জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিওরিটি অ্যাফেয়ার্স-এর সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ গিডো স্টাইনব্যার্গের মতে, নিরাপত্তা বিভাগের দুর্বলতা ও ইসলামপন্থি জঙ্গিদের ব্যাপক উপস্থিতি ব্রাসেলসকে আক্রমণের লক্ষ্য করে তুলেছে৷
বিজ্ঞাপন
সালাহ আবদেসালামকে গ্রেপ্তারের পর সন্ত্রাসীরা ব্রাসেলসের আক্রমণ এগিয়ে আনে, বলে স্টাইনব্যার্গের ধারণা৷ কিন্তু এ-ধরণের আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে বহু সময় লাগে৷ বোমা তৈরি করতে হয়, লক্ষ্য বেছে তার খোঁজখবর নিতে হয়, আত্মঘাতী বোমারুদের প্রস্তুত করতে হয়৷ কাজেই ব্রাসেলসের আক্রমণগুলি আবদেসালাম গ্রেপ্তার হওয়ার অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করা ছিল, বলে নিকটপ্রাচ্য ও সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ গিডো স্টাইনব্যার্গের মত৷
ডয়চে ভেলে: আবদেসালামকে গ্রেপ্তারের পর কি এই ধরণের আক্রমণ ঘটবে, বলে ধরে নেওয়া উচিত ছিল?
গিডো স্টাইনব্যার্গ: ব্রাসেলস কর্তৃপক্ষ বিপদের সম্ভাবনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন৷ সালাহ আবদেসালাম যে সম্ভবত উত্তরোত্তর আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছে, সেটাও ধরে নেওয়া যেতো৷ ওদিকে বোমা তৈরির একজন পাকা কারিগর আপাতত পলাতক৷ বেলজীয় কর্তৃপক্ষ এ সব কিছুই জানতেন, কাজেই কী ঘটতে পারে, তা আন্দাজ করতে পারছিলেন৷ মুশকিল হলো এই যে, ব্রাসেলসের মতো একটা শহরে এত বেশি আক্রমণের লক্ষ্য আছে যে, সর্বত্র পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়৷
প্যারিসের পর ব্রাসেলসে ব্যাপক খোঁজখবর, ধরপাকড় চলে৷ ইউরোপে সন্ত্রাসীদের চক্র কি যা মনে করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বড়?
নভেম্বরে প্যারিস আক্রমণের সময় যা মনে করা হয়েছিল, তার চেয়ে বড় বৈকি৷ প্যারিসের আক্রণকারীদের যারা সাহায্য করেছিল, তারা ছাড়াও, আরো অনেকে এই সন্ত্রাস চক্রে সংশ্লিষ্ট বলে আজ মনে হচ্ছে৷ বলতে কি, আততায়ীদের পারিপার্শ্বিক, সহযোগী ও পরিচিত মহলে যে ঠিক কতজন সহকারী আছে, তা আমাদের জানা নেই – যা কিনা চিন্তার কারণ৷ এক্ষেত্রে আবার সেই সহকারীদের মধ্যে এমন একজন আছে, যে সিরিয়া থেকে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে৷
ইউরোপ জুড়ে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা
ব্রাসেলসে একাধিক সন্ত্রাসী হামলার পর ইউরোপ জুড়ে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা৷ বিশেষ করে বিমানবন্দর, ট্রেন স্টেশন, সীমান্ত এবং বিভিন্ন শহরের রাস্তায় পুলিশের বাড়তি উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P. Golovkin
‘যুদ্ধে ইউরোপ’
ফরাসি প্রধানমন্ত্রী তো বলেই দিলেন, ইউরোপ এখন ‘যুদ্ধে আছে’৷ ব্রাসেলসের ঘটনার পর ইউরোপীয় নেতারা জরুরি নিরাপত্তা বৈঠক করেছেন এবং সর্বত্র নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়েছেন৷ তাদের সঙ্গে রয়েছেন বোমা বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষিত কুকুর এবং সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Roessler
সব বড় বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে
লন্ডন, প্রাগ, অ্যামস্টারডাম, ভিয়েনাসহ ইউরোপের সব বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে৷ লন্ডনের প্রধান বিমানবন্দর, হিথ্রোতে, পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে৷ পাশাপাশি, লন্ডনসহ বিভিন্ন শহরেও বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Rain
ডাচ পুলিশের সতর্ক অবস্থান
নেদারল্যান্ডসের অ্যামস্টারডাম বিমানবন্দরে নিরাপত্তা দিচ্ছে ডাচ মিলিটারি পুলিশ৷ ব্রাসেলস বিমানবন্দরে হামলার পরপরই সেখানকার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়৷ ব্রাসেলসে মঙ্গলবার একাধিক বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন নিহত এবং প্রায় দুই শত মানুষ আহত হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/epa/E. Elzinga
