সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদের শক্তি কমানোর চেষ্টা করলে তার পরিণাম কী হতে পারে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ গ্রীষ্মকালীন বিরতির পর মঙ্গলবার বিকালে সংসদের অধিবেশন শুরু হতেই একের পর এক পরাজয় হজম করতে হলো তাঁকে৷ গভীর রাতে সেই ক্ষতির মাত্রা স্পষ্ট হয়ে গেল৷
প্রথমেই সংসদে টোরি দলের শক্তি কমে গেল৷ দলত্যাগ করে উদারপন্থি দলে যোগ দিলেন ফিলিপ লি৷ ফলে মাত্র একটি আসনের ব্যবধানে সরকারি জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর রইলো না৷ তারপর স্পিকার জন বার্কো সরকারের আপত্তি সত্ত্বেও বিরোধী পক্ষের অনুরোধ মেনে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়ানোর লক্ষ্যে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার অনুমতি দিলেন৷ ৩২৮ জন সদস্য এ বিষয়ে বিতর্কের পক্ষে, ৩০১ জন বিপক্ষে ভোট দেন৷ অর্থাৎ সরকার পক্ষের ২১ জন সংসদ সদস্যও তাঁদের সম্মতি জানিয়েছেন৷ এই প্রস্তাব অনুমোদিত হলে চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের আশঙ্কা দূর হবে৷ ১৯শে অক্টোবরের মধ্যে ইইউ-র সঙ্গে বোঝাপড়ায় ব্যর্থ হলে সরকারকে ৩১শে অক্টোবরে ব্রেক্সিটের সময়মীয়া আরও ৩ মাস বাড়াতে ব্রাসেলসের দ্বারস্থ হতে হবে৷ বুধবারই এই প্রস্তাব অনুমোদিত হতে পারে৷
বলা বাহুল্য, বরিস জনসন এমন পরিস্থিতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন৷ ব্রেক্সিটে আরও বিলম্ব হলে তিনি আগাম নির্বাচনের হুমকি দিয়েছেন৷ কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হলে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের প্রয়োজন৷ বিরোধী লেবার দলের আগাম নির্বাচনে আপত্তি নেই, তবে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়াতে আগামী বছরের ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার শর্ত স্থির করেছে তারা৷
টোরি দলের মধ্যে বিদ্রোহ নিয়েও বিপাকে পড়েছেন জনসন৷ দলের অবস্থানের বিরোধিতা করলে আসন ও আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন হারানোর হুমকি সত্ত্বেও ১ জন দলত্যাগ ও ২১ জন সংসদে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন৷ বিদ্রোহীদের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নাতি নিকোলাস সোমস৷ সবার আগে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে৷ বাকিদেরও একই পরিণতি হবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়৷ দুই প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড ও কেনেথ ক্লার্কও মঙ্গলবার সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন৷
এমন প্রেক্ষাপট ইউরোপীয় ইউনিয়নও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ ব্রিটিশ সরকার আলোচনায় অগ্রগতির দাবি করলেও ব্রাসেলস জানিয়েছে, আইরিশ সীমান্তে ব্যাকস্টপ এড়াতে লন্ডন থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো বিকল্প পেশ করা হয় নি৷ অথচ প্রায় দুই সপ্তাহ আগে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল-এর সঙ্গে আলোচনার পর বরিস জনসন এক মাসের মধ্যে এমন বিকল্প পেশ করার অঙ্গীকার করেছিলেন৷
এই অবস্থায় চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের আশঙ্কা আরও বেড়ে যাচ্ছে৷ বুধবারই ইউরোপীয় কমিশন সেই পরিস্থিতির প্রস্তুতি সম্পর্কে একটি নথি প্রকাশ করতে চলেছে৷ সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, তাতে চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের ফলে ইইউ সদস্য দেশগুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত চাষি, শ্রমিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য আর্থিক সহায়তার উল্লেখ রয়েছে৷ বিশেষ করে আয়ারল্যান্ডে এই সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (ডিপিএ, রয়টার্স)