লুক্সেমবুর্গের প্রধানমন্ত্রী সোমবার ব্রেক্সিটকে ঘিরে বর্তমান অচলাবস্থাকে ‘দুঃস্বপ্ন' হিসেবে বর্ণনা করেছেন৷ সেই মূল্যায়ন কতটা যথার্থ, সপ্তাহান্তের মুখে তা আবার টের পাওয়া গেল৷ চারিদিক থেকে প্রবল চাপ সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার এখনো আইরিশ সীমান্তে ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব পেশ করতে নারাজ৷ এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান সভাপতি দেশ ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আন্টি রিনে চলতি মাসের শেষের মধ্যে এই মর্মে লিখিত প্রস্তাব পেশ করার সময়সীমা স্থির করে দেওয়া সত্ত্বেও বরিস জনসনের সরকার সেই হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ জনসন একাই অগ্রগতির দাবি করে আসছেন৷ অন্যদিকে ইইউ-র সব নেতাই একবাক্যে জানিয়ে দিচ্ছেন, জটিলতা কাটাতে বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হয় নি৷
আগামী ১৭ ও ১৮ই অক্টোবর ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে ব্রেক্সিট সংক্রান্ত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা৷ উপস্থিত নেতাদের চুক্তিসহ ব্রেক্সিট, চুক্তিহীন ব্রেক্সিট অথবা ব্রেক্সিটের সময়সীমা বাড়ানোর মধ্যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে হবে৷ কিন্তু ইইউ কর্মকর্তারা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যে তার আগে ব্রিটেন কোনো সমাধানসূত্র পেশ না করতে পারলে সেই প্রস্তাব খতিয়ে দেখার জন্য যথেষ্ট সময় থাকবে না৷ সে ক্ষেত্রে ইইউ শীর্ষ নেতারা শেষ মুহূর্তে সেই প্রস্তাব বিবেচনা করতে পারবেন না৷ অথচ ব্রিটেন সেই চাপ উপেক্ষা করে সময়সীমার গুরুত্ব স্বীকার করতে চাইছে না৷ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের এক মুখপাত্র বৃহস্পতিবার বলেন, প্রস্তাব প্রস্তুত হলে তবেই তা পেশ করবে লন্ডন, এ ক্ষেত্রে কোনো কৃত্রিম সময়সীমা মানা হবে না৷ ব্রাসেলস যখন আরও গঠনমূলক সুরে কথা বলবে, তখনই এই পদক্ষেপ নেওয়া হবে৷ মোটকথা নিজস্ব দায়িত্ব পালন করার বদলে ব্রিটিশ সরকার ইইউ-র উদ্দেশ্যে ‘সৃজনশীলতা' ও ‘নমনীয়তা' দেখানোর ডাক দিচ্ছে৷ ব্রেক্সিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিটিশ মন্ত্রী স্টিফেন বার্কলেও স্পেনে একই মন্তব্য করেন৷
ইইউ কমিশন প্রেসিডেন্ট জঁ-ক্লোদ ইয়ুংকার ব্রিটেনের স্কাই টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবার খোলসা করে বলেন, আইরিশ সীমান্তে জটিলতা কাটাতে সব লক্ষ্য পূরণ হলে ব্যাকস্টপের আর কোনো প্রয়োজনই থাকবে না৷ ইয়ুংকার বলেন, এখনো দুই পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন৷
ব্রিটেন বুধবার রাতে ইইউ কমিশনের কাছে কিছু গোপন কাগজপত্র জমা দিয়েছে বটে, কিন্তু তার মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নেই৷ পণ্য চলাচল, শুল্ক ইত্যাদি কিছু বিষয়ে আলোচনার ভিত্তি হিসেবে সেগুলি প্রস্তুত করা হয়েছে৷ ইইউ কমিশনের মুখপাত্র বেশি গুরুত্ব না দিলেও সেগুলি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন৷ শুক্রবার ব্রেক্সিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিটিশ মন্ত্রী স্টিফেন বার্কলে ও ইইউ-র প্রধান মধ্যস্থতাকারী মিশেল বার্নিয়ে-র মধ্যে আলোচনায় বিষয়টি উঠে আসবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
এদিকে ব্রিটেনের সুপ্রিম কোর্ট সংসদ মুলতুবি রাখার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখে আগামী সপ্তাহে রায় দেবে বলে জানিয়েছে৷ রায় সরকারের বিরুদ্ধে গেলে তড়িঘড়ি করে সংসদের অধিবেশন ডাকতে হবে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (ডিপিএ, রয়টার্স, এএফপি)