ব্রিটেনে সতর্কতা
লন্ডনের বিমানবন্দরে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/J. Mansfield
ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরে বাড়তি পুলিশ
জার্মান কর্তৃপক্ষও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা বাড়িয়েছে৷ বিশেষ করে বিমানবন্দর, ট্রেন স্টেশন আর বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবুর্গ সীমান্তে পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে৷ তবে পুলিশের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি চোখে পড়েছে জার্মানির সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরে৷ শহরটির ট্রেন স্টেশনেও পুলিশ অবস্থান নিয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Stache
রেল যোগাযোগ সাময়িক বন্ধ
বেলজিয়ামে হামলার পর জার্মানির জাতীয় ট্রেন ব্যবস্থা, ডয়চে বান, ব্রাসেলসের সঙ্গে তাদের উচ্চগতির ট্রেন সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়৷ ব্রাসেলসের বদলে জার্মানির সীমান্তের শহর আখেনে ট্রেনগুলো থামানো হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. A. Gekiere
প্যারিসে আবারো উচ্চ সতর্কর্তা
প্যারিসে গত নভেম্বর সন্ত্রাসী হামলায় অনেকে প্রাণ হারান৷ মঙ্গলবার ব্রাসেলসে হামলার পরপরই তাই সেখানকার নিরাপত্তা আরো বাড়ানো হয়৷ প্যারিসের মূল বিমানবন্দর এবং সংশ্লিষ্ট ট্রেন স্টেশন দু’টিতে নিরাপত্তা বাহিনীর পুরো দল নিয়োগ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/epa/E. Laurent
রাশিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুর্নমূল্যায়ন
রাশিয়ার যোগাযোগমন্ত্রী মাক্সিম সকোলভ জানিয়েছেন, ব্রাসেলসের ঘটনার পর সেদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও পুর্নমূল্যায়ন করা হবে৷ যদিও রাশিয়া আগে থেকেই বেশ সতর্ক৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P. Golovkin
8 ছবি1 | 8
অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে এ ধরণের আরো আক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা আছে, বলে আপনার ধারণা?
সে বিপদ আছে বলেই আমি ধরে নিচ্ছি৷ ব্রাসেলসের আক্রমণ সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত ছিল৷ সশস্ত্র যুদ্ধ আর বোমা তৈরির অভিজ্ঞতা সম্বলিত লোকজন যতদিন নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, ততদিন এই বিপদ থাকবে, এবং তা শুধু ব্রাসেলসেই নয়, ব্রাসেলস থেকে যে সব জায়গায় পালানো যেতে পারে, সে সব জায়গাতেও৷
বেলজীয় কর্তৃপক্ষ কি এই আকারেরএকটি সন্ত্রাস চক্রের মোহড়া নিতে সক্ষম?
স্পষ্টতই নয়৷ অন্যদিকে বেলজিয়ামকে দোষ দেওয়া একটু সমস্যাকর, কেননা বেলজিয়াম থেকে বহু ইসলামপন্থি সিরিয়ায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে, পরে বেলজিয়ামে ফিরে এসেছে৷ বেলজিয়ামের জনসংখ্যার তুলনায় এ ধরনের জঙ্গি মনোভাবাপন্নদের অনুপাত অনেক বেশি৷ ওদিকে অপরাপর কয়েকটি দেশের মতো বেলজিয়ামের নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ অপেক্ষাকৃত দুর্বল – যেমন ডেনমার্ক কিংবা অস্ট্রিয়ায়৷ তবে স্বয়ং ফ্রান্সের নিরাপত্তা বিভাগ যে ধরণের সমস্যার মুখে পড়েছে, তা দেখলে বেলজিয়ামের সমস্যা আরেকটু ভালো করে বোঝা যায়৷
গিডো স্টাইনব্যার্গ বার্লিনের আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত গবেষণা কেন্দ্রের মধ্যপ্রাচ্য ও সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ৷ ২০০২ সাল থেকে ২০০৫ সাল অবধি তিনি ছিলেন জার্মান চ্যান্সেলরের দপ্তরে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে উপদেষ্টা৷
বন্ধু, আপনি কি গিডো স্টাইনব্যার্গের সঙ্গে একমত? জানান নীচের ঘরে৷
বিশ্ব কি ধ্বংসের পথে?
