ব্রেক্সিটের ফলে ইইউ’র বাৎসরিক বাজেট প্রায় ১০ থেকে ১১ বিলিয়ন ইউরো কমে যাবে৷ অনুদান বাড়িয়ে ও ভরতুকি কমিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করার কথা ভাবছেন বাজেট কমিশনার গ্যুন্থার ওয়টিঙ্গার৷
বিজ্ঞাপন
ব্রিটেন বিদায় নেওয়ার পর ২০২১ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আয় কমবে প্রায় ১৭ শতাংশ৷ ইইউ'র বাজেটে এটি একটি বড় পরিবর্তন, যার মোকাবিলা করার পন্থা নিয়ে ওয়টিঙ্গার গত বুধবার ব্রাসেলসে একটি নথি পেশ করেন: তাঁর ‘রিফ্লেকশন পেপারে’ ইইউ বাজেটের দীর্ঘমেয়াদি বিকাশ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়েছে৷ বর্তমানে ইইউ'র বাৎসরিক বাজেটের আয়তন হলো ১৫৮ বিলিয়ন ইউরো৷
লভ্য অর্থের উপযুক্ত ব্যবহার, ব্যয়সাশ্রয় ও সদস্যদেশগুলির কাছ থেকে বর্ধিত অনুদানের একটি মিশ্র পন্থা অবলম্বন করে সম্ভাব্য ঘাটতি পূরণ করতে হবে, বলেছেন ওয়টিঙ্গার৷ একদিকে জার্মানির মতো দেশ, যারা ইইউ'র কাছ থেকে যা পায়, তার চেয়ে বেশি অনুদান প্রদান করে থাকে – এই সব দেশের ভবিষ্যতে আরো বেশি অনুদান দিতে হতে পারে৷ অপরদিকে অবকাঠামো, বিনিয়োগ ও কৃষি সংক্রান্ত বাজেট কমানো হলে পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া, গ্রিস, হাঙ্গেরি বা স্পেনের মতো দেশ কম ভরতুকি পাবে৷ ‘‘এক্ষেত্রে সব সদস্য দেশের স্বার্থ যে এক নয়, তা স্পষ্ট,'' বলেন বাজেট কমিশনার ওয়টিঙ্গার৷ ‘‘কিন্তু আমাদের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, একটি চতুর আপোশ খুঁজে পেতে হবে৷ আমাদের ভারসাম্য রেখে চলতে হবে৷’’
ব্রেক্সিটের পর ইউরোপ-প্রেম বাড়ছে
ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের এক বছর পর ইইউ সম্পর্কে ব্রিটেন তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির মানুষের মনোভাব অনেক ইতিবাচক হয়ে উঠেছে৷ ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না’ – এই প্রবাদ ফলে যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Schreiber
শীর্ষে জার্মানি ও ফ্রান্স
ইউরোপীয় ইউনিয়নের চালিকা শক্তি বলে পরিচিত দেশ জার্মানি (৬৮ শতাংশ) ও ফ্রান্সের মানুষ (৫৬ শতাংশ) কিছু সমালোচনা ও সংশয় সত্ত্বেও বরাবর ইইউ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন৷ ব্রেক্সিট গণভোটের পর সেই সমর্থন আরও ১৮ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে৷
ছবি: Reuters/H.Hanschke
ব্রিটেনের ভোলবদল
গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার রায় দেওয়ার পর ব্রিটেনের অনেক মানুষের টনক নড়েছে৷ এখন ৫৪ শতাংশ মানুষ ইইউ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছেন৷ অর্থাৎ এক ধাক্কায় সমর্থন ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ তবে তার ফলে ইইউ থেকে বিচ্ছেদের প্রক্রিয়ায় নড়চড় হবার সম্ভাবনা কম৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Tallis
পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি
কট্টর জাতীয়তাবাদী ও ইইউ-বিরোধী সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও পোল্যান্ড (৭৪ শতাংশ) ও হাঙ্গেরির মানুষ (৬৭ শতাংশ) কিন্তু সমীক্ষায় ইইউ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন৷ বাকি অনেক দেশের তুলনায় তাঁরা বরং এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Schreiber
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল
মন্দার ধাক্কা সামলে ইউরোপের অনেক দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে৷ যেমন নেদারল্যান্ডসের ৮৭ শতাংশ মানুষ এর ফলে সন্তুষ্ট৷ জর্জরিত অর্থনীতি আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠায় স্পেনের মানুষের মধ্যেও ইইউ সম্পর্কে উৎসাহ অনেক বেড়ে গেছে৷
