সোমবার গভীর রাতে প্রায় এক মাসের জন্য সংসদ মুলতুবি করেও শেষরক্ষা করতে পারলেন না ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই সংসদ তাঁর পরিকল্পনার পথে এতগুলি বাধা সৃষ্টি করবে, এমনটা তিনি সম্ভবত ভাবতে পারেন নি৷ সোমবার রানির স্বাক্ষরের পর চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে বিরোধীদের আনা প্রস্তাব আইনে পরিণত হয়েছে৷ ১৫ই অক্টোবর তাঁর আগাম নির্বাচনের প্রচেষ্টাও দ্বিতীয়বারের জন্য বানচাল করে দিয়েছে সংসদ৷
একই সঙ্গে আরেকটি প্রস্তাবের মাধ্যমে সংসদ সরকারের উদ্দেশ্যে চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের পরিকল্পনা সংক্রান্ত নথিপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছে৷ সেইসঙ্গে সংসদ মুলতুবি রাখার বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ বার্তাগুলির প্রতিলিপিও প্রকাশ করার দাবি জানানো হয়েছে৷
তবে ভেঙে গেলেও মচকাতে প্রস্তুত নন বরিস জনসন৷ সংসদের অধিবেশনের শেষ লগ্নে তিনি বলেন, আইন পাশ হলেও তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ব্রেক্সিটের সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ করবেন না৷ তাঁর সাফ কথা, ‘‘আমার হাত বেঁধে দিলেও আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ায় বিলম্ব চাইবো না৷'' সেইসঙ্গে তিনি আবার বলেন, সরকার ইইউ-র সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ তবে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হলে সরকার ব্রেক্সিট কার্যকর করতে বিলম্ব করবে না৷ জনসন বলেন, তিনি আগামী ১৭ই অক্টোবর ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে গিয়ে চুক্তির জন্য চেষ্টা চালাবেন৷
বরিস জনসনের সরকার কি তাহলে আইন ভাঙতে চলেছে? পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব সংসদে বলেন, সরকার অবশ্যই আইনকানুন মেনে চলবে, তবে কিছু ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী আইন ও আইনি পরামর্শের কারণে বিষয়টি অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠতে পারে৷
ব্রিটিশ সংসদ ব্রেক্সিটের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য চাপ দিলেও ইইউ সেই আবেদন মঞ্জুর করবে কিনা, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে৷ বিশেষ করে সোমবার আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যে আইরিশ সীমান্তে ব্যাকস্টপের স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য বিকল্প না দিলে তাঁর পক্ষে কোনো সমঝোতায় সমর্থন দেওয়া সম্ভব নয়৷ শুধু সহজ প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে তিনি মতবদল করবেন না৷ আয়ারল্যান্ড ও ইইউ বার বার জানিয়ে দিয়েছে, যে ব্রিটিশ সরকার ব্যাকস্টপের কোনো স্পষ্ট বিকল্প পেশ করে নি৷
বিরোধী লেবার দলের নেতা জেরেমি কর্বিন সোমবার বলেন, তাঁর দল আগাম নির্বাচনের জন্য ব্যাকুল হয়ে রয়েছে বটে, তবে চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের আশঙ্কা পুরোপুরি দূর না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সেই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানাবেন না৷
সোমবার মধ্যরাতের পরেও সংসদের পরিবেশ ছিল উত্তেজনায় ভরা৷ স্পিকার জন বার্কো ৩১শে অক্টোবরের মধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা করে সরকারের উদ্দেশ্যে সংসদের মর্যাদা খর্ব না করার আবেদন জানান৷ সরকার প্রায় এক মাসের জন্য সংসদের অধিবেশন মুলতুবি রাখার যে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বার্কো সেই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, এএফপি)