ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গত সপ্তাহে ইইউ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পরেও নতুন করে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে দরকষাকষি করতে বদ্ধপরিকর৷ এমনকি চুক্তিহীন ব্রেক্সিট হলে তিনি ইইউ-র কাছে বকেয়া অর্থ পুরোপুরি না মেটানোর হুমকি দিচ্ছেন৷ আয়ারল্যান্ড সীমান্তে ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্য কোনো বিকল্পও তিনি এখনো তুলে ধরেন নি৷ মঙ্গলবার তিনি টেলিফোনে ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লোদ ইয়ুংকারের সঙ্গে ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনা করেন এবং যথারীতি ব্যাকস্টপ ব্যবস্থা বাতিল করার দাবি জানান৷ প্রধানমন্ত্রীর ব্রেক্সিট সংক্রান্ত উপদেষ্টা ডেভিড ফ্রস্ট বুধবার ব্রাসেলসে ইইউ কমিশনের সঙ্গে ব্যাকস্টপ বিষয়ে আলোচনা করবেন৷
এমন কড়া অবস্থানের ফলে শুধু ইউরোপের নেতারাই বিরক্ত হচ্ছেন না, দেশের মধ্যেও বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে৷ মঙ্গলবার বিরোধী লেবার দলের নেতা জেরেমি কর্বিন পাঁচটি বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়ানোর বিষয়ে ঐকমত্য অর্জনের প্রচেষ্টা শুরু করেছেন৷ আগামী সপ্তাহে সংসদের অধিবেশন শুরু হবার পর তাঁরা একযোগে এমন এক আইন অনুমোদন করাতে চান, যার আওতায় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রেক্সিটের মেয়াদ বাড়াতে বাধ্য হবেন৷ সে ক্ষেত্রে ৩১শে অক্টোবরের মধ্যেই ইইউ-র সঙ্গে সমঝোতার প্রয়োজন থাকবে না৷ তার পর এক অনাস্থা ভোটে জনসনের পরাজয় ঘটলে জাতীয় ঐক্য সরকার, আগাম সাধারণ নির্বাচন, ব্রেক্সিটের প্রশ্নে দ্বিতীয় গণভোট ইত্যাদি নানা বিকল্প উঠে আসতে আসতে পারে৷ মোটকথা পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে ব্রেক্সিট নিয়ে ব্রিটেন নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার সুযোগ পাবে৷ অবশ্যই এই বিলম্বের জন্য ইইউ-র সম্মতির প্রয়োজন হবে৷
সংসদ যাতে তাঁর ব্রেক্সিট নীতির পথে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে তিনি ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত সংসদের ক্ষমতা যতটা সম্ভব সীমিত রাখতে চান৷ সেই লক্ষ্যে তিনি সংসদের অধিবেশনের দিন কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন৷ আগামী ১৪ই অক্টোবর রানির ভাষণের দিন স্থির করার উদ্যোগ নিচ্ছেন জনসন৷ রীতি অনুযায়ী এই দিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদের অধিবেশনের সূচনা হয়৷ এমনটা করলে আগামী সপ্তাহে সংসদের অধিবেশন শুরু হলেও সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় এক মাসের বিরতি অনিবার্য হয়ে পড়বে৷ ১৪ই অক্টোবরের পরেও সংসদ সদস্যদের হাতে বেশি সময় থাকবে না৷
বলা বাহুল্য, বিরোধী পক্ষ এমন ‘কৌশল’ সম্পর্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে৷ জেরেমি কর্বিন বলেন, এমন পদক্ষেপ সংবিধানের জন্য হুমকি৷
এমন প্রচেষ্টার আশঙ্কায় বিরোধী দলগুলি ইতোমধ্যেই আইন বদল করে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সংসদের বাড়তি অধিবেশনের ব্যবস্থা করেছিল৷ চলতি বছরেই সংসদ সদস্যরা টেরেসা মে-র সরকারের হাত থেকে যেভাবে ব্রেক্সিটের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, বরিস জনসনের ক্ষেত্রেও সেই উদ্যোগ নিতে চান বিরোধীরা৷ কিন্তু জনসন সংসদের অধিবেশনের সময় কমিয়ে আনতে পারলে তাঁদের প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে৷
কট্টর ব্রেক্সিটপন্থিরাও হাত গুটিয়ে বসে নেই৷ ব্রেক্সিট পার্টির প্রধান নাইজেল ফারাজ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের উদ্দেশ্যে চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছেন৷ তাঁর মতে, ব্রিটেনের স্বার্থে ইইউ-র সঙ্গে কোনো বিচ্ছেদ চুক্তিই গ্রহণযোগ্য নয়৷ সরকার তাঁর প্রস্তাব মানলে তিনি আগামী সাধারণ নির্বাচনে টোরি পার্টির সঙ্গে আসন নিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছেন৷ জনসন তাঁর ডাকে সাড়া না দিলে তিনি প্রতিটি আসনে টোরি দলের বিরুদ্ধে প্রার্থী খাড়া করার হুমকি দিয়েছেন৷ তাঁর মতে, সে ক্ষেত্রে টোরি দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, এএফপি)