‘ব্রিকস' নিয়ে কেন উদ্বিগ্ন ট্রাম্প?
১০ জুলাই ২০২৫
‘ব্রিকস'-এর অ্যামেরিকাবিরোধী নীতির সঙ্গে যেসব দেশ হাত মেলাবে, অতিরিক্ত আরো ১০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে তাদের- সম্প্রতি সমাজমাধ্যমে সরাসরি এই হুমকিই দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প৷ তার দাবি, ‘ব্রিকস' মূলত বিশ্বের বাণিজ্য ও অর্থনীতির বাজারে মার্কিন ডলারের আধিপত্য কমিয়ে অ্যামেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলার চেষ্টা করছে৷ আন্তর্জাতিক এই অর্থনৈতিক জোটের সদস্য দেশগুলির মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলি৷ পাশাপাশি এই জোটে যোগ দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইরান, ইন্দোনেশিয়া ও মিশরের মতো দেশও৷ ‘ব্রিকস'-এর অন্যতম সদস্য দেশ ভারত, ফলে প্রশ্ন উঠছে এই পরিস্থিতিতে ভারতের পদক্ষেপ কী হবে৷ ইতিমধ্যেই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে অ্যামেরিকার৷ সেই চুক্তি হলেও কি বাড়তি শুল্ক দিতে হবে মোদী সরকারকে?
গত রবিবার ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরো শহরে আয়োজিত হয়েছিল ‘ব্রিকস' সম্মেলন৷ সেই সম্মেলনের শেষে ৩১ পাতার একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়৷ প্রায় একই সময় তীব্র হুঁশিয়ারি দিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘ব্রিকস'-এর অ্যামেরিকাবিরোধী নীতির সঙ্গে অন্য কোনও দেশ যুক্ত হলে তাদের উপর আরো ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক চাপানো হবে৷ তার দাবি, মার্কিন ডলারের আধিপত্যে কোনো দেশ যদি হস্তক্ষেপ করতে চায়, তা হলে তাদের চরম মূল্য দিতে হবে৷ কূটনীতিকদের দাবি, ‘ব্রিকস'-এর নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট৷ সেই কারণেই বাড়তি শুল্কের এই হুমকি৷
প্রসঙ্গত, অ্যামেরিকার শুল্ক আরোপের ৯০ দিনের স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে৷ হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, বহু দেশকে তাদের নতুন মার্কিন আমদানি শুল্ক সম্পর্কে জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন৷ গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প স্পষ্ট হুমকি দিয়েছিলেন যে, বাণিজ্যে ডলারের আধিপত্যবাদে হস্তক্ষেপ করলে ১০০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে৷ বর্তমান হুঁশিয়ারির তীব্রতা তার থেকে কম হলেও ‘ব্রিকস'-এর নীতি নিয়ে ট্রাম্পের উদ্বেগ অস্পষ্ট নয়৷
গত এক দশকে ধীরে ধীরে বেড়েছে আন্তর্জাতিক এই জোটের সদস্য সংখ্যা৷ চার সদস্যের জোট থেকে ধীরে ধীরে তা পরিণত হয়েছে দশ সদস্যে৷ জানুয়ারি মাসে যোগ দেয় ইন্দোনেশিয়া৷ সৌদি আরবসহ আরো কিছু দেশ সদস্য হতে আগ্রহী৷ বলা হয়, জি-সেভেন আন্তর্জাতিক জোটের বিকল্প ‘ব্রিকস'৷ বিশ্বের অর্থনীতির এক চতুর্থাংশ এবং জনসংখ্যার অর্ধেকের প্রতিনিধিত্ব করে এই জোট৷
ব্রাসেলস শহরের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ব্রুগেল'-এর অন্যতম অধিকর্তা অ্যালিসিয়া গার্সিয়া হেরেরো-র দাবি, ‘ব্রিকস' নিয়ে ট্রাম্পের উদ্বেগ অত্যন্ত স্বাভাবিক৷ তিনি ডিডবলিউকে জানান, ‘‘ব্রিকস যে পশ্চিমা বিশ্ব-বিরোধী তা স্পষ্ট ভাবেই বোঝা যায়৷ বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে পরিবর্তন করাই এই জোটের বিশেষ উদ্দেশ্য৷''
‘ব্রিকস'-এর ডলার-বিরোধিতা ও বিকল্প মুদ্রা
তবে ট্রাম্পের উদ্বেগের যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞ৷ তাদের মতে, ডলারের থেকে আলাদা একটা বৈশ্বিক মুদ্রার ব্যবস্থা করতে চাইছে এই সংগঠন৷ স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য প্রচারের মাধ্যমে ডলারের উপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে৷ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং শুল্কের কারণে, রাশিয়া এবং চীন এই ডলার-নির্ভরতা কমানোর পদক্ষেপে অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়েছে৷ রুবেল এবং ইউয়ানের মাধ্যমে সব রকম জ্বালানি চুক্তির নিষ্পত্তি করছে। পাশাপাশি , ভারত ২০২৩ সাল থেকেই রুশ তেল ক্রয় করার জন্য ইউয়ান, রুবেল এবং এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দিরহামে মূল্য প্রদান করেছে বলে জানা গিয়েছে৷
