সাভারে ভবন ধসে আটকে পড়া পোশাক শ্রমিক রেশমাকে ১৭ দিন পর উদ্ধারের ঘটনাকে ‘ধোঁকা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে একটি ব্রিটিশ পত্রিকা৷ এই নিয়ে ব্লগ, ফেসবুকে চলছে তুমুল আলোচনা৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও এই বিষয়ে তাদের অবস্থান জানিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
গত ১০ মে সাভারে ধসে পড়া ভবনের মধ্য থেকে উদ্ধার করা হয় ২২ বছর বয়সি রেশমাকে৷ ১৭ দিন পর একটি ধসে পড়া ভবন থেকে একজনকে উদ্ধারের এই খবর সাড়া ফেলে গোটা বিশ্বে৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে৷ কিন্তু গত সপ্তাহে রেশমাকে উদ্ধারের এই ঘটনাকে ‘ধোঁকা' হিসেবে আখ্যা দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশের বর্তমান বিরোধী দলপন্থী পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ৷ একই ধরনের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে গেছে লন্ডনের সানডে মিরর৷
বিভিন্ন কমিউটিনিটি বাংলা ব্লগ এবং সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে এই বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে মোঃ হাসান আরিফ লিখেছেন, ‘‘এতদিন পর মনে হচ্ছে রেশমার ঘটনা সাজানো নাটক৷'' একই ব্লগ সাইটে ফজলে রাব্বি জেমস লিখেছেন, ‘‘আমাদের সমস্যা হলো আমরা ভালোর মধ্যেও মন্দ খুঁজি৷'' তিনি রেশমাসহ বর্তমানে আলোচিত বিভিন্ন বিষয়ের প্রেক্ষিতে এই মন্তব্য করেছেন৷
মৃত্যুকূপ থেকে যেভাবে ফিরলেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ এই সতের দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
সুস্থ আছেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ তিনি এখন সুস্থ আছেন৷ কিন্তু ধসে পড়া রানা প্লাজার মধ্যে কিভাবে সতের দিন কাটিয়েছেন তিনি? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন ছবিতে উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার অভিযান
১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক ধসে পড়া ভবনের মধ্যে বেঁচে থাকা একজন মানুষের উপস্থিতি টের পান৷ সেই মানুষটি রেশমা৷ তিনি একটি ভাঙা পাইপ দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান৷ এরপর রড কেটে ভিতরে ঢুকে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়৷
ছবি: Getty Images/STRDEL
যেভাবে টিকে ছিলেন রেশমা
১৭ দিন রেশমা কি খেয়ে টিকে ছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকের৷ উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক জানান, ‘‘রেশমা যে তলায় আটকে ছিলেন সেটা অন্যান্য তলার মতো মিশে যায়নি৷ সেখানে হাঁটা-চলা এবং নড়া-চড়া করার কিছুটা সুযোগ ছিল৷ রেশমা তাঁকে জানান যে, ঐ জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা ও জুস জাতীয় খাবার ছিল, যা তিনি খেয়েছেন৷ ৭ মে শুকনা খাবার শেষ হয়ে যায় আর রসালো খাবার যায় পচে৷ ফলে শেষের দু’দিন ধরে তিনি অভুক্ত ছিলেন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
চিকিৎসকের ব্যখ্যা
ধ্বংসস্তূপের নীচে রেশমার এই ১৭দিন বেঁচে থাকার ঘটনাকে ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশমা ১৭ দিনে হৃদরোগ বা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারতেন৷ হয়ত মানসিক জোর এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার কারণেই তাঁকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ আর গবেষণায় প্রমাণিত যে নারীদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি৷’’
ছবি: Reuters
গোটা বিশ্বে আলোড়ন
রেশমাকে ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধারের খবরে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সাভারে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই তরুণীকে দেখতে যান৷ রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা৷
ছবি: dapd
তৃতীয় নারী রেশমা
