ফুটবল উন্মাদনার দেশ ব্রাজিল৷ ব্রাজিলিয়ানদের ফুটবল প্রেমের অনেক গল্পই অনেকের জানা৷ জানেন কি, ফুটবল যে সেখানে এক ধরণের ‘আফিম’? জনতাকে ফুটবল নেশায় বুঁদ রেখে নিরাপদে থাকে শাসক?
বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে উদ্বোধন হওয়া এই নতুন স্টেডিয়ামকে ঘিরে ফুটবলপ্রেমীদের আনন্দছবি: Getty Images/AFP
বিজ্ঞাপন
ব্রাজিল ফুটবলের স্বর্ণযুগ থেকেই ফুটবল সেখানে আফিমের মতো৷ সাম্বা ফুটবলের দেশ প্রথম বিশ্বকাপ জেতে ১৯৫৮ সালে৷ পরেরবার, অর্থাৎ ১৯৬২ সালেও শিরোপা ধরে রাখে তারা৷ এরপর ১৯৭০-এ আবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে ‘জুলে রিমে কাপ' চিরতরে ঘরে তোলে দক্ষিণ অ্যামেরিকার এই দেশ৷ এসব অজানা নয় কারো৷ বিশ্বকাপ ইতিহাসের সফলতম দল ব্রাজিল- এটাও অজানা নেই কারো৷ অনেকের এটা হয়তো জানা নেই যে, ফুটবলের এই জনপ্রিয়তাকে সরকার সবসময় নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে৷
২০১৪ বিশ্বকাপে যাঁদের জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা
২০১৪ সালের বিশ্বকাপকে সেরা টুর্নামেন্টে পরিণত করায় রোনাল্ডো আর মেসির ভূমিকা থাকতেই পারে৷ কিন্তু আরো ১০ লুকানো রত্ন রয়েছে, যাঁরা সুযোগ পেলেই দেখাতে পারেন তাঁদের কেরামতি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খোয়াদভো আসামোয়া (ঘানা)
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে অসাধারণ দক্ষতা ঘানার এই ফুটবলারের৷ ২৫ বছর বয়সি এই খেলোয়াড় তাই মাঠে হয়ে উঠতে পারেন প্রতিপক্ষের বিভীষিকা৷ ২০১০ সালের মতো ঘানা যদি তাদের সেরাটা দিতে পারে, এক্ষেত্রে অবশ্যই ভূমিকা রাখবেন আসামোয়া৷
ছবি: Marco Bertorello/AFP/Getty Images
পল পগবা (ফ্রান্স)
অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ ফুটবলে পল পগবা অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন৷ স্যার আলেকজান্ডার ফার্গুসনের মুখেও এই ফুটবলারের প্রতি প্রশংসা উচ্চারিত হয়েছে৷ তাঁর সিদ্ধান্তেই এই কিশোর ফুটবলার বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছেন৷ শক্তিশালী এই খেলোয়াড় যে বিশ্বকাপে মাঠ মাতাবে, তা বোধহয় বলাই যায়৷
ছবি: Marco Bertorello/AFP/Getty Images
অ্যাডাম লালানা (ইংল্যান্ড)
এবার বিশ্বকাপে ইংলিশ শিবিরের শিরোপা জেতার আশা অনেকটাই বেশি৷ ২০১৩/১৪ মৌসুমে লালানা যে আভিজাত্য এবং দক্ষতার সাথে খেলেছেন, তা এককথায় অসাধারণ৷ তাই এই মিডফিল্ডারের পায়ের জাদু দেখার অপেক্ষায় থাকবেন অনেকেই৷
ছবি: Getty Images
মিরালেম পিয়ানিচ(বসনিয়া)
কিশোর এই ফুটবলারকে নিয়ে ইটালির মিডিয়ায় বরাবরই মতামাতি৷ বসনিয়ায় এই ফুটবলারকে বলা যায় স্বভাবজাত ফুটবলার৷ অসাধারণ পাস, দূর দৃষ্টি এবং ফুটবল নিয়ন্ত্রণে অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে তাঁর৷
ছবি: Getty Images
ইয়োইচিরো কাকিতানি (জাপান)
জাপানের অন্যতম আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার কাকিতানি৷ তাঁর পেস, গতি এবং লিঙ্ক আপের দক্ষতা অসাধারণ৷ ২৪ বছর বয়সি কাকিতানি ব্রাজিল বিশ্বকাপে তাঁর সেরাটা দিয়ে সামুরাই ব্লুদের অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images
কেভিন দে ব্রয়না (বেলজিয়াম)
বেলজিয়ামের স্বর্ণ প্রজন্মের অন্যতম অংশীদার কেভিন দে ব্রয়না৷ বুন্ডেসলিগায় তাঁর অসাধারণ অভিষেক এখনো মনের মধ্যে গেঁথে আছে ফুটবল ভক্তদের৷ মাত্র ২৩ বছর বয়সি এই শক্তিশালী ফুটবলারের পায়ের জাদু দেখার অপেক্ষায় থাকবেন বিশ্ববাসী৷
ছবি: Getty Images
লুকাস মুরা (ব্রাজিল)
২১ বছর বয়সি এই ফুটবলার ব্রাজিল শিবিরে কয়েক বছর আগে প্রবেশ করেছে৷ ফরাসি ফুটবল ক্লাব পিএসজি-র গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়ারে পরিণত হয়েছেন তিনি৷ আর বিশ্বকাপে ব্রাজিলের আক্রমণ ভাগেও এই প্রতিভাবান ফুটবলারের খেলা দেখার অপেক্ষায় থাকবেন ভক্তরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জেমস রোদ্রিগেজ (কলম্বিয়া)
