জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে সেলফি তুলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন শরণার্থী আনাস মোডামানি৷ এখন সেই ছবি আবারো ইন্টারনেটে ছড়াচ্ছে একটি মহল৷ তাদের দাবি, আনাসই নাকি ব্রাসেলসের বোমারু৷
বিজ্ঞাপন
ব্রাসেলসে আত্মঘাতী বোমারু নাজিম লাচরাওয়ির ছবির সঙ্গে আনাস মোডামানির ছবির তুলনা করে ফেসবুক এবং টুইটারে বিভিন্ন ‘পোস্ট' করেছেন অনেকে৷ কোনো কোনো ব্যবহারকারী দাবি করেছেন, তাদের দু'জনের মধ্যে পরিষ্কার মিল রয়েছে৷ কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছেন, ম্যার্কেল এক আত্মঘাতী বোমারুর সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন৷ আবার কারো মতে, সন্ত্রাসীরা যে ‘শরণার্থীর বেশে' ইউরোপে প্রবেশ করছে, এই ছবি তার প্রমাণ৷
হ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ ‘অ্যানোনিমাস' তাদের ফেসবুক পাতাতেও এই ছবিটি শেয়ার করেছে, যার অনুসারীর সংখ্যা দুই মিলিয়নের মতো৷ মোডামানি অবশ্য পুরো পরিস্থিতিকে হাস্যকর মনে করছেন, যদি না তা তার জন্য বড় কোনো বিপদ ডেকে না আনে৷ পুলিশের দাবি, গত মঙ্গলবার ব্রাসেলস বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় জড়িত দ্বিতীয় বোমারু ছিল নাজিম লাচরাওয়ি৷ এমনিক গত নভেম্বরে প্যারিসে বোমা হামরার পর উদ্ধার করা এক আত্মঘাতী পোশাকেও তার ডিএনএ পাওয়া গেছে৷
একটা সেলফি যেভাবে তাঁর জীবন বদলে দিয়েছে
আপনি কি সেলফির প্রতি আসক্ত? কিংবা আপনি কি একে হাস্যকর মনে করেন? আনাস মোডামানির কিন্তু ভাগ্য বদলে গেছে এক সেলফির কারণে৷ দেখুন কিভাবে:
ছবি: Anas Modamani
আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ
বার্লিনে এক শরণার্থী শিবিরে থাকার সময় আনাস মোডামানি একদিন শুনলেন যে, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল তাদের দেখতে আসবেন এবং তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন৷ ১৯ বছর বয়সি সিরিয়ান তরুণ, যিনি কিনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ভক্ত, সুযোগটা হাতছাড়া করেননি৷ তিনি তখন ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে ম্যার্কেলের সঙ্গে একটি সেলফি তোলেন৷
ছবি: Anas Modamani
ইউরোপে পালিয়ে আসা
দামেস্কে যখন তাঁদের বাড়ির উপর বোমা পড়ে, তখন মোডামানি এবং তাঁর বাবাম ও ভাইবোনেরা গরিয়া নামক একটি ছোট্ট শহরে চলে যান৷ সেখান থেকে ইউরোপের পথে যাত্রা করেন তিনি৷ প্রথমে লেবানন, এরপর তুরস্ক হয়ে গ্রিসে৷
ছবি: Anas Modamani
বিপজ্জনক যাত্রা
মোডামানি যাত্রাপথে প্রায় মরতে বসেছিলেন৷ আরো অনেক শরণার্থীর মতো, একটা রাবার বোটে করে তুরস্ক থেকে গ্রিস আসতে হয়েছিল তাঁকে৷ মোডামানি জানান, নৌকাটি অতিরিক্ত বোঝাই ছিল এবং এক পর্যায়ে সমুদ্রে তলিয়ে যায়৷ তিনিও প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান৷
ছবি: Anas Modamani
পাঁচ সপ্তাহ পায়ে হাঁটা
গ্রিস থেকে পায়ে হাঁটা পথে মেসিডোনিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন মোডামানি৷ হাঙ্গেরি এবং অস্ট্রিয়ায় তিনি হেঁটেছেন অনেকটা পথ৷ এরপর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে পৌঁছান তাঁর চূড়ান্ত গন্তব্য মিউনিখে৷ জার্মানিতে আসার পর তিনি বার্লিনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ তখন থেকেই তিনি বার্লিনেই আছেন৷
