আগামী শুক্রবার ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করতে চলেছে৷ তবে ইইউ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে আরও সময় লাগবে৷ চলতি বছরের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যেই সেই প্রক্রিয়া শেষ করতে চান ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ তবে মাত্র এগারো মাসের মধ্যে বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ে ইইউ-র সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে ঘোর সংশয় দেখা দিয়েছে৷ বিষয়টিকে ঘিরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷
ইইউ-র প্রধান মধ্যস্থতাকারী মিশেল বার্নিয়ে সোমবার উত্তর আয়ারল্যান্ড সফরে গিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যে ইইউ কোনো অবস্থায় একক বাজারের অখণ্ডতা নিয়ে আপোশ করবে না৷ তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘নেভার, নেভার, নেভার৷'' তাঁর মতে, ব্রিটেন এতকাল ব্রেক্সিটের ব্যয়ভারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় নি৷ এবার সেই বাস্তবের মুখোমুখি হবার সময় এসে গেছে৷ একক বাজার ও শুল্ক এলাকা ত্যাগ করলে তার পরিণাম ভোগ করতে হবে৷ উল্লেখ্য, ব্রিটেনের কিছু রাজনীতিক সম্প্রতি ব্রাসেলসের কাছ থেকে ব্রেক্সিট-পরবর্তী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানারকম ছাড়ের আশা প্রকাশ করেছেন৷ বার্নিয়ে সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন৷
ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে ইইউ যতটা সম্ভব নমনীয় হবার চেষ্টা করলেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আর আগের মতো অবাধ হতে পারবে না৷ বরিস জনসন চলতি বছরেই এই আলোচনা শেষ করার যে অঙ্গীকার করেছেন, সেই সময়সীমা মোটেই বাস্তবসম্মত নয় বলে ইইউ কর্মকর্তারা বার বার সতর্ক করে দিচ্ছেন৷ তা সত্ত্বেও জনসন সময়সীমা বাড়াতে প্রস্তুত না হলে কোনো চুক্তি ছাড়াই ব্রিটেন ইইউ বাণিজ্য ও শুল্ক কাঠামো ছেড়ে বেরিয়ে যাবে৷
আরেকটি বিষয় নিয়েও ধোঁয়াশা কাটছে না৷ ব্রিটেন ভবিষ্যতে ইইউ-র বিধিনিয়ম কতটা মেনে চলতে প্রস্তুত, সে বিষয়ে জনসনের সরকার এখনো কোনো স্পষ্ট অবস্থান নেয় নি৷ বিশেষ করে ইইউ দেশগুলিতে রাষ্ট্রীয় সাহায্য ও সামাজিক মডেল চালু রয়েছে, সেই কাঠামো ত্যাগ করলে ব্রিটেনের পণ্য প্রবেশের পথে আরও বাধা সৃষ্টি হবে৷ যে কোনো পরিস্থিতিতেই উত্তর আয়ারল্যান্ড সীমান্তে কিছু নিয়ন্ত্রণ চালু করতে হবে বলে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকার মনে করেন৷ বরিস জনসন অবশ্য এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন৷
ব্রেক্সিট-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে উত্তর আয়ারল্যান্ডেও দুশ্চিন্তা বাড়ছে৷ সোমবার বার্নিয়ে সেখানে আয়ারল্যান্ট-পন্থি শিন ফেন ও ব্রিটেন-পন্থি ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন৷ বার্নিয়ে এক ভাষণে বলেন, উত্তর আয়ারল্যান্ডেই ব্রেক্সিটের সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যাবে৷ তিনি ডাবলিনে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, ডিপিএ)