ব্রেক্সিট চুক্তির প্রশ্নে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে শেষ লগ্নে বোঝাপড়ার সম্ভাবনার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না৷ ব্রিটিশ সরকার আইরিশ সীমান্তে ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার কোনো স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য বিকল্প পেশ করে নি৷ আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতির লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না৷ ইউরোপীয় কর্মকর্তারা এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন৷ ব্রিটেন ‘লোক দেখানো' আলোচনার ভান করছে বলে তাঁরা অভিযোগ করছেন৷ বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নেতারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যে তাঁরা ব্যাকস্টপ ছাড়া ব্রেক্সিট চুক্তি মেনে নেবেন না৷ উপযুক্ত কারণ থাকলে পার্লামেন্ট অবশ্য ব্রেক্সিটের সময়সীমার আবেদন বিবেচনা করতে প্রস্তুত৷
এই অবস্থায় ইইউ-র প্রধান মধ্যস্থতাকারী মিশেল বার্নিয়ে বলেছেন, আগামী ১৭ ও ১৮ই অক্টোবর ইইউ শীর্ষ সম্মেলনের আগে বোঝাপড়া সম্পর্কে আশাবাদের কোনো কারণ নেই৷ তাঁর মতে, ব্রিটিশ সংসদ চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়াতে আইন প্রণয়ন করলেও তা কার্যকর হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে৷ ভবিষ্যতে দুই পক্ষের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির পূর্বশর্তও তুলে ধরেন বার্নিয়ে৷ টেরেসা মে সরকারের সঙ্গে এই প্রশ্নে ইইউ-র সব বোঝাপড়া মেনে চললে তবেই এমন চুক্তি সম্ভব হতে পারে বলে তিনি মনে করেন৷
ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিলতা গোটা প্রক্রিয়াটিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে৷ সরকার সংসদ মুলতুবি রেখেছে৷ সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে একাধিক আদালতে সংঘাত চলছে৷ স্কটল্যান্ডের সর্বোচ্চ আদালত সংসদ মুলতুবি রাখার সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করায় আগামী মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টির ফয়সালা হবে৷ ইংল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের আদালত অবশ্য সরকারের পক্ষেই রায় দিয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্ট স্কটিশ আদালতের রায় বহাল রাখলে সরকারকে অবিলম্বে সংসদের অধিবেশন ডাকতে হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
এই অবস্থায় বিরোধী পক্ষ চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে৷ সরকারের নিজস্ব ‘অপারেশন ইয়েলোহ্যামার' নথিপত্রকে সম্বল করে তারা ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করে দিচ্ছে৷ অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এখনো ‘যে কোনো মূল্যে' ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর৷ একমাত্র তিনিই ইইউ-র সঙ্গে বোঝাপড়া সম্পর্কে আশাবাদ প্রকাশ করে চলেছেন৷
সেই বোঝাপড়ার অঙ্গ হিসেবে শুধু আয়ারল্যান্ডের জন্য আলাদা করে এক ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার সম্ভাবনাও উঠে আসছে৷ অর্থাৎ ব্রেক্সিট চুক্তির আওতায় ব্রিটেনকে সামগ্রিকভাবে ইইউ-র বাণিজ্যিক কাঠামোর মধ্যে না রেখে শুধু উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম কার্যকর করার পুরানো প্রস্তাবকে সমাধানসূত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে৷ তবে ব্রিটিশ সরকারের জোটসঙ্গী উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডিইউপি দল এখনো ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিভাজনের বিরোধিতা করছে৷ উল্লেখ্য, দ্য টাইমস সংবাদপত্র এই প্রশ্নে ডিইউপি দলের নমনীয়তার দাবি করেছিল৷ সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী আয়ারল্যান্ড সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ এড়াতে তারা ইইউ-র কিছু নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে রাজি হয়েছিল৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, এএফপি)