ছবি: Getty Images/T. Lohnes
গ্রিস ও ইটালিতে হতাশা
অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত দেশ গ্রিসের মানুষ এখনো ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় ভুগছেন৷ তাই ইউরোপ সম্পর্কে মাত্র ৩৩ শতাংশ মানুষ তাঁদের উৎসাহ প্রকাশ করেছেন৷ ইটালির অর্থনীতির অবস্থাও ভালো নয়৷ তবে তা সত্ত্বেও সেখানে ৫৬ শতাংশ মানুষ ইইউ-বান্ধব বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Gouliamaki
শরণার্থী সংকট
তুরস্কের সঙ্গে ইইউ-র চুক্তির কারণে শরণার্থীর ঢল কমে যাওয়ায় ইউরোপের অনেক মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন৷ তাঁদের অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে বেশ কিছু ‘পপুলিস্ট’ দল ইউরোপবিরোধী আবেগ সৃষ্টি করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে৷ পরিস্থিতির উন্নতির ফলে তাদের প্রতি সমর্থন অনেক কমে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/L. Pitarakis
6 ছবি1 | 6
কে বেশি দেবে, কে কম পাবে
নির্বাচনের বছরে জার্মানিতে ইতিমধ্যেই তা নিয়ে বিতর্ক চলেছে৷ সামাজিক গণতন্ত্রী এসপিডি দলের রাজনীতিক ও জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গাব্রিয়েল বহুদিন আগেই বলেছেন যে, জার্মানিকে ইউরোপের জন্য আরো বেশি অর্থদান করতে প্রস্তুত থাকতে হবে৷ অর্থমন্ত্রী ভল্ফগাং শয়েবলে কিন্তু এখনই তা নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ৷ আলাপ-আলোচনা আগে শুরু হোক – এই হলো তাঁর মনোভাব৷
অপরদিকে পোল্যান্ড বা হাঙ্গেরির মতো দেশের মুশকিল এই যে, একদিকে যেমন তারা ইইউ'র বাজেট থেকে প্রচুর অর্থ পেয়ে থাকে, অপরদিকে তেমন বিভিন্ন ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের কাজিয়া৷ ‘আইনের শাসন' মেনে না চলার দায়ে এই দু'টি দেশের বরাদ্দ কমানোরও প্রস্তাব উঠেছে৷ গত মে মাসে জার্মান অর্থনীতিমন্ত্রী ব্রিগিটে সুইপ্রিস (এসপিডি) পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির প্রতি অবকাঠামো সংক্রান্ত সাহায্য কমানোর প্রস্তাব দেন৷ ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ-ক্লোদ ইয়ুঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রস্তাব নাকচ করলেও, ওয়টিঙ্গার এবার বলেছেন: ‘‘সে প্রস্তাব এখনও বজায় আছে৷’’
গুড কন্ডাক্ট প্রাইজ?
ইইউ থেকে ভরতুকি পেতে গেলে ‘আইনের শাসন’ মেনে চলতে হবে– এ প্রস্তাব সম্পর্কে ওয়টিঙ্গারের বাজেট রিফ্লেকশন পেপারে বলা হয়েছে, ‘‘আমরা মনস্থির করিনি, কিন্তু বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে৷’’ ইইউ-এর আঞ্চলিক নীতি কমিশনার করিনা ক্রেতু জানিয়েছেন, ২০২০ সাল অবধি বলবৎ চলতি বাজেটে সেরকম কোনো সূত্র না থাকলেও, ভবিষ্যতে তা বদলাতে পারে, ‘‘সংহতি মানে দেওয়া এবং নেওয়া,’’ বলেন ক্রেতু৷ যেসব দেশ ইটালি বা গ্রিস থেকে উদ্বাস্তু নিতে অস্বীকার করছে, তাদের প্রাপ্য কমানোর কথা তিনি এখনই ভাবতে পারেন৷ এক্ষেত্রে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার বরাদ্দ কাটা যেতে পারে৷
গত সপ্তাহে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে একটি ‘সুপারমার্কেট’ হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ করেছেন৷
ব্যার্ন্ড রিগ্যার্ট ( ব্রাসেলস)/এসি
ব্রেক্সিট আলাপ-আলোচনার মূল বিষয়গুলো
২০১৭ সালের ১৯শে জুন ব্রাসেলসে ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনা শুরু হবে৷ শেষ হবার কথা আগামী বছর৷ যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সরকারিভাবে বিদায় নেওয়ার কথা ২০১৯ সালের মার্চ মাসে৷ দু’ পক্ষের মধ্যে আলোচনা হবে কী কী নিয়ে?
