বিতর্ক শুরু হয়েছিল সাবেক জুনিয়ার পরিবহণ মন্ত্রী নুসরত ঘনির একটি বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার থেকে। সেখানে তিনি অভিযোগ করেছিলেন, 'মুসলিমনেস'-এর জন্যই তাকে মন্ত্রিত্ব খোয়াতে হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের কাছে সাক্ষাৎকারে এই অভিযোগ করলেও দলীয় স্তরে কোনো লিখিত অভিযোগ দায়ের করেননি তিনি।
কিন্তু নুসরতের অভিযোগ নিয়ে শুরু হয়েছে প্রবল বিতর্ক। কনসারভেটিভ পার্টির একাধিক মন্ত্রী মুখ খুলেছেন, তদন্ত দাবি করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ জানিয়েছেন, নুসরত তার বন্ধু। তিনি যে অভিযোগ করছেন, তা রীতিমতো গুরুতর। তার উচিত আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দায়ের করা। তাহলে তার কথাও নিশ্চয়ই শোনা হবে। আর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা দরকার।
শিক্ষামন্ত্রী নাদিম জাহায়ি বলেছেন, নুসরত যা বলছেন, তানিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। কনসারভেটিভ পার্টিতে ইসলামোফোবিয়া বা বর্ণবাদের কোনো স্থান নেই।
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যখন পার্টিগেট নিয়ে রীতিমতো চাপে, তখন আরেকটি বিতর্ক সামনে এল।
নুসরত কী বলেছেন?
সানডে টাইমসকে নুসরত বলেছেন, ২০২০ সালে তাকে জুনিয়ার পরিবহণ মন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। কনসারভেটিভ পার্টির হুইপ তাকে ডাউনিং স্ট্রিটে একটি বৈঠকে বলেছিলেন, তার মুসলিমনেস হলো এর কারণ। তাকে বলা হয়, তিনি মুসলিম নারী মন্ত্রী বলে তার সহকর্মীরা অস্বস্তি বোধ করছেন।
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall নুসরত জানিয়েছেন, ''এটাও বলা হয়, আমি দলের প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত নই। দলের বিরুদ্ধে ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ আসার পর আমি দলের রক্ষায় সেভাবে উদ্যোগী হইনি।''
তার দাবি, ''এটা স্পষ্ট যে, ১০ ডাউনিং স্ট্রিট আমাকে বিশ্বস্ত মনে করত। কিন্তু আমাকে সরিয়ে দেয়ার পর মনে হয়েছিল, আমার পেটে কেউ ঘুষি মেরেছে। নিজেকে ক্ষমতাহীন ও অপমানিত মনে হয়েছিল। আমি সহকর্মীদের ভয়ে এতদিন চুপ করে ছিলাম।''
সরকারি প্রতিক্রিয়া
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের অফিস জানিয়েছে, জনসন এর আগে নুসরতের সঙ্গে দেখা করেছেন, তার অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছেন এবং তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জানাতে বলেছেন।
চিফ হুইপ মার্ক স্পেনসর জানিয়েছেন, নুসরত তার বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেছেন। কিন্তু তার অভিযোগ মিথ্যা। তিনি এরকম কোনো কথা নুসরতকে বলেননি।
বিচারমন্ত্রী ডমিনিক রাব স্কাই নিউজকে বলেছেন, তার দল ইসলামোফোবিয়া নিয়ে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে চলে। তিনি বলেছেন, নুসরত অভিযোগ দায়ের করলে তদন্ত হবে।
কেন ক্ষমতাসীন দল বিভক্ত?
নুসরতের অভিযোগের আগে ক্ষমতাসীন দলের এমপি উইলিয়াম রাগ অভিযোগ করেছিলেন, দলের হুইপরা সরকারকে সমর্থন করার জন্য এমপি-দের ভয় দেখাচ্ছেন, ব্ল্যাকমেল করছেন। পার্টিগেট কেলেঙ্কারিতে বরিস জনসনকে যাতে ক্ষমতা হারাতে না হয়, সেজন্যই তারা এই কাজ করছেন।
পার্টিগেট নিয়ে জনসনের উপর প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে। দলের কিছু এমপি তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তার বিরুদ্ধে তদন্তও শুরু হয়েছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে রিপোর্ট এসে যাবে। অনেক এমপি সেই রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছেন।
জিএইচ/এসজি (রয়টার্স, এপি, এএফপি)