চলতি বছরের শুরুতেই সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপকতা দেখে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে৷ গত বছরের নভেম্বরে প্যারিসে হামলায় নিহত হন ১৩০ জন৷ সেই ঘটনার পর একের পর এক হামলায় তটস্থ বিশ্ব৷
ছবি: Reuters/U. Bektas
ইস্তানবুলে বোমা হামলা: জানুয়ারি ১২
ইস্তানবুলের এক জনপ্রিয় চত্বরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারান ১৩ ব্যক্তি, আহত বেশ কয়েকজন৷ নিহতদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশি ছিলেন৷ আত্মঘাতী হামলাকারী ছিল তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস অনুসারী সিরীয় নাগরিক নাবিল ফাদিলা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Kneffel
জাকার্তায় হামলা: জানুয়ারি ১৪
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় সিরিজ বোমা হামলায় প্রাণ হারান কমপক্ষে আট ব্যক্তি, আহত ২৪৷ ‘ইসলামিক স্টেট’ সেই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty images/AFP/Str
ওয়াগাডুগুর হোটেলে হামলা: জানুয়ারি ১৫
আল-কায়দা সমর্থিত জঙ্গিরা বুর্কিনা ফাসোর রাজধানী ওয়াগাডুগুতে একটি হোটেল হামলা চালায়৷ এতে ১৮টি দেশের কমপক্ষে ২৩ ব্যক্তি নিহত হন৷ ফরাসি এবং সেদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অপারশনে হোটেলটি জঙ্গিমুক্ত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Elsen
আঙ্কারায় হামলা: ফেব্রুয়ারি ১৭
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় বাসের বহরে হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘কুর্দিশ ফ্রিডম ফ্যালকনস’ বা টিএকে৷ হামলায় ২৯ ব্যক্তি নিহত এবং কমপক্ষে ৬০ ব্যক্তি আহন হন যাদের মধ্যে সাধারণ মানুষ ছাড়াও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন৷
ছবি: Reuters/Ihlas News Agency
মোগাদিশুতে হোটেলে হামলা: ফেব্রুয়ারি ২৬
সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিশুর একটি হোটেলের মধ্যে নিজের গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটায় এক আত্মঘাতী বোমারু৷ এতে ১৫ ব্যক্তি নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হন৷ আল-শাবাব জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্তরা এই হামলা চালিয়েছে বলে জানা গেছে৷
ছবি: Reuters/F. Omar
আইভরি কোস্টে হোটেলে গুলিবর্ষণ: মার্চ ১৩
আল-কায়দার উত্তর আফ্রিকা শাখার সদস্যরা আইভরি কোস্টের গ্রান্ড ব্যাসামে একটি হোটেলে গুলিবর্ষণ করে৷ এতে ১৮ ব্যক্তি নিহত এবং ৩৩ জন আহত হন৷
ছবি: Reuters/L. Gnago
আঙ্কারায় বোমা হামলা: মার্চ ১৩
তুরস্কে একের পর এক বোমা হামলা ঘটছে৷ সেদেশের রাজধানীর কেন্দ্রে বিস্ফোরকভর্তি একটি গাড়ির বিস্ফোরণ ঘটে ১৩ মার্চ৷ এতে প্রাণ হারান ৩৭ ব্যক্তি, আহত ১২৭৷ এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে টিএকে৷
ছবি: Reuters/U. Bektas
ব্রাসেলসে হামলা: মার্চ ২২
ব্রাসেলসে একাধিক সন্ত্রাসী হামলায় নিহত কমপক্ষে ৩৪ ব্যক্তি, আহত ১৭০৷ সেদিন সকাল আটটার দিকে ব্রাসেলস বিমানবন্দরে দু’টি বিস্ফোরণ ঘটে৷ আর তার একঘণ্টা পর মোলেনবেক মেট্রো স্টেশনে আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটে৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ এ সব হামলার দায় স্বীকার করেছে৷