গাছের গুঁড়ির মাপ ৮৬ সেন্টিমিটার৷ ব্রাজিলের প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের জীববিজ্ঞানীরা সবার আগে এমন এক গাছ পরিমাপ করছেন৷ মনিটরিং কর্মসূচি এভাবেই শুরু হচ্ছে৷ এই সংরক্ষিত এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে এখনো নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই৷ এখানকার ইকোসিস্টেমের বিকাশ কী রকম হচ্ছে? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কী? এখনো পর্যন্ত শুধু অনুমান করা হয়ে এসেছে৷ বায়োলজিস্ট ভিক্টর লিমা বলেন, ‘‘অনেক গাছ আবহওয়ার বিষয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল৷ কিছু গাছ বড় হয় না বা তারা পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তারা ইকো-সিস্টেমের মধ্যে তাদের জায়গা হারিয়ে ফেলে৷'' আরেক বায়োলজিস্ট নায়ারা স্টাচেস্কি বললেন, ‘‘আমাদের মনিটরিং কর্মসূচি ঠিক সেটাই দেখাতে চলেছে৷ এই জঙ্গলে কী প্রভাব দেখা যাচ্ছে? এখনো তা জানি না বটে, তবে আমাদের বিশ্বাস, প্রভাব অবশ্যই পড়ে৷''
আমাজনের রেইনফরেস্ট ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে৷ গাছ কাটা এবং জঙ্গল পোড়ানোর কারণে কেবল এই বছরেই ধ্বংস হয়েছে ৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার বন৷
ছবি: Reuters২০১৩ সালে ব্রাজিলের রেইনফরেস্ট উজারের চিত্রটা আরো পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ ওয়ারশ শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ব্রাজিলের পরিবেশমন্ত্রী ইসাবেলা টেইশেইরা উল্লেখ করেন, এ বছরের নভেম্বরের মধ্যে আমাজনের ৫,৮৪৩ বর্গ কিলোমিটার বন উজাড় হয়েছে৷ ২০১২ সালে যেখানে ৪,৫৭১ বর্গ কিলোমিটার বন উজাড় হয়েছিল৷ ২০০৪ সালে আমাজনের ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার বন উজাড় হয়েছিল, যা একটি রেকর্ড৷
ছবি: picture alliance/Wildlifeসয়া এবং গম চাষ আমাজনের রেইনফরেস্ট উজাড়ের জন্য অনেকটা দায়ী৷ ব্রাজিলের পারা রাজ্যের বন এ কারণে সবচেয়ে বেশি উজাড় হয়েছে৷ ২০১২ সালের আগস্ট থেকে ২০১৩-র জুন পর্যন্ত সেখানে ১৩৬ ভাগ বন ধ্বংস হয়েছে৷ পারার কাছের নভো প্রোগ্রেসো শহর গড়ে তুলতে ৪০০ হেক্টর জমি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল৷
ছবি: Reutersআমাজনে ব্রাজিলের ২০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র পাঁচ ভাগ আদিবাসী থাকলেও, সেখানে বাঁধ নির্মাণ ক্রমেই বেড়ে চলছে৷ আমাজন অঞ্চলে টেলেস পিরেস পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১৫ সালে চালু হওয়ার কথা৷ এর মধ্যে মাত্র একভাগ আমাজনের অধিবাসীদের জন্য ব্যবহৃত হবে৷ ব্রাজিলের জাতীয় শক্তি কেন্দ্র ২-৩০ সালের মধ্যে এ ধরনের কার্যক্রম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে৷
ছবি: Reutersবন উজাড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সেখানকার কাঠ৷ অবৈধভাবে উজাড় হওয়া আমাজন এখন চারণ ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ ব্রাজিলের আইন অনুযায়ী, কেউ যদি ঐ জমিতে উৎপাদনশীল কাজ করে তাহলে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য জমি ‘লিজ’ নিতে পারবে৷ প্রসঙ্গত, উজাড় হওয়া জমির প্রতি হেক্টরের দাম ৩ হাজার ইউরো করে৷
