহিদা ও বিভিন্ন কেনাকাটা করেন৷ কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এখন মানুষের হাতে নগদ অর্থ ১৬ শতাংশ৷

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত জুন শেষে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা৷ সাধারণভাবে দুই লাখ ৫৫ হাজার থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা মানুষের হাতে নগদ থাকে৷ এর আগে কয়েকটি ব্যাংকের জালিয়াতির তথ্য সামনে আসার পরও গত ডিসেম্বরে মানুষের হাতে ছিল সর্বোচ্চ দুই লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা৷

আর ব্যাংকিং খাতে এখন অতিরিক্ত তারল্য আছে তিন হাজার ৯০৯ কোটি টাকা৷ এক বছর আগে অতিরিক্ত তারল্য ছিলো দুই লাখ তিন হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা৷ 

মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘‘রাজনৈতিকভাবে ভাবলে মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷ অর্থনেতিকভাবে ভাবলে ব্যাংকে টাকা রাখা কেউ কেউ অর্থনৈতিকভাবে লাভের মনে করছেন না৷ ব্যাংকের  সাথে কাস্টোমারের সম্পর্ক হলো আস্থার৷ সে তার ইচ্ছে মতো টাকা জমা দিতে পারবে, ইচেছ মত তুলতে পারবে৷ কাউন্টারে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনি টাকা তুলছেন কেন তাহলেই সমস্যা৷’’

তার কথা,‘‘ব্যাংকখাত যত কম নেগেটিভ নিউজ তৈরি করবে তত তার ওপর মানুষের আস্থা থাকবে৷ এখন ঋণ খেলাপি, অর্থ পাচারসহ নানা ধরনের খবর ব্যাংকের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি করে৷ এগুলো ঠিক করতে না পারলে ব্যাংকগুলোকে আস্থার জায়গায় নেয়া কঠিন৷’’

ড. হেলালউদ্দিন বলেন, ‘‘কীভাবে সম্ভব যে বাংলাদেশে একজন ব্যক্তি সিংহভাগ ব্যাংকের মালিক হয়ে গেল৷ এর ফলে তার  ওপর এই খাতটি এককভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ল৷ তিনি চাইলে অনেক কিছু ব্যাংক খাতে প্রভাবিত করতে পারেন৷ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও কঠিন৷ কারণ ব্যবস্থা নিলে যদি আরও অস্থিরতা তৈরি হয়৷’’

তার কথা,‘‘ব্যাংক খাতে এই যে লুটপাট এর ভাগ ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত আরও অনেকে পাচ্ছেন৷ ফলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না দিয়ে উল্টো সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে৷  এই অবস্থা না হলে ব্যাংকে ১০০ টাকা রেখে আমি কমপক্ষে ১৫ টাকা মুনাফা পেতাম৷ এখন পাই ছয়-সাত টাকা৷ কারণ তারা আমাকে কম মুনাফা দিয়ে লুটপাটের ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