ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষুদ্র দেশ লুক্সেমবুর্গ সফরে গিয়ে যে এমন নাস্তানাবুদ হতে হবে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সম্ভবত তা ভাবতে পারেন নি৷ সেখানে বসবাসরত বেশ কিছু ব্রিটিশ নাগরিক তাঁর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখিয়েছেন৷ লুক্সেমবুর্গ সরকার তাঁকে সেই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করার বদলে তাঁর প্রতি ‘শীতল' আচরণ দেখিয়েছে৷ ব্রিটিশ প্রতিনিধিদলের অনুরোধ উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নীচে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে৷ এমনকি জনসন সেখানে উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও লুক্সেমবুর্গের প্রধানমন্ত্রী সাভিয়ে বেটেল তাঁর শূন্যস্থানের দিকে ইঙ্গিত করে সাংবাদিকদের বলেছেন, ব্রেক্সিট প্রক্রিয়াকে ঘিরে বর্তমান অনিশ্চয়তা ‘দুঃস্বপ্ন' হয়ে উঠেছে৷ এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায়ও ব্রিটেনের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন তিনি৷ বেটেল বলেন, ‘‘আমাদের শুধু কথার প্রয়োজন নেই৷ অক্টোবরের সময়সীমা মেনে চলতে হলে যত দ্রুত সম্ভব আইনসিদ্ধ নথির প্রয়োজন রয়েছে৷ দলীয় স্বার্থে ভবিষ্যতকে জিম্মি রাখা চলে না৷''
শুধু তাই নয়, প্রকাশ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দাবি বার বার অস্বীকার করেছেন লুক্সেমবুর্গের প্রধানমন্ত্রী এবং ইউরোপীয় কমিশনের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লোদ ইয়ুংকার৷ তাঁরা সাফ জানিয়ে দিলেন, যে ব্রিটেনের সরকার এখনো আইরিশ সীমান্তে ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প তুলে ধরে নি৷ বিকল্প পেশ করার দায় যে ব্রিটেনের কাঁধে রয়েছে, সেই বিষয়টিও বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছেন ইইউ নেতারা৷ অন্যদিকে জনসন ও ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল এ ক্ষেত্রে অগ্রগতির দাবি করে আসছে৷
সোমবার ইইউ নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় সেই অগ্রগতির কোনো লক্ষণ দেখা না গেলেও জনসন ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর৷ অর্থাৎ সংসদের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তিনি সেই সময়সীমা আরও তিন মাস বাড়ানোর আবেদন না করার অঙ্গীকার করেছেন৷ সোমবার অবশ্য তিনি সংবিধান ও আইন মেনেই সেই কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন৷ আগামী মাসে ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে তিনি বিচ্ছেদ চুক্তির প্রশ্নে ঐকমত্যের আশা করছেন৷
দুই পক্ষের আলোচনায় শুধু একটি ক্ষেত্রে কিছুটা প্রতীকী অগ্রগতি ঘটেছে৷ এবার ইইউ-র প্রধান মধ্যস্থতাকারী মিশেল বার্নিয়ে ও ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্টিফেন বার্কলের মধ্যে আবার আলোচনা শুরু হবে৷
এদিকে মঙ্গলবার ব্রিটেনের সুপ্রিম কোর্টে প্রধানমন্ত্রীর সংসদ মুলতুবি রাখার বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিষয়ে শুনানি শুরু হচ্ছে৷ সম্ভবত ৩ দিন পর আদালত রায় জানাতে পারে৷ তার আগে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে যুক্তি শোনা হবে৷ সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় দিলে দ্রুত সংসদের অধিবেশন ডাকতে হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ সে ক্ষেত্রে বরিস জনসনে আরও চাপের মুখে পড়তে চলেছেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (ডিপিএ, রয়টার্স)