ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ক্ষমতার রাশ যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে৷ তিনি যে কোনো মূল্যে ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু সংসদে ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদন করাতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁকে বাধ্য হয়ে ব্রেক্সিট মুলতুবি রাখার আবেদন করতে হয়েছে৷ সংসদে তিন তিন বার আগাম নির্বাচনের প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন জনসন৷ তিনি যাতে ব্রেক্সিটের প্রশ্নে কোনো রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে না পারেন, বিরোধীরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্রেক্সিটের মেয়াদ তিন মাস পর্যন্ত পিছিয়ে দেবার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ ‘ফ্লেক্সটেনশন' নামের সেই ব্যবস্থার আওতায় এই সময়কালে ব্রিটিশ সংসদ ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদন করলে তার ঠিক পরের মাসের প্রথম দিন ব্রেক্সিট কার্যকর করা যেতে পারে৷ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন৷ এবার ২৭টি ইইউ সদস্য দেশের সরকার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সম্মতি জানালে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে৷ মঙ্গলবারই বিষয়টি চূড়ান্ত হবার কথা৷ ইইউ সদস্যদের সরকারগুলির পরিষদের প্রধান ডোনাল্ড টুস্ক এক টুইট বার্তায় সোমবার এই ঘোষণা করেছিলেন৷
সোমবার জনসন আগাম নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়ে সেই লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের চেষ্টা চালাতে চান৷ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সেই আইন পাশ হলে ডিসেম্বর মাসে আগাম নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে৷ তবে সংসদে জনসনের সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায়ে বিরোধী পক্ষের কিছু ভোটের প্রয়োজন হবে৷ উল্লেখ্য, বিরোধী স্কটিশ জাতীয় দল ও উদারপন্থিরাও ৯ই ডিসেম্বর নির্বাচনের উদ্যোগ নিচ্ছে৷ জনসন যাতে সংসদে আবার তড়িঘড়ি করে ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদনের চেষ্টা চালাতে না পারেন, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করেই নির্বাচন চায় এই দুই বিরোধী দল৷
ব্রেক্সিটকে ঘিরে গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জটিলতার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নেও বিরক্তি বাড়ছে৷ তাই তৃতীয়বার ব্রেক্সিটের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধে সম্মতির সঙ্গে সঙ্গে ব্রাসেলস কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে৷ যেমন তিন মাসের সময়কালে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না৷ তাছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্যকলাপের ক্ষেত্রে ব্রিটেন কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না৷ ১লা ডিসেম্বরের মধ্যে ব্রেক্সিট কার্যকর না হলে নিয়ম অনুযায়ী ব্রিটেনকে ইইউ কমিশনে একজন কমিশনর নিয়োগ করতে হবে৷
তিন মাস পর্যন্ত বাড়তি সময় পেয়ে ব্রিটেনের সরকার ও বিরোধী দলগুলি আগামী নির্বাচনে জনসমর্থন আদায় করতে যে যার পছন্দমতো পদক্ষেপ নিতে চাইছে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার কোনো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হলে ব্রেক্সিট নিয়ে অচলাবস্থা থেকে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, ডিপিএ)