আর মাত্র একটি দিন৷ প্রায় ৪৭ বছর সদস্য থাকার পর শুক্রবার মধ্যরাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেবে ব্রিটেন৷ তার আগে বুধবার সেই লক্ষ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলো৷ ব্রিটেনের সংসদের দুই কক্ষের পর এবার ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদন করলো৷ ৬২১ জন সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে, ৪৯ জন বিপক্ষে ভোট দিলেন৷ এবার শুধু বাকি ইইউ সদস্য দেশগুলিকে এক লিখিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই চুক্তি অনুমোদন করতে হবে৷ তবে সেই পথে বাধার কোনো আশঙ্কা নেই৷ আগামী কয়েক দিনে ব্রাসেলসে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা রয়েছে৷
এই প্রথম কোনো সদস্য দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করছে৷ তাই বুধবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ঐতিহাসিক ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি কিছু আবেগঘন মুহূর্ত দেখা গেল৷ ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন বলেন, ‘‘আমরা চিরকাল তোমাদের ভালবাসবো এবং কখনোই দূরে থাকবো না৷'' পার্লামেন্টের ব্রেক্সিট সংক্রান্ত সমন্বয়ক গি ফ্যারহোফস্টাট সদস্যদের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেবার আবেদন করেও বলেন, ‘‘আমরা তোমাদের অভাব বোধ করবো৷ তবে এই ভোটের মাধ্যমে চিরবিদায় জানানো হচ্ছে না৷ বরং আশা প্রকাশ করা হচ্ছে যে আবার দেখা হবে৷'' ব্রিটেন কোনো একদিন আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নে ফিরে আসবে বলে আরও কিছু সদস্য আশা প্রকাশ করেন৷
তবে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট পার্টির প্রধান নাইজেল ফারাজ বলেন, একবার ত্যাগ করার পর ব্রিটেন কোনোদিন আর এই রাষ্ট্রজোটে ফিরে আসবে না৷ উল্লেখ্য, ব্রেক্সিটের লক্ষ্যে প্রায় দুই দশকের প্রচেষ্টার পর ফারাজ অবশেষে সাফল্য পাচ্ছেন৷
ব্রেক্সিট সত্ত্বেও বর্তমান পরিকল্পনা অনুযাযী ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কে তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না৷ এই অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হবে৷ ব্রিটেন ঠিক সময়ে বাণিজ্য চুক্তির আশা করলেও ইইউ নেতারা এত কম সময়ে চূড়ান্ত বোঝাপড়া সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করছেন৷ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ বলেন, ইইউ চাপের মুখে তড়িঘড়ি করে কিছু একটা করবে না৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ স্থির করে তা রক্ষা করাই জরুরি৷ উল্লেখ্য, ইইউ ব্রিটেনকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যে একমাত্র ইইউ মানদণ্ড ও বিধিনিয়ম মেনে চললে তবেই ইউরোপের অভ্যন্তরীণ বাজারে অবাধ প্রবেশের অধিকার অটুট থাকবে৷
অন্যদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যে কোনো মূল্যে চলতি বছরের শেষেই সম্পর্ক ত্যাগ করতে বদ্ধপরিকর৷ এমনকি ‘দ্য টেলিগ্রাফ' সংবাদপত্রের সূত্র অনুযায়ী, ব্রেক্সিটের পর সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতেও তিনি প্রস্তুত৷ আগামী সপ্তাহে এক ভাষণে তিনি বাণিজ্যের তুলনায় ব্রিটেনের সার্বভৌমত্বের গুরুত্বকে প্রাধান্য দেবেন বলে সেই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (ডিপিএ, এপি, রয়টার্স)