ব্যাংক সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা: চ্যালেঞ্জ ও আশঙ্কা
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
ব্যাংক খাতের অসুখ সারাতে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জ) করার পরিকল্পনা করছে৷ তবে তার আগে দুর্বল ব্যাংকগুলো দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার সময় পাবে৷
বিজ্ঞাপন
সে কারণে কতটি ব্যাংক তার অস্তিত্ব বিলোপ করে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সবল হবার যাত্রায় অংশ নিতে বাধ্য হবে, তা এখনই নিশ্চিত নয়৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাছের ব্যাংক খাতে সংস্কারের রেডম্যাপ প্রকাশ করেন ৪ ফেব্রুয়ারি৷ সেখানে ১৭টি কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়৷ যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো: দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা, খেলাপি ঋণ কমানো, খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতি বন্ধ করা, ব্যাংকে যোগ্য পরিচালক নিয়োগে ব্যবস্থা করা, উপযুক্ত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ৷
এসবের মূল টার্গেট হলো খেলাপি ঋণ কমিয়ে যৌক্তিক মাত্রায় নিয়ে আসা এবং ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা৷
বাংলাদেশ ব্যাংক এসব লক্ষ্য পূরণের সময়সীমা ঠিক করেছে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত৷
দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে
ব্যাংক সংস্কারের ঘোষণা দেওয়ার আগেই ২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক' নামে একটি সার্কুলার দেয়৷ দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সংকট কাটিয়ে সক্ষম করার জন্য ওই ফ্রেমওয়ার্ক করা হয়৷ তাতে বলা হয়, যারা দুর্বলতা কাটাতে পারবে না তাদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক৷
সার্কুলারে বলা হয়, ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ থেকে পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক কার্যকর করা হবে৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, মার্জ করা হবে ২০২৫ সালের মার্চের পরে, তার আগে নয়৷ তার আগে কোনো দুর্বল ব্যাংক সবল হয়ে গেলে তারা আর মার্জিংয়ের নীতিতে পড়বে না৷ এই সময়ে সবল হতে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নীতি সহায়তা দেবে বলেও জানান ঐ কর্মকর্তা৷ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘খুব দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূত করার নীতি আরো স্পষ্ট করবে৷ যারা দুর্বল তাদের পূর্ণাঙ্গ অ্যাসেস করা হবে৷''
গ্রাহকদের ক্ষতি হবে কিনা তা নির্ভর করবে: আহসান এইচ মনসুর
‘কাজটি অনেক চ্যালেঞ্জিং'
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘যদি সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক মার্জ করতে হয় তাহলে দ্রুতই দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে হবে৷ নতুন যে পরিচালনা পর্ষদকে দায়িত্ব দেয়া হবে তাদের কাজ হবে ব্যাংকের দায় দেনা হিসাব এবং ব্যাংক দুর্বল হওয়ার জন্য কারা দায়ী তা চিহ্নিত করা৷ এরপর কাজ হলো সবল ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করা৷ কারণ সবল ব্যাংককে বললেই তো সে দুর্বল ব্যাংককে নেবে না৷ একটি দুর্বল ব্যাংককে মার্জ করার জন্য সরকার কত টাকা দেবে তা নির্ধারণ করা৷ এই সময়ে ব্যাংকের লোন দেয়াসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে৷ এটা অনেক চ্যালেঞ্জিং কাজ৷''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘গ্রাহকরা কোনো ক্ষতির মুখে পড়বেন কিনা তা নির্ভর করবে সরকারের বেলআউট পলিসির ওপর৷ সরকার যদি শতভাগ গ্যাপ পূরণ করে দেয় তাহলে গ্রাহকদের ক্ষতি হবে না৷ আর কিছু লোক তো চাকরি হারাবেনই৷ কারণ দুইটি ব্যাংক এক হলে, এক ব্যাংকের তো একই এলাকায় দুইটি শাখা থাকবে না৷ এখন তো দুইটি ব্যাংকেরই শাখা আছে৷ তবে তিন বছর পর্যন্ত ছাঁটাই করা হবে না বলা হচ্ছে৷''
তার কথা, ‘‘মার্জিং ভালো উদ্যোগ৷ এটা করতে পারলে অনেক ভালো হবে৷ কিন্তু এরজন্য সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন৷ শুরুতেই তো তিন বছর সময় নেয়া হচ্ছে৷ শেষ পর্যন্ত কী হয় দেখা যাক৷''
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের চিত্র
