ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত ব্রিকসে আরও ছয়টি দেশকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে৷ ব্রিকসের এমন সম্প্রসারণ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেছে৷
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেছেন, ব্রিকস যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, কারণ, তাদের স্বার্থের মধ্যে অনেক ভিন্নতা আছে৷
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ‘আমাদের অংশীদার এবং দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বহুমাত্রিক মিত্রদের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে... যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, বিভিন্ন দেশ তাদের ইচ্ছামতো অংশীদার এবং গ্রুপ বেছে নিতে পারে৷''
হোয়াইট হাউস বলছে, পশ্চিমা দেশগুলো নতুন দিল্লির বৈঠকে ‘শক্তিশালী ফলাফল' আশা করছে, যা জি-টোয়েন্টির ভূমিকাকে ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রধান ফোরাম' হিসাবে তুলে ধরবে৷
ব্রিকসের নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রকাশ্যে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পশ্চিমা অনেক দেশ৷ ৷ তবে তারা হয়ত নিজেদের মধ্যে অন্যরকম চিন্তা করে থাকতে পারে, বলে মনে করছে পশ্চিমা কয়েকটি গণমাধ্যম৷ যেমন নরওয়ের আফটেনপস্টেন সংবাদপত্র লিখেছে, ব্রিকস ‘স্বৈরাচারী এবং প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের একটি বৈশ্বিক ক্লাবে পরিণত হয়েছে, যার প্রধান হচ্ছে চীন এবং রাশিয়া৷'' এসব দেশের মানুষের আরও ভালো কিছু প্রাপ্য বলেও মন্তব্য করেছে পত্রিকাটি৷
নেদারল্যান্ডসের এনআরসি সংবাদপত্র মনে করছে, ‘‘আসলে, শেষ পর্যন্ত, শুধুমাত্র আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে- যা চীনের জন্য একটি ধাক্কা৷'' দক্ষিণ আফ্রিকা জোর দিয়ে বলেছে যে, ব্রিকসকে পশ্চিমা বিরোধী প্ল্যাটফর্ম হিসাবে দেখা ‘সম্পূর্ণ ভুল'৷ ‘‘গ্রুপটি এখনও জি-সেভেন এর বিকল্প নয়, যেমনটা চীন একে দেখতে চায়,'' লিখেছে এনআরসি৷
বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণে ব্রিকস
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর বিশ্বের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মেরুকরণে নতুন আলোচনায় ‘ব্রিকস’৷ পাঁচ দেশের এই জোট এখন আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে৷ যার নতুন সদস্য হতে পারে বাংলাদেশও৷ ব্রিকসের আদ্যোপান্ত ছবিঘরে৷
ছবি: Fang Zhe/Xinhua/IMAGO
নামকরণের ইতিহাস
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন; বিশ্বের দ্রুত বেড়ে চলা অর্থনীতির চার দেশ৷ তাদের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে ২০০১ সালে প্রথম ‘ব্রিক’ শব্দটি ব্যবহার করেন মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাক্সের সেসময়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিল৷ ধারণাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় দেশগুলোও৷ ২০০৬ সালে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সম্মেলন চলাকালীন পুটিনের উদ্যোগে চার দেশের মন্ত্রীরা জোটের কার্যক্রম নির্ধারণে আলোচনায় বসেন৷
ছবি: Pavel Golovkin/AP Photo/picture alliance
সাউথ আফ্রিকার অন্তর্ভূক্তি ও ব্রিকস
২০০৯ সালে রাশিয়ায় ব্রিকের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ ২০১০ সালের ডিসেম্বরে সাউথ আফ্রিকা জোটে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেয়৷ এর মাধ্যমে ব্রিক পরিণত হয় ব্রিকস-এ৷ ব্রিকের তৃতীয় আর পাঁচ দেশ নিয়ে প্রথম সম্মেলনটি হয় ২০১১ সালে বেইজিং-এ৷ তার আগে ২০১০ সালে দ্বিতীয় সম্মেলনটি বসেছিল ব্রাসিলিয়াতে৷
২০০৯ সালে ব্রিক দেশগুলোর নেতাদের সম্মেলন শেষে একটি যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়৷ তাতে বলা হয়, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমৃদ্ধি অর্জনে কাজ করবে তারা৷ তবে বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আধিপত্য বজায় রাখা উন্নত দেশগুলোর জোট জি-সেভেন এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই এই জোট নিয়ে মাঠে নামে চীন ও রাশিয়া৷
ছবি: Wu Hong/AP Images/picture alliance
কতোটা শক্তিশালী ব্রিকসের অর্থনীতি?
