ব্রেক্সিটের ভবিষ্যত কী হবে, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে যুক্তরাজ্যের সংসদের সিদ্ধান্তের উপরে৷ ইউরোপীয় নেতাদের সাথে বেক্সিট নিয়ে আলোচনা শুরুর একদিন আগে যুক্তরাজ্যের সংসদে এ সংক্রান্ত বিল পাশ হলো৷
বিজ্ঞাপন
বুধবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিলটি পাশ হয়, যার মাধ্যমে ‘ব্রেক্সিট' নিয়ে সরকারের যে কোনো অবস্থান গ্রহণ বা বর্জন করার অধিকার অর্জন করলো সংসদ৷ ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের ১১ জন সংসদ সদস্যের বিদ্রোহের মুখে এ যাত্রা হার হলো টেরেসা মে-র৷ ভোটে এ বিলের পক্ষে ভোট পড়ে ৩০৯টি, অন্যদিকে বিপক্ষে ভোট পড়ে ৩০৫টি৷ এই ভোটের মাধ্যমে ব্রাসেলসের সঙ্গে চূড়ান্ত ব্রেক্সিট চুক্তির ওপর ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে সংসদ আইনি বৈধতা পেল৷ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে-র জন্য ব্রেক্সিট ইস্যুতে এ সিদ্ধান্ত এক বড় ধাক্কা বলে মনে করা হচ্ছে৷ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার এ সিদ্ধান্তে সংসদের কর্তৃত্ব অর্জনকে স্বাগত জানিয়ে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেন, ‘‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের মিটিংয়ের আগে সরকারের এ ক্ষমতা হারানো এক লজ্জাজনক পরাজয়৷ টেরেসা মে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতায় বাধা দিচ্ছিলেন৷'' অন্যদিকে লেবার পার্টির এমপি কেইর স্টার্মার বলেন, এর ফলে যুক্তরাজ্যের ভবিষ্যত এককভাবে কেবল সরকারের উপর ন্যস্ত থাকবে না৷
মীমাংসা ছাড়াই ব্রেক্সিট হতে চলেছে?
২০১৯ সালের মার্চ মাসে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করছে৷ অথচ তার আগে দুই পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়ার আশা কমেই চলেছে৷ শেষ পর্যন্ত কোনো রফা ছাড়াই এই বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হবে – এমন আশঙ্কা আরও দানা বাঁধছে৷
ছবি: Getty Images/L Neal
আগে বিচ্ছেদ, তারপর ভবিষ্যৎ সম্পর্ক
ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুরু থেকেই স্পষ্ট করে দিয়েছে, যে সবার আগে ‘ব্রেক্সিট’ বা বিচ্ছেদ সংক্রান্ত বিষয়গুলির ক্ষেত্রে দুই পক্ষকে বোঝাপড়ায় আসতে হবে৷ যথেষ্ট অগ্রগতি হলে তবেই ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হবে৷ কিন্তু ব্রিটেন দু’টি বিষয় নিয়ে একসঙ্গে দর কষাকষি করতে আগ্রহী, যা ইইউ-র কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়৷
ছবি: Reuters/File Photo/Y. Herman
একই আলোচনা, ভিন্ন মূল্যায়ন
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে তৃতীয় দফার আলোচনার শেষে ইইউ-র শীর্ষ প্রতিনিধি মিশেল বার্নিয়ে বলেন, বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আলোচনায় যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেনি৷ ফলে আপাতত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু হচ্ছে না৷ অন্যদিকে ব্রেক্সিট মন্ত্রী ডেভিড ডেভিস কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্ট অগ্রগতির উল্লেখ করেন৷
তৃতীয় দফার আলোচনার আগে ভবিষ্যৎ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে ব্রিটেন যে অবস্থান প্রকাশ করেছে, তাকে ‘অসম্ভব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন ইইউ-র মিশেল বার্নিয়ে৷ বিচ্ছেদের পরেও একক বাজারে প্রভাব, ইউরোপীয় আদালতের এক্তিয়ার নিয়ে ‘অবাস্তব’ প্রস্তাব নিয়ে বিরক্ত ইইউ প্রতিনিধিরা৷
ছবি: Reuters/F. Lenoir
আয়ারল্যান্ডে ইইউ-র বহির্সীমানা
ব্রেক্সিটের পর আইরিশ প্রজাতন্ত্র ও ব্রিটেনের উত্তর আয়ারল্যান্ডের সীমান্ত ইইউ-র বহির্সীমানা হয়ে উঠবে৷ তার ফলে দুই অংশের মধ্যে নিবিড় অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য যা বড় এক হুমকি৷ দুই পক্ষই একটা সমাধানসূত্র চাইলেও এখনো এই প্রশ্নে যথেষ্ট অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Faith
নাগরিকদের অধিকার
ব্রিটেনে বসবাসরত ইইউ নাগরিকরা ব্রেক্সিটের কারণে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন৷ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁদের সুবিচারের আশ্বাস দিলেও তাঁদের অধিকারের প্রশ্নে চূড়ান্ত নিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে না৷ ইইউ দেশগুলিতে বসবাসরত ব্রিটিশ নাগরিকদের অধিকার নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে৷ জটিল এই প্রশ্নের স্থায়ী সমাধানসূত্র চাইছে ইইউ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Pedersen
‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’?