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি সবচেয়ে শোচনীয়৷ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত প্রতি ১০০ টাকার ২০ টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে৷ আরো জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO
খেলাপি ঋণ কী
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাহক তার ঋণ বা এর উপর আরোপিত সুদ পরিশোধ না করলে তা খেলাপি ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়৷ বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে৷ ছয় থেকে ১৮ মাসের বকেয়া ঋণকে নিম্নমানের, ১৮ থেকে ৩০ মাসের বকেয়াকে সন্দেহজনক এবং তার বেশি সময় পরিশোধ না হলে তা অনাদায়ের ঝুঁকিতে থাকা মন্দ ঋণ৷
ছবি: Mika Volkmann/picture alliance
আট শতাংশ
আইএমএফ থেকে নেয়া ঋণের শর্ত মেনে আগস্টে প্রকাশিত বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে গত বছরের খেলাপি ঋণের বিশদ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ সেই হিসাবে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের আট শতাংশের বেশি৷ সবশেষ মার্চের হিসাবে তা বেড়ে আট দশমিক আট শতাংশ হয়েছে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি
বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, এই পরিসংখ্যানেও খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না, কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায়ই নানা সুবিধা দিয়ে খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করে৷ সেগুলো তখন আর খেলাপির তালিকায় রাখা হয় না৷ ২০২২ সালে এমন বকেয়া পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা৷ আর বকেয়া খেলাপি ঋণ ছিল ৪৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।
ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO
দেশের বাজেটের অর্ধেক
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা৷ অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের এক বছরের বাজেটের অর্ধেকের সমপরিমাণ৷
ছবি: Xinhua News Agency/picture alliance
৮৮ শতাংশই মন্দ ঋণ
মোট খেলাপি হওয়া ঋণের সাড়ে ৮৮ শতাংশই আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে অনাদায়ী৷ অর্থাৎ, ব্যাংকগুলো গ্রাহককে তাগাদা দিয়েও সেগুলো আদায় করতে পারছে না বা পুনঃতফসিল করা যাচ্ছে না৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের শ্রেণি অনুযায়ী, যা মন্দ বা না পাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ঋণ৷
ছবি: MD Mehedi Hasan/ZUMA Press/picture alliance
পাঁচ ব্যাংকেরই অর্ধেক
বাংলাদেশে এখন মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি৷ এর মধ্য মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৬ শতাংশ ৫টি ব্যাংকের গ্রাহক৷ আর প্রথম দশটি ব্যাংকের প্রায় ৬৫ শতাংশ৷ আটটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের বেশি৷ এর তিনটি সরকারি, তিনটি বেসরকারি, একটি বিদেশি আর একটি বিশেষায়িত৷ ৩৮টি ব্যাংকের খেলাপির হার পাঁচ শতাংশের কম৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সরকারি ব্যাংকে ২০%
সরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত প্রতি ১০০ টাকার অন্তত ২০ টাকাই খেলাপি৷ বিশেষায়িত ব্যাংকে এটি প্রায় ১৩ শতাংশ৷ অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকে এই হার পাঁচ শতাংশের কিছু বেশি৷ তবে বেসরকারি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণ বেশি হওয়ায় তাদের খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ সরকারি ব্যাংকেরই সমান৷ খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে কম বিদেশি ব্যাংকগুলোর যা পাঁচ শতাংশেরও কিছু কম৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সরকারিতে বাড়ছে, বেসরকারিতে কমছে
গত এক বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ এক শতাংশ বেড়েছে৷ কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকে উল্টো দশমিক এক-আট শতাংশ কমেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক
খেলাপি ঋণে সবচেয়ে এগিয়ে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠানগুলো৷ মোট খেলাপির প্রায় ২৭ শতাংশ আছে তাদের কাছে৷ সব মিলিয়ে খেলাপির ৫৫ ভাগই শিল্প খাতের৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ফিরে দেখা