কিন্তু সেই ব্যবস্থার বাস্তবতা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন৷ আন্তর্জাতিক এই জোটের সদস্যদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা থাকায় সোনা-কেন্দ্রিক সকলের জন্য সাধারণ মুদ্রা, ‘ইউনিট', এখনও চালু করা যায়নি৷ চীনের ইউয়ান বেশি গুরুত্ব পাবে এই আশঙ্কায় ভারত এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি৷ অন্য দিকে ব্রাজিলেরও দাবি, ব্রিকস মুদ্রার থেকে স্থানীয় মুদ্রাকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিতে চায়৷
গার্সিয়া হেরেরোর দাবি, ‘ভারত, ব্রাজিলের সাথে মিলে পশ্চিমা-বিরোধী বার্তার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে, এ দিকে যেখানে চীন এবং রাশিয়ার আধিপত্য রয়েছে৷' প্রসঙ্গত, অ্যালিসিয়া ফরাসি বিনিয়োগ ব্যাংক ন্যাটিক্সিসের এশিয়া-প্যাসিফিকের প্রধান অর্থনীতিবিদও। ‘ব্রিকস'-এর ওয়েবসাইট অনুসারে, ২০২৪ সালে প্রায় ৩৩ ট্রিলিয়ন ডলার (€২৮ ট্রিলিয়ন) বৈশ্বিক বাণিজ্যের মধ্যে, আন্তঃব্রিকস বাণিজ্য ছিল মাত্র ৩ শতাংশ, বা প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এই প্রেক্ষিতেই অর্থনীতিবিদ হারবার্ট পয়েনিশের দাবি, ‘বৈশ্বিক বাণিজ্যের বেশির ভাগ এখনো ডলার ও অন্য প্রথাগত মুদ্রার বিনিময়েই চলে৷ সুতরাং সেটিকে সরিয়ে নতুন মুদ্রা আনতে বহু সময় লাগবে৷' বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯০% লেনদেন এবং ৫৯% বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে অ্যামেরিকান মুদ্রা ব্যবহৃত হয়৷ যার ফলে বেশ কয়েক জন অর্থনীতিবিদের দাবি এখনও ব্রিকস নিয়ে ট্রাম্পের উদ্বেগের কিছু নেই৷ তাঁরা বিশ্বাস করেন যে ইউয়ানের মূলধন নিয়ন্ত্রণ, রুবেলের অস্থিরতা এবং কিছু সদস্যের গ্রিনব্যাক ত্যাগ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা না থাকায় ‘ব্রিকস'-এর বিকল্প মুদ্রা চালু করা এখনো কঠিন৷
‘ব্রিকস'-এর এখনো অনেক পথ চলা বাকি
এ কথা সত্যি যে সম্প্রতি মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইন্দোনেশিয়ার যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আলজিরিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো সহযোগী দেশগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে এই আন্তর্জাতিক জোট৷
অনেক দেশ বাস্তবিকই মনে করে যে, এই জোট সারা বিশ্বে ‘গ্লোবাল সাউথ'-এর কণ্ঠস্বরকে আরও জোরদার করবে। যে সমস্ত দেশ পশ্চিমের চাপানো নিষেধাজ্ঞার বিরক্ত, তারা ‘ব্রিকস পে' এবং ‘ব্রিকস ব্রিজ'-এর মাধ্যমে তাদের অর্থনীতিকে রক্ষা করার পরিকল্পনা করছে৷ এগুলি মূলত সুইফট ব্যবস্থার বিকল্প৷ যদিও গার্সিয়া-হেরেরো ডিডবলিউকে জানিয়েছেন, ‘‘হঠাৎ করেই এই জোটের অংশ হওয়ার জন্য মূল্য দিতে হবে৷ দরিদ্র দেশগুলিকে এই বিষয়টি অনুৎসাহিত করতে পারে৷'' পাশাপাশি, এই জোটের প্রাতিষ্ঠানিক সংহতির অভাব রয়েছে বলেও দাবি বিশেষজ্ঞদের৷ রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক দূরত্ব, বিশেষ করে ভারত ও চীনের কথা উল্লেখযোগ্য৷ অর্থনীতিবিদ হারবার্ট পয়েনিশের কথায়, ট্রাম্পের চিন্তিত হওয়ার কিছুই নেই৷ এই জোটকে এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে৷
‘ব্রিকস'-এর বার্তা
বহু মতপার্থক্য ও দূরত্ব থাকলেও সাম্প্রতিক সম্মেলনে কিন্তু এই জোটের নেতারা ট্রাম্পের শুল্কবিরোধী দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন৷ গত সোমবার এক বিবৃতিতে নাম না করে অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্টের নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক চাপানোর বিষয়টিরও কড়া সমালোচনা করা হয়েছে৷ ‘ব্রিকস'-এর দাবি, ট্রাম্পের এই ধরনের পদক্ষেপ ওয়ার্লড ট্রেড অর্গানাইজ়েশনের নিয়মেক লঙ্ঘন করে এবং বিশ্বের বাণিজ্যকে প্রবল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে৷
নিক মার্টিন/এসটি