ছবি: Anas Modamani
রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আশায়
বার্লিনে পৌঁছানোর পর মোডামানি বেশ ক’টা দিন কাটিয়েছেন লাগেসো শরণার্থী কেন্দ্রের সামনে৷ তিনি জানান, সেখানকার অবস্থা বেশ জটিল, বিশেষ করে শীতের সময়৷ এক পর্যায়ে তাঁকে বার্লিনের স্পানডাও অঞ্চলের শরণার্থী কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ তিনি শরণার্থী হিসেবে তাঁর অবস্থা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন৷ আর ম্যার্কেলের সঙ্গে সেলফি তাঁকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে৷
ছবি: Anas Modamani
অবশেষে এক পরিবারের সন্ধান
মোডামানি জানিয়েছেন, চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের সঙ্গে তোলা সেলফি জীবন বদলে দিয়েছে৷ সেই ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশের পর গণমাধ্যমের নজর পড়ে তাঁর দিকে এবং একটি জার্মান পরিবার তাঁকে আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্তে নেয়৷ গত দু’মাস ধরে জার্মান পরিবারের সঙ্গে আছেন তিনি৷ আর সেই পরিবার তাঁকে পরিবারের সদস্যদের মতোই সহায়তা করছে৷
ছবি: Anas Modamani
বাড়ির কথা মনে পড়ে
জার্মান পরিবারের সঙ্গে বসবাসের পর থেকে বেশ ভালোই আছেন মোডামানি৷ জার্মান ভাষা শিখছেন এখন৷ তাঁর বেশ কিছু বন্ধুও হয়েছে৷ জার্মানিতে পড়াশোনা করতে চান তিনি৷ তবে তাঁর আপাতত লক্ষ্য হচ্ছে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া৷ কেননা তাহলে নিজের পরিবারকে জার্মানি নিয়ে আসা সহজ হবে তাঁর জন্য৷
ছবি: Anas Modamani
শরণার্থীদের সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতা
জার্মানিতে একটি উন্নত ও নিরাপদ জীবনের আশা মোডামানি৷ তবে শরণার্থীদের সম্পর্কে জার্মানির বর্তমান মনোভাব নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, শরণার্থীদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ভবিষ্যতে আরো বাড়তে পারে৷ সেক্ষেত্রে তা শরণার্থী বিষয়ক আইনের উপর প্রভাব ফেলবে৷ ফলে তাঁর আবেদন হয়ত বাতিল হবে৷ আর নিজ পরিবারকে জার্মানিতে আনার স্বপ্ন হয়ত স্বপ্নই থেকে যাবে৷
ছবি: Anas Modamani
8 ছবি1 | 8
ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে মোডামানি জানান, ছবিটির এমন ব্যবহার দেখে তার মন খারাপ হয়েছে৷ সিরিয়ার দামেস্ক থেকে যাত্রা করে গত সেপ্টেম্বরে জার্মানিতে পৌঁছান ১৯-বছর বয়সি মোডামানি৷ চলতি বছরের শুরু থেকে একটি জার্মান পরিবারের সঙ্গে রয়েছেন তিনি, শিখছেন জার্মান ভাষা৷
মোডামানির বন্ধু লিয়াং চেং জানান, মোডামানি জার্মানির বার্লিনে থাকেন, প্রতিদিন স্কুলে যান৷ তারপক্ষে এখন কোনোভাবে ব্রাসেলস যাওয়াই সম্ভব নয়৷ তিনি বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ইন্টারনেটে এ সব মিথ্যা কথা দ্রুত ছড়ায়৷''
মোডামানি ভবিষ্যতে তাঁর পরিবারকে জার্মানিতে আনতে চান৷ তবে তিনি এখন কিছুটা শঙ্কিত৷ পাছে, জার্মান পুলিশ বা জার্মানরা ভেবে না বসে তার ছবি নিয়ে যে গুজব তার পেছনে হয়ত সত্য কিছু আছে!
