বাংলাদেশ একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে, অন্যদিকে ব্লগার, বিদেশি, পুলিশ, সংখ্যালঘু, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উপর হামলা দিচ্ছে অশনি সংকেত৷
বিজ্ঞাপন
২০১৫ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক নতুন পরিচয় পেয়েছে৷ নিয়মিত জবাই করে মানুষ হত্যার বর্বরতম ঘটনা বিশ্বের অল্প যে কয়টি দেশে এখনো ঘটছে, তার মধ্যে ভালোভাবে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ৷ এমন নয় যে, এর আগে মুসলিমপ্রধান দেশটিতে জবাই করে কাউকে খুন করা হয়নি৷ সেটা হয়েছে নিশ্চয়ই৷ তবে ২০১৫ সালে তার পরিধি অনেক বেড়ে গেছে৷ জবাই হয়েছেন চার ব্লগার, এক প্রকাশকসহ বেশ কয়েকজন পীরের মুরিদ৷ ব্লগার হত্যার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম' এবং ‘আনসার আল-ইসলাম৷'
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
আরেকটি উদ্বেগজনক ব্যাপার হচ্ছে, দু'জন বিদেশি হত্যাকাণ্ড৷ দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে বিদেশিদের উপর সচরাচর হামলা হয় না৷ বড়জোড় ছিনতাই কিংবা চুরির ঘটনা তাদের সঙ্গে ঘটেছে বহুবার৷ কিন্তু এবারই এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুন হয়েছেন দুই বিদেশি৷ তাঁদের একইরকমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে৷ পাশাপাশি শিয়াদের উপর দু'টি হামলার ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে দুই ব্যক্তি৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার অনেক ঘটনা ঘটলেও শিয়াদেরে হত্যা এবারই প্রথম, স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সেটাই বলছে৷ বড়দিনে আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হয়েছে হামলাকারী নিজে, আহত অনেক৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট'৷
এছাড়া আক্রান্ত হয়েছেন পুলিশ৷ ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে চট্টগ্রামে নৌ-বাহিনীর সুরক্ষিত ঘাঁটির মধ্যে অবস্থিত মসজিদে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ এক বছরের মধ্যে এত হামলায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন মহলে৷
বিভিন্ন গোষ্ঠীর উপর এ সব হামলা নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের পুনরুত্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে৷ ‘ইসলামিক স্টেট' সাফ জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে ‘খেলাফত' প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে তারা৷ যদিও বাংলাদেশ সরকার এখন তাদের কোনো অস্তিত্ব দেশটিতে স্বীকার করছে না৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী অনেককে গ্রেপ্তার করেছে যাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷
২০১৫ সালে সংগঠিত ধারাবাহিক এসব হামলা বিবেচনায় আনলে নতুন বছরটি কেমন হবে তা নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করা কঠিন৷ বরং এভাবে হামলা বাড়তে থাকলে বাংলাদেশ আরো অনিরাপদ একটি রাষ্ট্রে পরিনত হবে, যদিও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নতুন বছরকে ‘পর্যটনের' বছর ঘোষণা দিয়েছেন৷
২০১৬ সাল নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী? লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