এ বছর বিশ্বকাপে সবার চোখ থাকবে কলম্বিয়ার দিকে৷ কেননা দক্ষিণ অ্যামেরিকার এই দলটি এখন দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছে৷ মোনাকো তারকা রোদ্রিগেজ কাঁধে রয়েছে দলের সব চাপ৷ ২২ বছর বয়সি এই ফুটবলারের গতি এবং খেলার ধরণ অসাধারণ৷ তিনি এই দলের একটি রত্নে পরিণত হয়েছেন৷
ছবি: Getty Images
এদুয়ার্দো ভার্গাস (চিলি)
ফার্গাস এখন ভ্যালেন্সিয়ায় রয়েছেন৷ তবে খুব শিগগিরই স্টুটগার্ডে জার্মান ভক্তরা প্রীতি ম্যাচে তাঁর দেখা পাবেন৷ তবে ২৪ বছর বয়সি প্রতিভাবান এই ফুটবলারের জন্য ব্রাজিল বিশ্বকাপ একটি নতুন দ্বার খুলে দিতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইয়োর্দি ক্লাসি (নেদারল্যান্ডস)
ইয়োর্দি ক্লাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে সহজাত ফুটবলার৷ নেদারল্যান্ডসের জাতীয় দলের পুরো দায়িত্ব এখন এই মিডফিল্ডার এ কাঁধে৷ মাত্র ২২ বছর বয়সেই ১০০ ম্যাচ খেলার মাইল ফলক ছুঁয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
বিশেষ করে সামরিক শাসন শুরুর পর থেকে ফুটবলকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা শুরু হয়৷ বামঘেঁষা সরকারকে হঠিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন হোসে সার্নে৷ তারপর থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলে চলেছে সামরিক শাসন৷ এ সময়ে ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি পেলে-র পেছনেও নাকি গোয়েন্দা লাগানো হয়েছিল৷ পেলে বামপন্থি হলে গোয়েন্দার মাধ্যমে তা জেনে তাঁর ক্যারিয়ার হয়ত আগেভাগেই শেষ করে দিতো সামরিক জান্তা৷
পেলে বা ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলকে তিনবার বিশ্বকাপ জেতানো অন্য খেলোয়াড়রা তবু সুযোগ পেয়েছেন দেশের হয়ে খেলার৷ কিন্তু ব্রাজিলে এমন ফুটবলার কম নয়, যাঁরা শুধু রাজনৈতিক দর্শনের কারণে কোনোদিন জাতীয় দলে সুযোগ পাননি৷
আফনসো সেদসো গার্সিয়া রেইস তাঁদেরই একজন৷ পেলেদের সময় বোটাফোগোর হয়ে দাপটেই খেলেছেন ঘরোয়া লিগ৷ কিন্তু জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হয়নি কোনোদিন৷ এর কারণ জানাতে গিয়ে ৬৬ বছর বয়সি সাবেক মিডফিল্ডার বললেন, ‘‘আমার নীতি ছিল, তারই চড়া মূল্য দিয়েছি৷ ''
সামরিক শাসনের সময় বামপন্থি চেতনার খেলোয়াড়দের সুযোগ দেয়া হত না৷ দলে সুযোগ পাওয়া কাউকে কমিউনিস্ট মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে পেছনে লাগানো হতো গোয়েন্দা৷ ১৯৭০ বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিলকে বাছাই পর্বের বৈতরণী পার করিয়েছিলেন কোচ হোয়াও সালদানহা৷ কিন্তু ক্ষমতাসীনদের সন্দেহ হওয়ায় মূল পর্বে তাঁকে রাখা হয়নি৷ মূল পর্বে কোচ ছিলেন মারিও জাগালো৷ জাগালো অবশ্য দলকে চ্যাম্পিয়ন করেই দেশে ফিরেছিলেন৷
বিশ্বকাপে থাকছেন না যে তারকারা
আগামী জুন মাসেই ব্রাজিলে শুরু হচ্ছে বহু প্রতীক্ষার ফুটবল বিশ্বকাপ৷ এবার যেমন অনেক তারকার দেখা মিলবে বিশ্বকাপে, তেমনি দেশ চূড়ান্ত পর্বে উঠতে ব্যর্থ হওয়ায় কিছু তারার দেখা পাবেন না ফুটবলপ্রেমীরা৷
ছবি: Getty Images
স্লাতান ইব্রাহিমোভিচ
সুইডেন বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে উঠতে পারেনি৷ তাই ব্রাজিলে থাকছেন না ইউরোপীয় ফুটবলের অন্যতম বড় তারকা ইব্রাহিমোভিচ৷ বর্তমানে ফ্রান্সের পিএসজি ক্লাবের হয়ে খেলা ইব্রাহিমোভিচের সুইডেন বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের প্লে-অফে ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর পর্তুগালের কাছে হেরে যায়৷ অবশ্য ফলাফল উল্টো হলে রোনাল্ডোহীন বিশ্বকাপ দেখতে হতো ফুটবলপ্রেমীদের!