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশে পৌঁছায়৷ সত্তর ও আশির দশকে ব্যাংকগুলো যাথযথ নিয়ম মেনে ঋণ প্রদান না করায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে৷ তবে নজরদারি বৃদ্ধির কারণে ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১১ সালের দিকে খেলাপি ঋণের হার ৬.১ শতাংশে নামে৷ কিন্তু পরের বছর তা দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছায়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অন্যান্য দেশ
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি৷ বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় ভারতে এই হার সাড়ে ছয় শতাংশ, পাকিস্তানে সাত দশমিক তিন, নেপালে দুই দশমিক চার, শ্রীলংকায় প্রায় পাঁচ, মালদ্বীপে প্রায় ছয় শতাংশ৷ যেখানে বাংলাদেশ খেলাপি ঋণের হার আট শতাংশের বেশি৷
ছবি: Indranil Mukherjee/AFP/Getty Images
11 ছবি1 | 11
‘মার্জ হলে কিছু লোক চাকরি হারাবেন'
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘‘মার্জিং একটা ভালো উদ্যোগ৷ এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং সফল৷ কিন্তু এই ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি কী হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন৷''
তবে তিনি মনে করেন বাস্তবায়ন পর্যায়ে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে৷ ‘‘যেমন মার্জ করার জন্য সবল ও দুর্বলকে রাজি করানো, কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি থাকবে কিনা, রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হবে কিনা ইত্যাদি৷ একটি ব্যাংকের সঙ্গে আরেকটি ব্যাংককে মার্জ করতে বললেই তো হবে না৷ এটা সমঝোতার মাধ্যমে হতে হবে৷ তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে নীতিমালা স্পষ্ট করতে হবে৷ ডায়ালগ করতে হবে,'' বলেন আমিন৷
যমুনা ব্যাংকের সাবেক এই এমডি বলেন, ‘‘মার্জ হলে কিছু লোক চাকরি হারাবেন৷ তবে তিন বছরে তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে না৷ পলিসি স্পষ্ট হতে হবে৷ যাদের বিদায় করা হবে তাদের কী উপায়ে বিদায় দেয়া হবে তা আলোচনা করে ঠিক করতে হবে৷''
আর গ্রাহকদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘তাদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই৷ কারণ প্রথমত বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না৷ নজির নেই৷ আর গ্রাহকদের ব্যাপারটাও মার্জিং পলিসিতে থাকে৷''
মার্জ হলে কিছু লোক চাকরি হারাবেন: মো. নুরুল আমিন
গ্রাহকেরা কী বলছেন?
একটি ব্যাংকের গ্রাহক আতিকুর রহমান আকাশ বলেন, ‘‘সঠিক নীতিমালার ভিত্তিতে করলে আমার মনে হয় ভালোই হবে৷ তবে আমার আশঙ্কা, দুর্বল ব্যাংককে কাঁধে নিতে যেয়ে সবল ব্যাংকটি আবার দুর্বল হয়ে না যায়৷''
আরেক গ্রাহক শেখ আব্দুস সাত্তার লিমন বলেন, ‘‘মূল কথা হলো এটা কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হবে৷ দেখা যাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় সবল ব্যাংককে দুর্বলের তালিকায় ফেলা হবে৷ আবার দুর্বল ব্যাংককে সবলের তালিকায় রাখা হবে৷ তাহলে তো গ্রাহকরা লাভবান হবে না, তারা ভুল তথ্য পাবে৷ তবে দুর্বল ব্যাংক এখন গ্রাহকরা চেনে৷ সেখানে এমনিতেই তারা টাকা রাখা কমিয়ে দিয়েছে৷''
বাংলাদেশে এখন মোট বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি৷ মোট খেলাপি ঋণের ৬৩ শতাংশই আছে ১০টি ব্যাংকে৷ আর মূলধন ঘাটতিতে আছে ১৪টি ব্যাংক৷ তাদের মোট মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা৷ এর বাইরে পাঁচটি ইসলামি ধরার ব্যাংককে মূলধন ঘাটতি কাটাতে নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷
জানা গেছে, ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪০টি ব্যাংক মোটামুটিভাবে ভালো করছে৷ বাকিগুলোর অবস্থা খারাপ৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯.৯৩ শতাংশ৷ তবে দুর্দশাগ্রস্ত ও পুনঃতফসিল কিংবা অবলোপনের পরও আদায় না হওয়া ঋণের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকার বেশি, মোট ঋণের যা ২৬ শতাংশ৷
বাণিজ্য ও হুন্ডির আড়ালে টাকা পাচারের যত কৌশল
বৈধভাবে স্থানান্তরের সহজ উপায় না থাকলেও বিদেশে ঠিকই বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছেন অনেক বাংলাদেশি৷ বিপুল টাকা রাখছেন ব্যাংকেও৷ এই অর্থপাচারের কৌশলগুলো কী জেনে নিন ছবিঘরে...
