চলতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে৷ বাকি সব বিষয়কে ছাপিয়ে সম্মেলনে ব্রেক্সিটই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবার কথা৷ কিন্তু তার আগে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার আশা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে৷ সবকিছু ভালোভাবে এগোলেও আগামী সপ্তাহের আগে কোনো চুক্তির রূপরেখার আশা দেখছেন না কূটনীতিকরা৷ বিশেষ করে আয়ারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও স্পেন খোলাখুলি এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে৷
অথচ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এই শীর্ষ সম্মেলনেই ব্রেক্সিট চুক্তি চূড়ান্ত করে ৩১শে অক্টোবর ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বার করে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর৷ এ ক্ষেত্রে কোনো বিলম্ব বা জটিলতা চাইছেন না তিনি৷ প্রয়োজনে চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকর করার অবস্থানে অটল রয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী৷ আগামী শনিবার ব্রিটিশ সংসদের এক জরুরি অধিবেশনে এ ক্ষেত্রে সব বাধা দূর করতে চান জনসন৷ সোমবার রানির ভাষণের মাধ্যমে তিনি ব্রেক্সিটের প্রশ্নে তাঁর সরকারের দৃঢ় প্রত্যয় তুলে ধরেন৷
ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে আইরিশ সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ এড়াতে ব্রিটেন যে সব প্রস্তাব দিয়েছে, তার ভিত্তিতে এখনো কোনো আইনি কাঠামো সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না হলে জানা গেছে৷ উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশকে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের শুল্ক কাঠামোর মধ্যে রেখেও সেখানে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ইইউ শুল্ক ব্যবস্থা চালু রাখার প্রস্তাব দিয়েছে ব্রিটেন৷ তবে এমন ‘হাইব্রিড' বোঝাপড়া অনেক আইনি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে৷ তাই কোনো কার্যকর বিকল্প স্থির করে হলে ব্রিটেনকে আরও ছাড় দিতে হবে বলে ইইউ কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছেন৷ তাছাড়া শেষ পর্যন্ত বোঝাপড়া সম্ভব হলেও বরিস জনসন ব্রিটিশ সংসদে সেই চুক্তি অনুমোদন করাতে পারবেন কিনা, তা নিয়েও ইইউ মহলে সংশয় দেখা দিচ্ছে৷
এমন প্রেক্ষাপটে ব্রেক্সিটকে ঘিরে গত তিন বছরের অচলাবস্থা কাটার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে উঠছে৷ ব্রিটিশ সংসদের উদ্যোগে আনা আইন মেনে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রেক্সিটের সময়সীমা আরও তিন মাস পেছানোর অনুরোধ জানালে এবং ইইউ সেই অনুরোধ মেনে নিলে জটিলতা কাটাতে আরও কিছু সময় পাওয়া যাবে৷ সেই সময়কালে ব্রিটেনে সাধারণ নির্বাচন এবং সম্ভবত দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হলে সে দেশের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে যেতে পারে৷
ব্রেক্সিটকে ঘিরে অনিশ্চয়তার মধ্যেও ব্রিটেনে বসবাসকারী ইইউ নাগরিকরা সোমবার রানির ভাষণে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন৷ ব্রিটেনে তাঁদের স্থায়ীভাবে বসবাসের ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি না করার অঙ্গীকার করেছে ব্রিটিশ সরকার৷ তবে ২০২১ সাল থেকে ইইউ নাগরিকরা আর নিজস্ব অধিকারবলে ব্রিটেনে প্রবেশ করতে পারবেন না৷ তাঁদের প্রতি বিশ্বের অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মতো আচরণ করা হবে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, ডিপিএ)