ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের পরিবারগুলোতেও যে মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে, এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই৷ এবার খোদ প্রধানমন্ত্রীও সেই বিভাজনের বিষয়টি মানতে বাধ্য হলেন৷ বরিস জনসনের ভাই ও সরকারের প্রতিমন্ত্রী জো জনসন বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন৷ তিনিও টোরি দলের ২১ জন বিদ্রোহীদের একজন, যারা চলতি সপ্তাহে সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন৷ জো জানিয়েছেন, একদিকে পরিবারের প্রতি আনুগত্য, অন্যদিকে জাতীয় স্বার্থের মধ্যে টানাপড়েনের ফলে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন৷ বরিস জনসন বলেন, ‘‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিষয়ে আমার ভাই আমার সঙ্গে একমত নয়৷ এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পরিবার ও সবার মধ্যে বিভাজন দেখা যাচ্ছে৷''
ভাইয়ের এমন সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও নিজস্ব অবস্থানে অবিচল রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ বিরোধী ও বিদ্রোহীদের উদ্যোগে সংসদের নিম্ন কক্ষ চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়াতে যে প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, শুক্রবার উচ্চ কক্ষ সম্ভবত সেটি অনুমোদন করবে৷ সে ক্ষেত্রে সোমবার সেটি আইন হিসেবে কার্যকর হবে৷ তা সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার বরিস জনসন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ব্রাসেলসের কাছে ব্রেক্সিটের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করতে একেবারেই উৎসাহী নয়৷ তিনি বলেন ‘‘তার চেয়ে বরং আমি গর্তের মধ্যে মরে পড়ে থাকবো৷''
সোমবার ব্রিটিশ সংসদে আগাম নির্বাচন নিয়ে ভোটাভুটি হবার কথা৷ নীতিগতভাবে বিরোধী পক্ষও আগাম নির্বাচনের পক্ষে৷ তবে সেই নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সরকারের সঙ্গে সংঘাত দেখা দিচ্ছে৷ বরিস জনসন ১৫ অক্টোবর, অর্থাৎ ইইউ শীর্ষ সম্মেলনের আগেই নির্বাচন আয়োজন করতে চান৷ অন্যদিকে বিরোধীরা সেই সম্মেলনে ব্রেক্সিট সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের পর জনগণের মুখোমুখি হতে চায়৷ এ বিষয়ে দুই পক্ষের ঐকমত্য না হলে প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার সম্ভব নয়৷
ব্রেক্সিটের বিষয়ে বোঝাপড়ার লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না৷ ব্রিটেনে আগাম নির্বাচন নিশ্চিত হলে সেই প্রক্রিয়া একেবারে থমকে যাবে বলে কূটনীতিকরা আশঙ্কা করছেন৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইইউ কূটনীতিক বলেন, ‘‘ব্রিটিশ পক্ষ আগের মতোই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে চলেছে৷ ফলে কোনো কিছুর পূর্বাভাষ দেওয়া অত্যন্ত কঠিন৷''
বরিস জনসন আর সময় নষ্ট না করে নির্বাচনি প্রচার শুরু করে দিচ্ছেন৷ শুক্রবার তিনি স্কটল্যান্ডে ভোটারদের কাছে নিজের বক্তব্য তুলে ধরবেন৷ উল্লেখ্য, স্কটল্যান্ডের মানুষ গণভোটে ইইউ-তে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন৷ সেখানে আঞ্চলিক নেতার পদত্যাগের পর জনসনের টোরি দল বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে৷ বৃহস্পতিবার জনসন ইংল্যান্ডের উত্তরেও আগাম নির্বাচনের পক্ষে সওয়াল করেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (ডিপিএ, রয়টার্স, এএফপি)