ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে নতুন করে তিনটি চিঠি পাঠিয়েছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ একটিতে স্বাক্ষর না করেই ব্রেক্সিটের সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন করেছেন, একটিতে ছিল সময়সীমা না বাড়ানোর আবেদন, অন্যটিতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা৷
বিজ্ঞাপন
শনিবার সংসদে এক ভোটাভুটিতে হেরে নতুন বিপাকে পড়েছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সংসদ সদস্যরা তাঁর আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যকার নতুন চুক্তিটি অনুমোদন স্থগিত রেখে ব্রেক্সিটের সময়সীমা বাড়ানোর আবেদনের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতায় ফেলেছেন৷ জনসনও কম যান না৷ নিজের প্রতিশ্রুতি আর আইন দুটোই রক্ষা করেছেন অভিনব উপায়ে৷
রোববার জনসন তিনটি চিঠি পাঠিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে৷ প্রথমটি পাঠান তিনি ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রুস্ককে৷ চিঠিতি জনসন আইনি বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে সময় বাড়ানোর আবেদন জানান৷ এটি মূলত একটি আইনের খাসড়া কপি৷ এটিতে জনসনের স্বাক্ষর করার কথা থাকলেও তিনি তা করেননি৷
ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে হাজার কুকুরের প্রতিবাদ
যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ বন্ধের দাবিতে প্রায় এক হাজার কুকুর নিয়ে লন্ডনে পার্লামেন্ট অভিমুখে পদযাত্রা হয়েছে৷ ‘উফেরেনডাম’ নামের এই ক্যাম্পেইনের আয়োজকরা বলছেন, তারা ইইউ ছাড়লে পশুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
ইউরোপের নাগরিক
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কের গভীরতা বোঝাতে ‘ইউরোপের নাগরিক’ লেখা প্ল্যাকার্ড গলায় ঝুলিয়ে পাশে নিজের কুকুরটাকে ধরে আছেন একজন বিক্ষোভকারী৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
‘ঘেউ ঘেউ’ করছে ব্রেক্সিট
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে বিদ্রুপাত্মক নানা প্ল্যাকার্ড দেখা যায় লন্ডনে কুকুর নিয়ে পদযাত্রায়৷ একটি কুকুরের গলার সঙ্গে বেঁধে রাখা প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘ব্রেক্সিট ঘেউ ঘেউ করছে’৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
‘ভুগবে’ গৃহপালিত পশু
যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলে পশু চিকিৎসক ও গৃহপালিত পশুর খাবারের সংকট দেখা দেবে– এই যুক্তি দেখিয়ে তার বিরোধিতা করেন বিক্ষোভকারীরা৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
‘উন্মাদ’
ব্রেক্সিটে নিজেদের ক্ষতির বিষয়গুলো তুলে ধরে এর পক্ষের তৎপরতাকে উন্মাদের কার্যকলাপ আখ্যায়িত করা হয় এই কর্মসূচিতে৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
মূত্রখানা
যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত নিতে ২০১৬ সালে গণভোটের প্রচারে ব্রেক্সিটের পক্ষে অবস্থান নেওয়া রাজনীতিকসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ধিক্কার জানানো হয় এই পদযাত্রায়৷ যাত্রাপথে বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ী ‘পি স্টেশন’ বানানো হয় ব্রেক্সিট সমর্থকদের ছবি রেখে, সেখানে কুকুরগুলোকে মূত্র ত্যাগে উৎসাহিত করা হয়৷
ছবি: Imago/Pacific Press Agency/L. Wateridge
ধিক্কার ফারাজে-বরিসকে
গণভোট সামনে রেখে ব্রেক্সিটের পক্ষের শিবিরে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন এবং ইউকে ইন্ডিপেনডেন্স পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজে৷ এই দুজনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক্সিট সমর্থকের ছবি উপর কুকুরগুলোকে প্রস্রাব করিয়ে ধিক্কার জানানো হয় তাঁদের৷
ছবি: Imago/Pacific Press Agency/L. Wateridge
‘বন্ধ কর’ ব্রেক্সিট
ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া বন্ধ করতে দ্বিতীয় গণভোটের দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড লাগানো হয় কুকুরের শরীরে৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
অস্তিত্বে ইইউ
সমগ্র অস্তিত্বজুড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এই বার্তা দিতেই নিজের ও প্রিয় কুকুরের শরীরজুড়ে জড়ানো হয়েছে ইইউ’র পতাকা৷
ছবি: Reuters/H. Nicholls
এক কাতারে নানা শ্রেণি-পেশা
লন্ডনে ব্রেক্সিটবিরোধী এই বিক্ষোভে সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাস্তায় নামেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা৷ কর্মসূচির মধ্যে কুকুর কোলে অ্যালেস্টার ক্যাম্পবেল, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের কমিউনিকেশনস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি বিভাগের পরিচালক ছিলেন৷
জনসন এরপর দ্বিতীয় চিঠিটি পাঠিয়েছেন সময়সীমা না বাড়ানোর যুক্তি দিয়ে৷ সেখানে তিনি আবারও ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের মেয়াদ পেছানো ভুল সিদ্ধান্ত হবে বলে অভিহিত করেছে৷ জনসনের পক্ষে ইইউর কাছে তৃতীয় চিঠিটি পাঠান ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত টিম ব্যারো৷ সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে এবং আজকে সংসদে আবারও আমার অভিমত এবং সরকারের অবস্থান পরিস্কার করেছি৷ আরেক দফা সময়সীমা বাড়ানো যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন দুই পক্ষেরই স্বার্থবিরোধী, সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর৷''
এর মধ্যে প্রথম চিঠিটি প্রাপ্তির কথা নিশ্চিত করেছেন ডোনাল্ড টুস্ক৷ এক টুইট বার্তায় তিনি বলেছেন, সময়সীমা বৃদ্ধির অনুরোধটি পৌঁছেছে৷ এর প্রতিক্রিয়া কী হবে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সাথে আলাপ করে ঠিক করা হবে৷
প্রসঙ্গত, ৩১ অক্টোবরের মধ্যেই ব্রিটেনকে ইউরোপ থেকে বের করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর জনসন৷ গত বৃহস্পতিবার ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ব্রেক্সিট নিয়ে একটি বোঝাপড়াও চূড়ান্ত করেন তিনি৷ সেই চুক্তি অনুমোদন দেয়া হবে কীনা তা ঠিক করতেই শনিবার সংসদ অধিবেশন বসার মত বিরল ঘটনা ঘটে ব্রিটেনে৷ কিন্তু চুক্তির অনুমোদনের আগে প্রয়োজনীয় আইন পাসের পক্ষে ভোট দেন সংসদ সদস্যরা৷ এর ফলে বিধি অনুযায়ী জনসন ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য ইইউর কাছে আবেদন জানাতে বাধ্য৷
এর প্রতিক্রিয়ায় শনিবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে তিনি মরে যেতে রাজি আছেন, কিন্তু সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন করতে রাজি নন৷
এফএস/এআই (এপি, রয়টার্স)
বরিস জনসনের পথচলা
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
জন্ম পরিচয়
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
বেড়ে ওঠা
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwood
পড়াশোনা
কিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Dray
সাংবাদিকতা
ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardy
রাজনীতি
টেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwell
বিতর্ক
টেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantes
ব্রেক্সিটের মুখ
যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nicholls
পরিবার
জনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivas
লেখালেখি
প্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmen
ব্যাপক জনপ্রিয়তা
বাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