কী মনে হয়? মোডামানি কি সত্যিই জঙ্গিদের সঙ্গে জড়িত হতে পারে? জানান নীচের ঘরে৷
শরণার্থীদের প্রিয় জার্মানি, আরো প্রিয় ম্যার্কেল
শরণার্থীদের নিয়ে একটা ছবি সবারই নজর কেড়েছে৷ প্ল্যাকার্ড হাতে এক শিশু, প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘‘উই ওয়ান্ট জার্মানি’’৷ অনেকেই এসে পৌঁছেছেন তাঁদের কাঙ্খিত ঠিকানা জার্মানিতে৷ পছন্দের মানুষ ম্যার্কেলের দেশে এসে খুশি তাঁরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Bernd von Jutrczenka
জার্মানিকে চাই...
সেই ছবি৷ বুদাপেস্টে তখন শরণার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে৷ অস্ট্রিয়া বা জার্মানির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে না পারায় তাঁরা ক্ষুব্ধ৷ সবাই ছুটছিলেন প্ল্যাটফর্মের দিকে৷ পুলিশ ফিরিয়ে দিলো৷ স্টেশনের বাইরে শুরু হলো বিক্ষোভ৷ কারো কারো হাতে তখন ট্রেনের টিকিট৷ কেউ ক্ষোভ জানালেন কোলের সন্তানকে নিয়ে৷ অনেক শিশুর হাতে দেখা গেল, ‘উই ওয়ান্ট জার্মানি’ লেখা কাগজ৷ ইউরোপে এত দেশ থাকতে কেন জার্মানি?
ছবি: Reuters/L. Foeger
আছে নব্য নাৎসি, পুড়েছে শরণার্থী শিবির, তবুও...
জার্মানির কোথাও কোথাও শরণার্থীবিরোধী বিক্ষোভ দেখা গেছে৷ অনেক জায়গায় রাতের অন্ধকারে আশ্রয় শিবিরে লেগেছে আগুন৷ তারপরও অভিবাসনপ্রত্যাশীরা জার্মানিকেই বেছে নিতে চায়৷
ছবি: Getty Images/M. Rietschel
বড় কারণ ম্যার্কেল এবং...
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ব্যাপারে শুরু থেকেই উদার জার্মানি৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেল সবসময়ই অভিবাসী এবং অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পাশে ছিলেন৷ পেগিডা আন্দোলনের সময়ও সরকারের অভিবাসীদের পাশে থাকার কথা স্পষ্ট করেই বলেছেন ম্যার্কেল৷ পাশে থেকেছেও৷ জার্মানির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও ছিল তাঁর পাশে৷ এখনও আছে৷ এই বিষয়গুলোও মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মনে জার্মানির প্রতি আরো আস্থাশীল করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NDR
তোমাদের স্বাগত
অভিবাসনপ্রত্যাশীরা জার্মানিতে পা রেখেই দেখেছে অবাক হওয়ার মতো দৃশ্য৷ এখানে তাঁরা অনাহূত নয়৷ নিজের দেশ থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে জার্মানিতে পাচ্ছেন সাদর সম্ভাষণ!
ছবি: Getty Images/A. Beier
জার্মানির নেতৃত্বে ম্যার্কেল, ইউরোপের নেতৃত্বে জার্মানি
বৃহস্পতিবার আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেছেন, শরণার্থীদের বিষয়ে জার্মানির ভূমিকা হতে হবে অনুসরণীয়, দৃষ্টান্তমূলক৷ জার্মানির সংসদের নিম্নকক্ষ বুন্ডেসটাগে বক্তব্য রাখার সময় তিনি আরো বলেন, অভিবাসন সংকট মোকাবেলায় ইউরোপকেও সফল হতে হবে৷
দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটিকে শরণার্থীরা নিজেদের একজন হিসেবেই বরণ করে নিয়েছিলেন৷ শরণার্থীদের সঙ্গে বন্ধুর মতোই সময় কাটিয়েছেন ম্যার্কেল৷ কয়েকজন শরণার্থী তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলতে চেয়েছিলেন৷ সানন্দে তাঁদের আশা পূরণ করেছেন ম্যার্কেল৷