ছবি: Getty Images/AFP/O. Scarff
ইইউ’র মার্কেটে প্রবেশাধিকার
প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে ৮ই জুনের সংসদীয় নির্বাচনের আগেই আভাস দিয়েছিলেন যে, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের একীকৃত মুক্ত বাণিজ্য এলাকা ছেড়ে যাবে৷ কিন্তু নির্বাচনে খারাপ ফলাফলের পর টোরি সরকারকে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে৷ অপরদিকে ব্রাসেলসের মনোভাব স্পষ্ট: ব্রিটেনের সিঙ্গল মার্কেটে প্রবেশাধিকার বজায় থাকার শর্ত হলো, ইইউ’র বাকি ২৭টি দেশ থেকে আগত কর্মসন্ধানীদের যুক্তরাজ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার দিতে হবে৷
ছবি: Picture alliance/empics/A. Matthews
ব্রিটেনে ইইউ নাগরিকদের অধিকার
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনায় যুক্তরাজ্যে ইইউ নাগরিকদের অধিকার ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’ পাবে৷ ইইউ-এর মুখ্য মধ্যস্থতাকারী মিশেল বার্নিয়ের বলেছেন, ইইউ’র সকল সদস্যদেশ তাদের নাগরিকদের প্রতি যুক্তরাজ্যে ‘সঠিক ও মানবিক’ আচরণ করা হবে – এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার আগে কোনো আলাপ-আলোচনা হবে না৷ প্রায় ৩০ লাখ ইইউ নাগরিক যুক্তরাজ্যে বাস করেন৷ অপরদিকে ১১ লাখ ব্রিটিশ নাগরিক ইইউ’র অধিবাসী৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Ratcliffe
অভিবাসন
টেরেসা মে ব্রেক্সিটের পর ইউরোপ থেকে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করার সংকল্প ঘোষণা করেছেন৷ কিন্তু অভিবাসন মাত্রাধিকভাবে কমে গেলে যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্য, সামাজিক পরিচর্যা ও নির্মাণকার্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলিতে কর্মীর অভাব দেখা দিতে পারে বলে একাধিক ব্রিটিশ বিধায়কের আশঙ্কা৷ অন্যদিকে ব্রাসেলসের কাছে ব্রিটেনের ইইউ সিঙ্গল মার্কেটে প্রবেশাধিকারের পূর্বশর্ত হলো ইইউ নাগরিকদের ব্রিটেনে কাজ করার অধিকার৷
ছবি: picture alliance/PA Wire /S. Parsons
নিরাপত্তা
যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে চালু নিরাপত্তা সহযোগিতা দু’ পক্ষেরই স্বার্থে৷ জুনের সূচনায় লন্ডনে সন্ত্রাসী আক্রমণের পর উভয় পক্ষই এই নিরাপত্তা সহযোগিতার গুরুত্ব উল্লেখ করেছে৷ কিন্তু ইউরোপোল বা ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মতো প্রক্রিয়াগুলি ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশে ইইউ’র আইন বলবৎ থাকা প্রয়োজন৷ টেরেসা মে তাঁর ‘গ্রেট রিপিল বিল’-এর মাধ্যমে ইইউ আইনসমূহকে ব্রিটিশ আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে চান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/o. Hoslet
‘বিবাহবিচ্ছেদের মাসোহারা’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পেনশন, সেই সঙ্গে ইইউ প্রদত্ত বিভিন্ন ঋণ ও অন্যান্য প্রকল্পে ব্রিটেন যে অর্থদান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাসেলস দাবি করছে যে, যুক্তরাজ্যকে ইইউ’র বাজেটে তার প্রদেয় অনুদান দিয়ে যেতে হবে৷ অন্যদিকে ব্রিটেনে ব্রেক্সিট সমর্থকদের বলা হয়েছিল যে, যুক্তরাজ্য ব্রাসেলসে অর্থদান বন্ধ করবে৷
ছবি: picture-alliance/empics/D. Martinez
ইউরোপের আইনকানুন
টেরেসা মে ব্রিটেনে ইউরোপীয় আদালতের এক্তিয়ারের অন্ত ঘটানোর সংকল্প করেছেন৷ অবশ্য সে-যাবৎ ব্রিটিশ সরকারকে অবস্থান কিছুটা নরম হতে দেখা গেছে৷ ‘গ্রেট রিপিল বিল’-এর একটি অর্থ হলো এই যে, ব্রিটিশ কোম্পানিগুলি তাদের ইইউ সহযোগীদের আইনকানুনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে৷ অপরদিকে ব্রাসেলসের কামনা, ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস (ইসিজে) ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যে ইইউ নাগরিকদের প্রতি সদয় আচরণের গ্যারান্টি দেবে৷
ছবি: Reuters/F. Lenoir
আইরিশ সীমান্ত
আসন্ন আলোচনায় আয়ারল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ সীমান্ত একটি কণ্টকিত বিষয় হয়ে উঠতে পারে৷ আইরিশ প্রজাতন্ত্র আর উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিভাজনরেখা আবার একটি ‘কঠিন সীমান্তে’ পরিণত হোক, তা কোনো পক্ষেরই কাম্য নয়৷ কিন্তু টেরেসা মে আপাতত উত্তর আয়ারল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি-র সঙ্গে জোট সরকার গঠনের চেষ্টা করেছেন৷ তবে দক্ষিণের আইরিশ প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে ডিইউপি’র সম্পর্ক কোনোকালেই ভালো ছিল না৷