১২ই ডিসেম্বর আগাম নির্বাচনের প্রচার ও প্রস্তুতির কাজ পুরোদমে শুরু করে দিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ আগামী পাঁচ সপ্তাহ ধরে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে তাঁকে৷ প্রচারের প্রথম দিনেই জনমত সমীক্ষায় টোরি দল কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে৷ ব্রেক্সিট সংক্রান্ত গণভোট থেকে শুরু করে ব্রিটেনে এমন সমীক্ষা অবশ্য বার বার ভুল প্রমাণিত হয়েছে৷ ফলে এবারও নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কোনো স্পষ্ট পূর্বাভাষের আশা করছে না রাজনৈতিক মহল৷
বুধবার ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে দাঁড়িয়ে জনসন নির্বাচনি প্রচার শুরু করেন৷ তাঁর মতে দ্রুত ব্রেক্সিট কার্যকর করতে হলে টোরি দলকেই ভোট দিতে হবে৷ তারপর তাঁর সরকার দেশের জন্য জরুরি কাজগুলিতে হাত দিতে চায়৷ বর্তমান অচলাবস্থার জন্য সংসদকে দায়ী করে তিনি নিজের দলের জন্য জোরালো সমর্থনের আবেদন করেছেন৷
এদিকে নির্বাচনের ঠিক আগে টোরি দলের মধ্যে একের পর এক সংকটের ফলে জনসন কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ছেন৷ এক কেলেঙ্কারির জের ধরে বুধবারই মন্ত্রিসভার এক সদস্যকে পদত্যাগ করতে হয়েছে৷ তার ঠিক আগে নিম্ন কক্ষে সংসদীয় দলের নেতা জেকব রিস-মগ-কে ২০১৭ সালের এক অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে বেফাঁস মন্তব্য করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হয়েছে৷ টোরি দল টুইটারে একটি জাল ভিডিও প্রকাশ করেও সমালোচনার মুখে পড়েছে৷ সেই ভিডিওতে বিরোধী লেবার দলের এক নেতাকে প্রশ্নের উত্তরে নীরব থাকতে দেখা যাচ্ছে৷
নির্বাচনি প্রচারে প্রধানমন্ত্রী জনসন তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ লেবার দলের নেতা জেরেমি কর্বিনের কড়া সমালোচনা করে চলেছেন৷ সংবাদপত্রের লেখনিতে তিনি কর্বিনকে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের সঙ্গে তুলনা করেছেন৷ জনসনের মতে, কর্বিন যেভাবে ব্রিটেনের ধনীদের আক্রমণ করছেন, ১৯৩০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ধনী চাষিদের উপর স্টালিনের দমন নীতির কথা মনে করিয়ে দেয়৷ নিজের ভাষণে জনসন কর্বিনের বিরুদ্ধে বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের পক্ষ নেবার অভিযোগ করেন৷ বুধবার জনসন বার্মিংহ্যাম শহরে একটি জনসভায়ও ভাষণ দেন৷
লেবার নেতা কর্বিনও তীব্র ভাষায় জনসনের সমালোচনা করছেন৷ তাঁর মতে, জনসন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের মুক্ত বাজার ও সরকারি ব্যয় কমানোর বিতর্কিত নীতিকে আরও মারাত্মক রূপে কার্যকর করতে চান৷ ক্ষমতায় এলে তিনি ধনী শ্রেণির স্বার্থরক্ষার বদলে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে চান৷ তবে দলের নেতা হিসেবে কর্বিনও কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছেন, কারণ অনেকেই তাঁর কড়া সমাজতান্ত্রিক বুলি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কে অস্পষ্ট অবস্থান মেনে নিচ্ছে না৷ বুধবার দলের উপ প্রধান টম ওয়াটসন কর্বিনের সঙ্গে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের উল্লেখ করে পদত্যাগ করেছেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, এপি)