ব্রিকস বর্তমানে বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে অন্যতম বৃহৎ শক্তিশালী জোট৷ কিছু পরিসংখ্যানে সেই চিত্র পাওয়া যায়৷ জাতিসংঘের বিনিয়োগ বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই পাঁচ দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ৷ বিশ্বের অর্থনৈতিক জিডিপির ৩১ শতাংশ বা এক তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রক তারা৷ বিশ্ব বাণিজ্যেরও ১৬ শতাংশ পাঁচটি দেশের দখলে৷
ছবি: AP
নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক
বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা এই পাঁচ দেশ ২০১৪ সালে বিশ্ব্যাংকের আদলে ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ গঠন করে৷ চীনের সাংহাইয়ে এর প্রধান কার্যালয়৷ ব্যাংকটি ৫০ বিলিয়ন ডলারের ‘সিড মানি’ বা প্রাথমিক মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে৷ তবে পাঁচ দেশের বাইরেও এর সদস্য হওয়ার পথ উন্মুক্ত রাখা হয়৷ বিভিন্ন প্রকল্পে এখন পর্যন্ত তাদের অনুমোদিত অর্থায়নের পরিমাণ তিন হাজার ২৮০ কোটি ডলার৷
ছবি: Ji Haixin/MAXPPP/dpa/picture alliance
বাংলাদেশের সদস্যপদপ্রাপ্তি
ব্যাংকটির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ দেশের বাইরে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রথম নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হয়৷ একই বছরের চার অক্টোবর সদস্য হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত৷ আর ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নতুন সদস্য হয়েছে মিশর৷ সম্ভাব্য সদস্য হিসেবে উরুগুয়ের নাম রয়েছে৷
ছবি: Wang Gang/Costfoto/picture alliance
ডলারকে হুমকি
আগস্টে ব্রিকসের ১৫ তম সম্মেলন বসবে সাউথ আফ্রিকায়৷ ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের বিষয়টি এই বৈঠকের অন্যতম আলোচ্য হতে যাচ্ছে। ডলারের পরিবর্তে কিভাবে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন করা যায় তার একটি রূপরেখা তুলে ধরা হতে পারে এই বৈঠকে৷ কার্যকর বিকল্প চালু করতে পারলে তা বিশ্ব অর্থনীতির একচ্ছত্র মুদ্রা ডলারের আধিপত্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে৷
ছবি: Khaled Elfiqi/epa/dpa/picture alliance
বাংলাদেশের সদস্যপদ
আগস্টের এই বৈঠক থেকে ব্রিকসের নতুন সদস্যের ঘোষণা আসতে পারে৷ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি জেনেভায় শ্রম সম্মেলনে এসে সাংবাদিকদের বাংলাদেশের সদস্য হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন৷ তাছাড়া, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের আরো কয়েকটি বৃহৎ অর্থনীতির দেশও ব্রিকসের সদস্য হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি৷ এর ফলে ব্রিকস হয়ে উঠতে পারে ‘ব্রিকস প্লাস’৷
ছবি: DW
জি -৭ এর প্রতিদ্বন্দী?
জিডিপির আকারের দিক থেকে ব্রিকস এরইমধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-সেভেনকে পেছনে ফেলেছে৷ জি -সেভেন যেখানে বিশ্বের উত্তরের দেশগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করছে, ব্রিকস সেখানে উদীয়মান এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একত্রিকে করে একটি প্লাটফর্ম করার চেষ্টা করছে৷ যে কারণে ব্রিকস বিশ্ব অর্থনীতিতে জি-সেভেন এর প্রভাব কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন অনেকে, যা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে৷
ছবি: Susan Walsh/AP Photo/picture alliance
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মেরুকরণ
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক মেরুকরণের প্রভাব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ এমন বাস্তবতায় এক যুগেরও বেশি আগে যাত্রা করা ব্রিকসকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের বিকল্প হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন অনেকে৷ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলো ক্রমেই ব্রিকস জোটে ভিড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বলেছেন, ব্রিকসের সম্প্রসারণ বড় কোনো বিষয় নয়৷ ২০২৩ সালে এসে একটি দেশ অন্য কোথাও মিত্র খুঁজবে সেটিই স্বাভাবিক, বলে মনে করেন তিনি৷ ‘‘বর্তমান সময়ে প্রতিটি দেশ সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন,'' বলেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যেক দেশকে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে: কোন অংশীদারিত্ব তার নিজস্ব মূল্যবোধ এবং স্বার্থের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত? দীর্ঘমেয়াদে কোনটি এর জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী?''
ব্রিকস দেশগুলোর সম্মেলনকে একটি সমস্যা হিসাবে দেখছে জার্মানির কিছু গণমাধ্যম৷ তবে বেয়ারবক এর সঙ্গে একমত নন৷ তিনি বলেন, ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থা ওএসসিই এবং জি-টোয়েন্টিরও তাদের সদস্য বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে৷
তবে ইউরোপীয় সংসদে সবুজ দলের (বেয়ারবকের দল) পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কো-অর্ডিনেটর রাইনহার্ড ব্যুটিকোফার বলেন, ‘‘ব্রিকস সম্প্রসারণের কারণে এই গ্রুপের চরিত্র বদলে যাবে৷ চীনের আধিপত্য বাড়বে এবং ব্রিকস একটি স্পষ্ট কর্তৃত্ববাদী গ্রুপে পরিণত হবে৷''
ইইউ একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে বলেও মনে করছেন তিনি৷ ‘‘ইউরোপ যে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য, নির্ভরযোগ্য এবং ন্যায্য অংশীদার হতে চায়, তা প্রমাণ করার জন্য অনেক বছর নেই,'' বলেন ব্যুটিকোফার৷ ‘‘যদি আমরা সফল না হই, তাহলে এই দেশগুলোর অনেকে ব্রিকসের দিকে ঝুঁকতে পারে,'' বলে সতর্ক করে দেন তিনি৷