১৭ দিন ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকা রেশমাকে উদ্ধারের খবরের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিসি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, এর আগে পাকিস্তানে একই রকম পরিস্থিতিতে নাকাশা বিবি নামক এক নারী পচা খাবার আর পানি খেয়ে টিকে ছিলেন ৬৩ দিন৷ আর হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক টিকে ছিলেন ২৭ দিন৷ এই সময়ের পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images
পরিবারের সঙ্গে দেখা
রেশমার মা জোবেদা খাতুন, দুই ভাই ও বোন আসমা গত কয়েকদিন ধরেই রয়েছেন সাভারে৷ হাসপাতালে রেশমার সঙ্গে দেখা করেছেন তারা৷ রেশমার বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে রেশমা ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’’
ছবি: Reuters
বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
এদিকে, সাভারে ভবন ধসে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর ১২ মে অবধি উদ্ধার করা হয়েছে ১,১২৭ টি মৃতদেহ৷ নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী আর কতজন পুরুষ – সেই হিসেব এখন আরা জানা যাচ্ছে না৷ অনেক মরদেহ পচে গেছে৷ গোটা বিশ্বে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম ভবন ধস এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তবুও কি সতর্ক আমরা?
সাভার ভবন ধসের পর কতটা সতর্ক হয়েছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন অনেকর মনে৷ বিশেষ করে, যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে, সেই খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কতটা সচেষ্ট? সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের যে নেতিবাচক ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক’
শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস গত ৯ মে একটি নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘‘সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক৷ রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে৷’’
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
কমিউনিটি ব্লগ সাইট আমার ব্লগে যাযাবর রাজুর নিবন্ধের শিরোনাম, ‘‘মিররের প্রতিবেদন নিয়ে অতি উত্তেজনা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার লেজুরবৃত্তির আরেক প্রমাণ৷'' এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘বিস্ময়করভাবে দেখা গেলো যুক্তরাজ্যের দৈনিক মিররে আমার দেশের প্রতিবেদনটি এক প্রকার অনুবাদ করে প্রকাশের পর প্রথমসারির দৈনিকগুলো সরব হলো! আর বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সংবাদের পর আমার দেশের সংবাদকে প্রচারে উঠে-পড়ে লাগলাম৷''
ফেসবুকে এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন অনেকে৷ #রেশমা হ্যাগট্যাগ ব্যবহার করে সানডে মিররের প্রতিবেদন সম্পর্কে সিয়াম আশরাফুল লিখেছেন, ‘‘রেশমার কোন সহকর্মী এসে বললো (কোনো প্রমাণ ছাড়া, অথচ উদ্ধারের কাহিনি আমরা টিভিতেই দেখেছি, সিএনএনও এটা দেখিয়েছে) রেশমা উদ্ধারের কাহিনি ভুয়া আর সঙ্গে সঙ্গে এরা নিউজ কাভার করে দিল! ইয়েলো জার্নালিজম জিনিসটাই এটা, হোক্সকে সত্য কাহিনি বলে প্রচার করা আর সত্যকে হোক্স বলা৷''
নুরুদ্দিন আহমেদ বাপ্পি এই বিষয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘রেশমা ইস্যুতে দলীয় আনুগত্যের বাইরে এসে সত্য জানার আগ্রহ নিয়ে বসতে পারলে ভালো হতো৷ যদি এইটা বিম্পি জামাতের প্রোপাগান্ডা হয়ে থাকে তাইলে তারা শতভাগ সফল৷ আমজনতা এইটা নিয়ে কথা বলছে + বলবে৷''
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সোমবার ডেইলি মিররের প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছে৷ এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী ডেইলি মিররের প্রতিবেদনকে ‘‘বিভ্রান্তিকর, হঠকারী এবং কল্পিত'' আখ্যা দিয়েছে৷ ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপি চেষ্টা করেও এই বিষয়ে রেশমার কোনো মন্তব্য পায়নি৷