ছবি: Reutersগত বছর ব্রাজিল সরকার ঘোষণা করে যে, ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার বন রেইনফরেস্ট ধ্বংস রোধের৷ কিন্তু স্বর্ণ সন্ধানকারী এবং কৃষি কোম্পানিগুলোর কারণে গাছের সংখ্যা বাড়ছে না৷
ছবি: Reuters৩,০০০ কিলোমিটার ‘ট্রানস-আমাজনিকা’ মহাসড়কটি ব্রাজিলের সাথে প্রতিবেশী দেশ পেরু ও বলিভিয়ার সংযোগ স্থাপন করছে৷ ৪০ বছর ধরে সড়কটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে৷ চলছে এটির সংস্কার কাজ, যা এখনো শেষ হয়নি৷ তবে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এই সড়ক সংস্কারের বিপক্ষে৷
ছবি: Evaristo Sa/AFP/GettyImagesস্বর্ণের খোঁজে যারা আমাজন চষে বেড়ায়, তারা অনেক সময় নিজেদের এলাকা থেকে নানা ধরনের রোগ বহন করে নিয়ে আসে৷ সেই সব রোগের সংক্রমণে স্থানীয় ‘ইয়ানোমামি’ গোষ্ঠী আক্রান্ত হয়৷ শুধু তাই নয়, এ পর্যন্ত কয়েকশ’ ইয়ানোমামি মারাও গেছে৷ এ বছরের জুনে তাই ব্রাজিলের সেনাবাহিনী ভেনেজুয়েলা সীমান্তের ৯৫ লাখ হেক্টর জমি থেকে অবৈধ স্বর্ণ সন্ধানকারীদের আস্তানা তুলে দেয়৷
ছবি: Fiona Watson/Survivalকৃষ্ণ স্বর্ণ: ‘আল্টো রিও গুয়ামা’ সংরক্ষিত এলাকার মধ্যাঞ্চলের দৃশ্য এটি৷ অবৈধভাবে কেটে ফেলা গাছগুলোকে চারকোলে পরিণত করা হয়৷ এ বছরের সেপ্টেম্বরে একটি পুলিশ হেলিকপ্টার থেকে এই ছবিটি তোলা হয়েছে৷ ব্রাজিলের পারা রাজ্যে অবস্থিত সংরক্ষিত এই এলাকাটিতে ‘নোভা এসপেরাঙ্কা’ সম্প্রদায়ের বসবাস৷
ছবি: Reuters
এখানেও ট্রপিকাল অঞ্চলের আর্দ্রতা অনুভব করা যায়৷ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী এখানে বসবাস করে৷ সংরক্ষিত এলাকার আয়তন প্রায় ৭৫০ বর্গ কিলোমিটার, আয়তন প্রায় বার্লিনের মতো৷ এখানে সবকিছু মাপজোক করা বা গণনা করা অসম্ভব৷ বিজ্ঞানীরা তাই ‘বায়ো ইন্ডিকেটর'-এর প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন৷ অর্থাৎ এমন প্রজাতি, যাদের মাধ্যমে অন্যান্যদের বিষয়ে আরও জানা যায়৷
স্তন্যপায়ী প্রাণীরাও তাদের মধ্যে রয়েছে৷ হয়ত একটি জাগুয়ার পাস দিয়ে চলে গেল৷ নায়ারা স্টাচেস্কি বলেন, কয়েকজন সহকর্মী বাঘ দেখেছেন, তিনি শুধু পায়ের চিহ্ন দেখেছেন৷ ভিক্টর লিমা মনে করেন, জাগুয়ার রাতের প্রাণী৷ এমন বিস্ময় দেখার সৌভাগ্য ক'জনেরই বা থাকে!
ব্রাজিলের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ জার্মানির জিআইজেড-এর সঙ্গে এই মনিটারিং কর্মসূচি গড়ে তুলেছে৷ জার্মান উন্নয়ন সংস্থার দুই সহকর্মী ব্রাসিলিয়ায় আঞ্চলিক দপ্তরে বসে দুই বছর ধরে প্রস্তুতির কাজ করেছেন৷ অবশেষে তাঁরা নিজেরা জঙ্গল পরিদর্শনে এসেছেন৷ সঙ্গে রয়েছেন জাতীয় পার্কের প্রধান৷
আগে নদী ছিল মাছে ভরা৷ তারপর কাছেই একজন বিজাতীয় মাছের চাষ শুরু করে৷ সেই মাছ কোনোভাবে নদীতে এসে বাকি মাছেদের খেয়ে ফেলে৷ এখন আর মাছ প্রায় দেখাই যায় না৷ এত সহজেই কোনো প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে৷ তবে এখনো এখানে অনেক কিছু দেখার আছে৷ যেমন কাঠের মতো দেখতে পোকা৷ অথবা সাঁতরে চলা টেপির৷ পার্কের প্রধান সান্দ্রো দা সিলভা পেরেইরা বলেন, ‘‘পার্কের মধ্যে কোনো প্রাণী স্বচ্ছ পানিতে থাকলে খালি চোখেই তাদের দেখা যায়৷ জলপ্রপাতগুলিও খুব সুন্দর৷ পানিতে স্নান করার আনন্দই আলাদা৷ ফলে আমি খুবই সন্তুষ্ট৷''
জিআইজেড-এর কর্মী ইয়ান ক্লাইনে ব্যুনিং-ও তাই মনে করেন৷ তিনি বললেন, ‘‘সত্যি খুব আনন্দ হয়েছে৷ সত্যি অনবদ্য এক জায়গা৷ যাতায়াত সহজ নয়, তবে তাতে কী এসে যায়!''