ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হবার পর বরিস জনসন তাঁর প্রথম বিদেশ সফরের জন্য জার্মানিকেই বেছে নিয়েছিলেন৷ তাঁর নিজের শর্তে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়ানোর একমাত্র আশা ছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ ব্রেক্সিট চুক্তির মধ্যে রদবদলের ক্ষীণ আশ্বাস আদায় করতে পারলেও তার বদলে কঠিন দায়িত্ব নিয়ে লন্ডনে ফিরতে হলো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে৷ আয়ারল্যান্ড সীমান্তে ‘ব্যাকস্টপ' ব্যবস্থা নিয়ে জনসনের ঘোর আপত্তির প্রেক্ষাপটে ম্যার্কেল তাঁকে ৩০ দিনের মধ্যে বিকল্প প্রস্তাব পেশ করার চ্যালেঞ্জ করেছেন৷
এমন অবস্থায় চুক্তিহীন ব্রেক্সিট হলে সেই ব্যর্থতার দায় ইউরোপের উপর চাপিয়ে দেওয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়লো৷ ব্যাকস্টপের বদলে ‘কিছু একটা সমাধানসূত্র' উঠে আসবে বলে এতকাল দাবি করে আসছিলেন বরিস জনসন৷ কিন্তু তিনি এখনো এই মর্মে কোনো স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত প্রস্তাব পেশ করেন নি৷ বৃহস্পতিবার তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ-র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় আদায় করতে পারবেন না, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ ম্যার্কেল ক্ষীণ আশ্বাস দিলেও মাক্রোঁ বুধবার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে কোনোরকম আলোচনা সম্ভব নয়৷ চুক্তিহীন ব্রেক্সিট কার্যকর হলে সেই দায় সম্পূর্ণ ব্রিটেনকেই নিতে হবে, বলেন তিনি৷
ম্যার্কেল নিজেও ব্রেক্সিট চুক্তির মধ্যে রদবদলের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন৷ তবে বর্তমান অচলাবস্থা কাটাতে তিনি এই চুক্তি অনুমোদনের পর ব্যাকস্টপের বদলে আইরিশ সীমান্তে দ্রুত কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা চালু করার পক্ষে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিটেনের বিচ্ছেদের পর দুই পক্ষের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক স্থির করার সময় এই প্রশ্নের মীমাংসা খোঁজার কথা ছিল৷ সেই সমাধানসূত্র এখনই পাওয়া গেলে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থিদের ব্যাকস্টপ সংক্রান্ত আপত্তির আর কোনো কারণ থাকবে না, ম্যার্কেল এমনটাই আশা করছেন৷ তবে সেই দায় তিনি ব্রিটেনের উপরেই চাপিয়ে দিয়েছেন৷ ফলে জনসন ও কট্টর ব্রেক্সিটপন্থিদের ব্যাকস্টপ-বিরোধিতার বদলে এবার গঠনমূলক প্রস্তাব পেশ করতে হবে৷
বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার পর জনসন দেশে ফিরে ইইউ-বিরোধিতার বদলে গঠনমূলক সমাধানসূত্রের লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে উঠবেন, এমনটা ধরে নেওয়া কঠিন৷ আগামী ৩১শে অক্টোবরের মধ্যে ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্য বিকল্প খুঁজে ইইউ-র সম্মতি আদায় করে সংসদে ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদন করানো অত্যন্ত কঠিন কাজ৷ ব্রিটিশ সংসদে ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদন করানোর পর ইইউ পার্লামেন্ট ও সদস্য দেশগুলিকেও সেই চুক্তি অনুমোদন করাতে হবে৷ তবেই চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়ানো সম্ভব হবে৷ অথবা ব্রিটিশ সরকারকে এই সময়সীমা আবার পেছানোর আবেদন করতে হবে৷ আগাম সংসদ নির্বাচন ও ব্রেক্সিট পুরোপুরি বাতিল করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (ডিপিএ, রয়টার্স, এএফপি)