ব্রাসেলসে আলোচনায় অগ্রগতির অভাবে ব্রিটেন সরাসরি ফ্রান্স ও জার্মানির মতো ইইউ সদস্য দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে ব্রিটেনের ‘দ্য ডেলি টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রের ইঙ্গিত পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ৷ তাঁর স্পষ্ট অবস্থান: ইইউ-র প্রধান মধ্যস্থতাকারী মিশেল বার্নিয়ে ব্রেক্সিট সংক্রান্ত আলোচনার একমাত্র সহযোগী৷
ছবি: Reuters/M. Rehle
7 ছবি1 | 7
তবে সরকারের এক মুখপাত্র জানান, যদিও এ ভোটের ফলাফল ব্রিটিশ মধ্যস্তাকারীদের হতাশ করেছে, তবে এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি প্রস্তুতি বাধাগ্রস্থ হবে না৷
এদিকে ইউরোপিয়ান সংসদ ব্রেক্সিট আলোচনার পরবর্তী ধাপ শুরুর পক্ষে ভোট দিয়েছে৷ তবে যুক্তরাজ্যকে একটি সম্পূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য চুক্তি করার বিষয়ে আবারো সতর্ক করেছে ইইউ৷ একই সাথে ব্রিটিশ ব্রেক্সিট মন্ত্রী ডেভিড ডেভিসের সমালোচনা করে বলা হয়, তাঁর সাম্প্রতিক মন্তব্য পুরো প্রক্রিয়াকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে৷
গত সপ্তাহে ডেভিড ডেভিস বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রাসেলসের সাথে যুক্তরাজ্যের চুক্তিকে ‘স্টেটমেন্ট অফ ইনটেন্ট' বলে অভিহিত করে বলেছিলেন, এটি কার্যকর করার বাধ্যবাধকতা নেই৷ এছাড়াও, নতুন বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী ফল না মিললে ইইউকে ৪৭ থেকে ৫২ বিলিয়ন ইউএস ডলার ডিভোর্স বিল হিসেবে দেবে না ব্রিটেন, এমন মন্তব্যেও ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ইইউ৷
আরএন/ডিজি (এএফপি, রয়টার্স)
ব্রেক্সিট আলাপ-আলোচনার মূল বিষয়গুলো
২০১৭ সালের ১৯শে জুন ব্রাসেলসে ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনা শুরু হবে৷ শেষ হবার কথা আগামী বছর৷ যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সরকারিভাবে বিদায় নেওয়ার কথা ২০১৯ সালের মার্চ মাসে৷ দু’ পক্ষের মধ্যে আলোচনা হবে কী কী নিয়ে?