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্যারেথ বেল
চলতি মরসুম শুরুর আগে বেলকে যখন সর্বোচ্চ ট্রান্সফার ফি দিয়ে কিনে নিয়েছিল রেয়াল মাদ্রিদ, তখন সবাই চমকে গিয়েছিল৷ অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কে এই বেল? অবশ্য মরসুম শেষ হওয়ার আগে তাঁদের সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন বেল৷ কদিন আগে দুর্দান্ত এক গোল করে গ্যারেথ ‘বোল্ট’ নামেই খ্যাতি পেয়ে গেছেন৷ তবে বেলের দেশ ওয়েলশ বিশ্বকাপে উঠতে না পারায় তাঁকেও এবার দেখা যাবে না ব্রাজিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রবার্ট লেভান্ডোভস্কি
গত মরসুমে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে রেয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে চার গোল করে সমর্থকদের নজর কেড়েছিলেন লেভান্ডোভস্কি৷ ডর্টমুন্ডের এই ফুটবলারের দেশ পোল্যান্ড বিশ্বকাপে নেই৷ তাই চলতি মরসুম শেষে বায়ার্নে চলে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা লেভান্ডোভস্কিকে ছাড়াই চলবে বিশ্বকাপ৷
ছবি: AFP/GettyImages
ডেভিড আলাবা
বায়ার্ন মিউনিখের সাফল্যের অংশীদার আলাবা অস্ট্রিয়ার নাগরিক৷ ১৯৯৮ সালের পর আর বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে উঠতে পারেনি তাঁর দেশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পেত্র চেশ
চেলসির হয়ে ২০১২ সালে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জেতা গোলরক্ষক পেত্র চেশ চেক প্রজাতন্ত্রের হয়ে ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ খেলেছিলেন৷ কিন্তু এবার তাঁর দেশ চূড়ান্ত পর্বে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে৷
ছবি: AFP/GettyImages
পিয়ের-এমরিক ওবামেইয়াং
ডর্টমুন্ডের হয়ে এ বছর চমক দেখানো আফ্রিকার গ্যাবনের ফুটবলার ওবামেইয়াং থাকছেন না ব্রাজিল বিশ্বকাপে৷ ছবিতে ডর্টমুন্ডের জার্সি গায়ে ওবামেইয়াংকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্রিস্টিয়ান ইরিকসেন
২২ বছর বয়সি ডেনিশ এই মিডফিল্ডার ২০১২-১৩ মরসুমে আয়াক্সের হয়ে দারুণ খেলা দেখিয়েছিলেন৷ ঐ সময় মিডফিল্ডার হিসেবে তিনি সবচেয়ে বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করেছিলেন৷ এ ব্যাপারে তিনি ইউরোপের বাঘা বাঘা সব ফুটবলারকে পেছনে ফেলেছিলেন৷
ছবি: dapd
ব্রানিস্লাভ ইভানোভিচ
চেলসির এই ডিফেন্ডারকে এবার ঘরে বসেই বিশ্বকাপ দেখতে হবে৷ কারণ তাঁর দেশ সার্বিয়া বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্লে-অফে ক্রোয়েশিয়ার বাধা পেরোতে পারেনি৷
ছবি: Getty Images
8 ছবি1 | 8
জাগালোর সাফল্যে ঢাকা পড়েছিল হোয়াও সালদানহার হতাশা৷ বিজয়ানন্দে চাপা পড়েছিল সামরিক শাসন আর শোষণ বিরোধী পুঞ্জীভূত ক্ষোভ৷ ব্রাজিলের মানুষ ফুটবলের আনন্দ পেলে সব ভুলে যায়৷ ২০১৪ বিশ্বকাপকে ঘিরেও বিক্ষোভ কম হয়নি ব্রাজিলে৷ দরিদ্র দেশে এত ব্যয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরুদ্ধে অনেকেই৷
ব্রাজিলে আর সামরিক শাসন নেই৷ কিন্তু ১৯৭০ বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিল দলের খেলোয়াড় টোস্টাও মনে করেন এখনকার গণতান্ত্রিক সরকারও আফিমের মতো ব্যবহার করতে চান ফুটবলকে৷ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘সর্বকালের অন্যতম সেরা একটি দলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতায় আমি গর্বিত৷ কিন্তু ১৯৭০-এর দলকে যখন জনগণের আফিম হিসেবে বর্ণনা করা হয়, তখন খুব খারাপ লাগে৷ তবে শুধু স্বৈর শাসকের সময়ে নয়, গণতান্ত্রিক শাসকের সময়ও এমন হয়েছে৷ সারা বিশ্বেই হয়েছে৷ এখনো এমনই হচ্ছে৷''