ছবি: Fotolia/Trueffelpix
পণ্যের মূল্য বেশি দেখানো
ধরা যাক শিল্প কারখানার জন্য এক লাখ ডলারের যন্ত্র আমদানির ঋণপত্র খুললেন দেশের কোনো আমদানিকারক৷ কিন্তু এই পণ্যের প্রকৃত মূল্য ৫০ হাজার ডলার৷ মূল্য বাবদ ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি এক লাখ ডলার পাঠিয়ে দিলেন বিক্রেতাকে৷ সেই ব্যক্তি তার দামটি রেখে বাকি টাকা আমদানিকারকের বিদেশের কোনো অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেন৷ এতে দেশ থেকে ৫০ হাজার ডলার পাচার হয়ে গেল৷ টাকা পাচারের এই কৌশলটি পরিচিত ‘ওভার ইনভয়েসিং’ নামে৷
ছবি: Md Manik/ZUMA Wire/imago images
রপ্তানির মূল্য কম দেখানো
ধরা যাক দেশের কোনো রপ্তানিকারক ৫০ হাজার ডলারের পণ্য বা সেবা রপ্তানির ঘোষণা দিলেন, যদিও তার প্রকৃত মূল্য এক লাখ ডলার৷ পণ্য পৌঁছানোর পর ক্রেতা দেশে ৫০ হাজার ডলার রপ্তানিকারককে পাঠালেন, আর অঘোষিত ৫০ হাজার ডলার তার বিদেশের কোনো অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেন৷ মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে এভাবে রপ্তানিকারক দেশে অর্জিত ৫০ হাজার ডলার পাচার করলেন৷ টাকা পাচারের এই কৌশলটি পরিচিত ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ নামে৷
ছবি: Yu Fangping/Costfoto/picture alliance
পণ্যের পরিমাণে হেরফের
শুধু টাকার গড়মিল না, আমদানি বা রপ্তানিকৃত পণ্যের হিসাবের গড়মিলের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়৷ যেমন, কোনো রপ্তানিকারক ৫০ হাজার পিস পোশাক রপ্তানির ঘোষণা দিয়ে এক লাখ পিস রপ্তানি করতে পারেন৷ এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ৫০ হাজার পিসের টাকা তিনি বিদেশে পাচার করলেন৷ উল্টোভাবে আমদানিকৃত পণ্যের পরিমাণ অতিরিক্ত দেখিয়ে বেশি দাম পরিশোধের মাধ্যমে টাকা পাচার হতে পারে৷
ছবি: Saudi Press Agency/REUTERS
ভুয়া কাগজপত্র তৈরি
বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচারের আরেকটি উপায় হলো ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা৷ কোনো পণ্য আমদানি না করেই ভুয়া ঋণপত্র এবং শুল্ক ও বন্দর কর্তৃপক্ষের ভুয়া ছাড়পত্র দেখিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়৷ অনেক সময় একই পণ্যের আমদানির বিপরীতে একাধিক ঋণপত্র খুলে সেই পণ্যের নামে একাধিকবার টাকা পাঠানো হয়৷ সহজে যাতে ধরা না পড়েন তার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন টাকা পাচারকারীরা৷
ছবি: imago/blickwinkel
টাকা পাঠানোর ভিন্ন চ্যানেল বা হুন্ডি
প্রবাসীরা জটিলতা এড়াতে স্বীকৃত পদ্ধতির বদলে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠান, যা হুন্ডি নামে পরিচিত৷ এই পদ্ধতিতে তারা বিদেশে কোনো ব্যক্তির কাছে বা কোনো মাধ্যমে টাকা হস্তান্তর করেন৷ হুন্ডি পরিচালনাকারী নেটওয়ার্ক সমপরিমাণ টাকা প্রবাসীর পরিবারকে পরিশোধ করে দেয়৷ এতে পরিবার টাকা বুঝে পেলেও প্রবাসীর অর্জিত মূল্যবান অর্থ দেশে পৌঁছে না৷ টাকা পাচার করতে চান- এমন কারো বিদেশি অ্যাকাউন্টে হয়ত তা চলে যায়৷
ছবি: Imago/Steinach
কর স্বর্গে ছায়া কোম্পানি
পাচার করা অর্থ বিদেশে রাখা ও কর ফাঁকি দেয়ার আরেকটি প্রচলিত উপায় হলো ‘কর স্বর্গ’ হিসেবে পরিচিত দেশগুলোতে বেনামে কোম্পানি খোলা৷ এই কোম্পানিগুলোর সাধারণত কাগজ-কলমেই অস্তিত্ব থাকে৷ কয়েক স্তরে এমনভাবে এর মালিকানা আড়াল করা হয় যে প্রকৃত ব্যক্তির নাম জানা কঠিন হয়ে পড়ে৷ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ জমা রাখা, নিজ দেশের বড় অংকের কর ফাঁকি দেয়া ও পাচারকৃত টাকা আড়াল করতে এই ধরনের কোম্পানি ব্যবহারের অভিযোগ আছে৷
ছবি: Imago/M. Bäuml
বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব
বিনিয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি মেলে৷ উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশের ধনী ও দুর্নীতিগ্রস্তরা এই সুযোগ লুফে নেন৷ ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপের মাল্টা, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, লুক্সেমবুর্গে বিদেশিদের জন্য এমন স্কিম আছে৷ এই ‘গোল্ডেন ভিসা স্কিম’-এর মাধ্যমে ইইউ দেশগুলো গত দশকে আড়াই হাজার কোটি ডলার আয় করেছে৷ এর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী সাইপ্রাস ও স্পেন৷
ছবি: DW/A. de Loore
কর স্বর্গে বাংলাদেশিরা
পানামা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড কিংবা হংকংয়ের মতো কর স্বর্গে বিভিন্ন সময়ে কোম্পানি খুলেছেন বাংলাদেশিরাও৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম আইসিআইজে-র ফাঁস হওয়া চারটি নথিতে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ১০২ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে হাইকোর্টের নির্দেশে দুদক ২০২১ সালে পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে উঠে আসা ৪৩টি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা আদালতে জমা দিয়েছে৷
ছবি: Fotolia/Trueffelpix
বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে পাচার
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০২১-২২ অর্থবছরে শতকরা ২০ থেকে ২০০ শতাংশ অতিরিক্ত আমদানি মূল্যের ৮,৫৭১টি অর্থপাচারের ঘটনা শনাক্ত করে৷ এই সংখ্যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬২.৩৩ শতাংশ বেশি৷ ২০২৩ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩৩টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর৷ ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বছরে চার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের হিসাবে, বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করে কর ফাঁকির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা প্রায় চার হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা হারাচ্ছে৷ এই অর্থ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেটের ৩১ শতাংশ ও শিক্ষার ছয় শতাংশের বেশি৷ মাথাপিছু হিসাবে দুই ডলার বা ২০০ টাকার উপরে৷ এর মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ৩৭ কোটি ডলার ও ব্যক্তি পর্যায়ে ফাঁকির পরিমাণ দুই কোটি ৬০ লাখ ডলার৷
ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO
গোল্ডেন ভিসায় বাংলাদেশিরা
বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি নেয়ার পদ্ধতি পরিচিত গোল্ডেন ভিসা স্কিম নামে৷ গত কয়েক বছরে ক্যানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের এই সুযোগ নেয়ার খবর উঠে এসেছে৷ যেমন মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে ন্যূনতম এক লাখ ২৫ হাজার ডলার বিনিয়োগ করতে হয়৷ দেশ থেকে বৈধভাবে এত টাকা স্থানান্তরের সুযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের নাগরিকেরা এই স্কিম ব্যবহারে উপরের দিকে আছেন৷
ছবি: bdnews24.com
পরিসংখ্যানে অর্থ পাচার
কোন দেশ থেকে কত টাকা পাচার হয় তা বোঝার একটি কৌশল আমদানি-রপ্তানি করা দেশ ও গন্তব্যের পরিসংখ্যান তুলনা করা৷ তার ভিত্তিতে ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি জানাচ্ছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে বছরে সম্ভাব্য ৮২৭ কোটি ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে৷ অন্যদিকে, ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমান ছিল ৮৭ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা আট হাজার কোটি টাকার বেশি৷