ছবি: Getty Images/AFP/O. Scarff
ইইউ’র মার্কেটে প্রবেশাধিকার
প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে ৮ই জুনের সংসদীয় নির্বাচনের আগেই আভাস দিয়েছিলেন যে, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের একীকৃত মুক্ত বাণিজ্য এলাকা ছেড়ে যাবে৷ কিন্তু নির্বাচনে খারাপ ফলাফলের পর টোরি সরকারকে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে৷ অপরদিকে ব্রাসেলসের মনোভাব স্পষ্ট: ব্রিটেনের সিঙ্গল মার্কেটে প্রবেশাধিকার বজায় থাকার শর্ত হলো, ইইউ’র বাকি ২৭টি দেশ থেকে আগত কর্মসন্ধানীদের যুক্তরাজ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার দিতে হবে৷
ছবি: Picture alliance/empics/A. Matthews
ব্রিটেনে ইইউ নাগরিকদের অধিকার
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনায় যুক্তরাজ্যে ইইউ নাগরিকদের অধিকার ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’ পাবে৷ ইইউ-এর মুখ্য মধ্যস্থতাকারী মিশেল বার্নিয়ের বলেছেন, ইইউ’র সকল সদস্যদেশ তাদের নাগরিকদের প্রতি যুক্তরাজ্যে ‘সঠিক ও মানবিক’ আচরণ করা হবে – এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার আগে কোনো আলাপ-আলোচনা হবে না৷ প্রায় ৩০ লাখ ইইউ নাগরিক যুক্তরাজ্যে বাস করেন৷ অপরদিকে ১১ লাখ ব্রিটিশ নাগরিক ইইউ’র অধিবাসী৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Ratcliffe
অভিবাসন
টেরেসা মে ব্রেক্সিটের পর ইউরোপ থেকে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করার সংকল্প ঘোষণা করেছেন৷ কিন্তু অভিবাসন মাত্রাধিকভাবে কমে গেলে যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্য, সামাজিক পরিচর্যা ও নির্মাণকার্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলিতে কর্মীর অভাব দেখা দিতে পারে বলে একাধিক ব্রিটিশ বিধায়কের আশঙ্কা৷ অন্যদিকে ব্রাসেলসের কাছে ব্রিটেনের ইইউ সিঙ্গল মার্কেটে প্রবেশাধিকারের পূর্বশর্ত হলো ইইউ নাগরিকদের ব্রিটেনে কাজ করার অধিকার৷
ছবি: picture alliance/PA Wire /S. Parsons
নিরাপত্তা
যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে চালু নিরাপত্তা সহযোগিতা দু’ পক্ষেরই স্বার্থে৷ জুনের সূচনায় লন্ডনে সন্ত্রাসী আক্রমণের পর উভয় পক্ষই এই নিরাপত্তা সহযোগিতার গুরুত্ব উল্লেখ করেছে৷ কিন্তু ইউরোপোল বা ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মতো প্রক্রিয়াগুলি ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশে ইইউ’র আইন বলবৎ থাকা প্রয়োজন৷ টেরেসা মে তাঁর ‘গ্রেট রিপিল বিল’-এর মাধ্যমে ইইউ আইনসমূহকে ব্রিটিশ আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে চান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/o. Hoslet
‘বিবাহবিচ্ছেদের মাসোহারা’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পেনশন, সেই সঙ্গে ইইউ প্রদত্ত বিভিন্ন ঋণ ও অন্যান্য প্রকল্পে ব্রিটেন যে অর্থদান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাসেলস দাবি করছে যে, যুক্তরাজ্যকে ইইউ’র বাজেটে তার প্রদেয় অনুদান দিয়ে যেতে হবে৷ অন্যদিকে ব্রিটেনে ব্রেক্সিট সমর্থকদের বলা হয়েছিল যে, যুক্তরাজ্য ব্রাসেলসে অর্থদান বন্ধ করবে৷
ছবি: picture-alliance/empics/D. Martinez
ইউরোপের আইনকানুন
টেরেসা মে ব্রিটেনে ইউরোপীয় আদালতের এক্তিয়ারের অন্ত ঘটানোর সংকল্প করেছেন৷ অবশ্য সে-যাবৎ ব্রিটিশ সরকারকে অবস্থান কিছুটা নরম হতে দেখা গেছে৷ ‘গ্রেট রিপিল বিল’-এর একটি অর্থ হলো এই যে, ব্রিটিশ কোম্পানিগুলি তাদের ইইউ সহযোগীদের আইনকানুনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে৷ অপরদিকে ব্রাসেলসের কামনা, ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস (ইসিজে) ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যে ইইউ নাগরিকদের প্রতি সদয় আচরণের গ্যারান্টি দেবে৷
ছবি: Reuters/F. Lenoir
আইরিশ সীমান্ত
আসন্ন আলোচনায় আয়ারল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ সীমান্ত একটি কণ্টকিত বিষয় হয়ে উঠতে পারে৷ আইরিশ প্রজাতন্ত্র আর উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিভাজনরেখা আবার একটি ‘কঠিন সীমান্তে’ পরিণত হোক, তা কোনো পক্ষেরই কাম্য নয়৷ কিন্তু টেরেসা মে আপাতত উত্তর আয়ারল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি-র সঙ্গে জোট সরকার গঠনের চেষ্টা করেছেন৷ তবে দক্ষিণের আইরিশ প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে ডিইউপি’র সম্পর্ক কোনোকালেই ভালো ছিল না৷