ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা জড়িত বলে প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা বিভাগ৷
বিজ্ঞাপন
টিমের প্রধান মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ৷ তাদের মধ্যে ৬ জন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷
গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্লবীর পলাশনগরের নিজ বাড়ির সামনে ব্লগার রাজীব হায়দারকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ রাজীব ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের একজন সক্রিয় কর্মী৷ তাঁকে হত্যার পর পুলিশ তদন্তে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ৫ ছাত্রকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে চিহ্নিত করে৷ তাদের গ্রেফতারের পর দেয়া জবানবন্দি অনুযায়ী আটক করা হয় আরো একজন শিক্ষার্থীকে৷ তাদের কাছ থেকে তদন্ত দলের সদস্যরা জানতে পারেন, তারা সবাই আল-কায়েদা ভাবধারার জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য৷ তাদের সংগঠনের প্রধান মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানী৷
‘নাস্তিক ব্লগার’ ইস্যুতে ইসলামি দলের তাণ্ডব
কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে কথিত ‘ধর্মনিন্দার’ অভিযোগে তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ বাংলাদেশের কয়েক এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে বিভিন্ন ইসলামি দল৷ এতে প্রাণহানিসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: Reuters
বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্র
শুক্রবার (২২.০২.১৩) দুপুর বারোটার দিকে বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ ১২টি ইসলামি ও সমমনা দল আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের ভাষায় যেসব ব্লগার ইন্টারনেটে ‘ধর্মনিন্দা’ করে বিভিন্ন নিবন্ধ লিখছে, তাদের ফাঁসির দাবিতে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর আন্দোলন করা হবে৷ কিন্তু সেই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই তাণ্ডবে রূপ নেয়৷ এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘পরিকল্পিত অ্যাকশন’
ঢাকা থেকে আমাদের প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন জানিয়েছেন, ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবেই সহিংস অ্যাকশনে গেল জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগীরা৷ ব্লগে ইসলামের বিরুদ্ধে কথিত কটূক্তির কথা বলে তাদের ভাষায় ‘মুরতাদ-নাস্তিকদের’ ফাঁসির দাবিতে আগেই শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর কর্মসূচি দেয়৷ আর আজ (২২.০২.১৩) জুম্মার নামাজের আগেই তারা তাণ্ডব শুরু করে৷’
ছবি: Reuters
শাহবাগে হামলার চেষ্টা
শুক্রবার (২২.০২.১৩) পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ইসলামি দলের সদস্যরা শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোতে চাইলে সংঘর্ষ পল্টন হয়ে প্রেসক্লাব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ ককটেল, গুলি আর টিয়ার গ্যাসের সেলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ প্রায় একই সময়ে ঢাকার কাঁটাবনে শাহবাগ বিরোধীরা রাস্তায় নামে৷ তারাও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে৷ সেখানেও পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
ঢাকার বাইরে তাণ্ডব, প্রাণহানি
ঢাকার বাইরে চট্টগামের প্রেসক্লাবে হামলা হয়েছে৷ তাদের হামলায় পুলিশ এবং সাংবদিকসহ ২০ জন আহত হয়েছেন৷ বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, চাঁদপুরে গণজাগরণ মঞ্চে হামলা চালায় তারা৷ হামলা চালায় সিলেট শহীদ মিনারে৷ সেখানে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ শুক্রবার বিকেল অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী, গাইবন্ধায় ২ জন এবং ঝিনাইদহে জাগরণ মঞ্চ বিরোধীদের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন৷
ছবি: Reuters
শাহবাগে জনতা
দেশব্যাপী ইসলামি দলগুলোর এই তাণ্ডবের পর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আবারো ভিড় বাড়তে শুরু করেছে৷ ব্লগারদের ডাকে গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি থেকে এই চত্বরে অবস্থান করছেন অগুনতি মানুষ৷ তাদের মূল দাবি হচ্ছে, ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ, তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বয়কট৷’’
ছবি: Reuters
তাণ্ডবের পর নতুন কর্মসূচি
শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ইমরান এইচ সরকার শুক্রবার সন্ধ্যায় জাগরণ মঞ্চ থেকে দাবি করেন, ‘‘আজকের (২২.০২.১৩) হামলায় উস্কানি দিয়েছে জামায়াত শিবিরের পত্রিকা আমার দেশ৷ আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর সম্পাদক মাহামুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে৷ তা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়া হবে৷’’ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: Reuters
ইন্টারনেটে সতর্ক দৃষ্টি
‘ধর্মীয় ভাবমূর্তিতে আঘাত হানছে’ এরকম ইন্টারনেট ওয়েবসাইট খুঁজে খুঁজে বন্ধ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ৷ ইতোমধ্যে কমপক্ষে দুটি ওয়েবসাইট বন্ধ এবং দশটি ব্লগ পোস্ট মুছে দেওয়া হয়েছে৷ বার্তাসংস্থা এএফপিকে এই তথ্য জানিয়েছেন টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি'র ভাইস-চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
রোববার হরতাল
শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালানোর পর রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ‘জামায়াত নিয়ন্ত্রিত’ ১২টি ইসলামি দল৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম জানান, ‘‘তারা (অভিযুক্তরা) জানায় রাজীব হায়দার ‘থাবা বাবা' নামে ব্লগ লিখতেন৷ তাদের বড়ভাই রেদোয়ানুল আজাদ এব্যাপারে তাদের জানায় এবং তারা ব্লগ পড়ে রাজীবকে হত্যা করা ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করে৷ তারা তাদের নেতা মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীর বই পড়ে এবং তার বয়ান এবং খুতবায় অংশ নিয়ে ‘নাস্তিক ব্লগারদের' হত্যা করতে উৎসাহিত হয়৷''
তারা ফেসবুক এবং সরাসরি শাহবাগে গিয়ে রাজীবের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে৷ আর এজন্য তাদের সবধরণের সহায়তা করে রেদোয়ানুল ইসলাম৷ রেদোয়ানুল সরাসরি মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন৷
হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ পর্যায়ক্রমে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকেই গ্রেফতার করে৷ গ্রেফতারের সময় তাদের কাছে তাদের সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কাগজপত্র, হিটলিষ্ট এবং আল-কায়েদার ভিডিও সিডি উদ্ধার করা হয়৷ তারা আরো কয়েকজনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল৷
তদন্ত শেষে গোয়েন্দা বিভাগ যাদের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে, তারা হলেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিাটর ছাত্র মো. ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ, মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক, মো. এহসান রেজা ওরফে রুম্মান, নাঈম সিকদার ওরফে ইরাদ, নাসিফ ইমতিয়াজ, সাদমান ইয়াসির মাহমুদ, রেদোয়ানুল আজাদ রানা এবং তাদের নেতা মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানী৷
তদন্ত কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম জানান এই মামলায় মোট ৫৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে৷ আর হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতি ও সাইকেলসহ আরো অনেক আলামত আদালতে জমা দেয়া হয়েছে৷ তিনি জানান হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা ধর্মীয় উগ্রবাদী৷