পাকিস্তানের আইন মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে গত সপ্তাহ থেকে ইসলামাবাদ প্রবেশের মূল সড়ক অবরোধ করে রাখা হয়েছে৷ ব্লাসফেমির জের ধরে এক ধর্মীয় নেতার সমর্থকরা এ অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
পাকিস্তানের কট্টরপন্থি দল তাহরিক-ই-লাবাইকের নেতা হাফিজ উল্লাহ আলভি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের একমাত্র দাবি, সংসদের সেইসব সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, যারা সংবিধান সংশোধন করে নবি মোহাম্মদ (সা.)-এর চূড়ান্ত অবস্থানকে বিতর্কিত করেছেন৷'' গত অক্টোবরে নির্বাচনি আইনে কিছু সংশোধন আনা হয়, যার মধ্যে সংসদ সদস্যদের শপথবাক্যে মহানবিকে নিয়ে উল্লেখিত বাক্যাংশে পরিবর্তন আসে৷ অবশ্য প্রতিবাদের মুখে সেই পরিবর্তন প্রত্যাহার করা হয়৷
হাফিজ উল্লাহ আলভি বলেন, ‘‘সরকার বলছে, ওটা ভুলবশত হয়েছিল৷ আমরা তা মনে করি না৷ পশ্চিমের দালালরা ইচ্ছা করে এটা করেছে, তাদের অনেকে এমনকি সংসদেও আছে৷'' আইনমন্ত্রী এ বিকৃতির শামিল হয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন– এমন অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেন প্রতিবাদকারীরা৷ আলভি বলেন, ‘‘ দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাস্তা ছাড়বো না৷''
এদিকে প্রতিবাদকারীরা দ্রুত তাদের অবরোধ উঠিয়ে নেবেন, এমন আশা প্রকাশ করে সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য রাজা মোহাম্মদ জাফর উল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা পুরো সংসদকে এর জন্য শাস্তি দিতে পারি না৷ প্রতিবাদকারীরা যে সংশোধনের কথা বলছেন, তা মেনে নেয়া হয়েছে৷ বিলটি এখন সচিবালয়ে রয়েছে, খুব শিগগিরই ওটা পাশ হবে৷'
জঙ্গি সংগঠন হাক্কানি নেটওয়ার্কের ইতিহাস
সম্প্রতি আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে মার্কিন ড্রোন হামলায় অন্তত ২৬ জন মারা গেছে, যাদের মধ্যে জঙ্গি সংগঠন হাক্কানি নেটওয়ার্কের সদস্যও রয়েছে৷ কেন এ সংগঠনকে এ অঞ্চলের অন্যতম ভীতিকর জঙ্গি সংগঠন মনে করা হয়?
ছবি: picture-alliance/dpa
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা যোদ্ধাদের সংগঠন
হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা জালালউদ্দিন হাক্কানি ১৯৮০-র দশকে মুজাহিদিনের হয়ে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন৷ সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ আনুকুল্য পেয়েছিলেন মুজাহিদিন৷ সেই যোদ্ধাদের নিয়েই গড়ে তোলা হয় হাক্কানি নেটওয়ার্ক৷ ১৯৯৫ সালে হাক্কানি জোট বাঁধে তালিবানের সঙ্গে৷ ১৯৯৬ সালে দখল করে নেয় আফগান রাজধানী কাবুল৷ ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র হাক্কানি নেটওয়ার্ককে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষনা দেয়৷
ছবি: AP
কে এই জালালউদ্দিন হাক্কানি?
জালালউদ্দিন হাক্কানি ১৯৩৯ সালে আফগানিস্তানের পাকতিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন৷ পাকিস্তানের প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতা মওলানা সামি উল হকের বাবার প্রতিষ্ঠা করা দারুল উলুম হাক্কানি নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন তিনি৷ দারুল উলুম হাক্কানির বিরুদ্ধেও তালেবানসহ অন্যান্য উগ্রপন্থি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: AP
তালেবান মন্ত্রী জালাল উদ্দিন হাক্কানি
তালেবানের শাসনামলে আফগানিস্তানের আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন জালালউদ্দিন হাক্কানি৷ ২০১১ সালে মার্কিন বাহিনীর হাতে তালেবানদের পতনের আগ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে বহাল ছিলেন৷ তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের পর তাঁকেই আফগানিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী জঙ্গি নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়৷ আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনের সাথেও তাঁর ছিল ঘনিষ্ট যোগাযোগ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হাক্কানি নেটওয়ার্ক কোথায়?
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগান সীমান্ত সংলগ্ন পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানের মিরানশাহ শহরে এর কমান্ড সেন্টার৷ যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তান মনে করে, হাক্কানি নেটওয়ার্ক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মদদপু্ষ্ট, যদিও পাকিস্তান তা অস্বীকার করে৷ আফগানিস্তানের ভেতরে সাধারণ মানুষ ও আন্তর্জাতিক বাহিনীর উপর হামলার জন্য হাক্কানি নেটওয়ার্ককে দায়ী করে আসছে ওয়াশিংটন৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Tanveer
হাক্কানির উত্তরসুরি
২০১৫ সালে জালালউদ্দিন হাক্কানির মৃত্যু হয়েছে বলে ধারনা করা হয়৷ কিন্তু তার সংগঠন সেসময় খবরটি অস্বীকার করে৷ বর্তমানে জালালউদ্দিন হাক্কানির ছেলে সিরাজউদ্দিন হাক্কানি এ নেটওয়ার্কের প্রধান৷ সিরাজউদ্দিন হাক্কানি তালেবানেরও উপ প্রধান৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সিরাজউদ্দিন হাক্কানি কে ?
সিরাজউদ্দিন হাক্কানি সম্পর্কে সুনিশ্চিত কোনো তথ্য না থাকলেও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁর ছোটবেলা কেটেছে পাকিস্তানের মিরানশাহ শহরে৷ লেখাপড়া পেশোয়ারের দরুল উলুম হাক্কানিতে৷ সিরাজউদ্দিনকে একজন সামরিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ অনেকে মনে করেন, তিনি তাঁর বাবার চেয়েও কট্টরপন্থি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আনাস হাক্কানি
সিরাজউদ্দিন হাক্কানির ছেলে আনাস হাক্কানি বর্তমানে আফগানিস্তানের কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে বন্দি আছেন৷ আনাসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে কাবুলের পরিণতি ভয়ংকব হবে বলে হুশিঁয়ারি উচ্চারণ করেছে হাক্কানি নেটওয়ার্ক৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/National Directorate of Security
হাক্কানি নেটওয়ার্ক কত বড়?
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আফগান বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংগঠনে তিন থেকে দশ হাজার যোদ্ধা রয়েছে৷ এর মূল তহবিল আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে৷ তহবিল সংগ্রহ করতে হাক্কানি নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে অপহরণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Tanveer
অন্য জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা
আল কায়েদা, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান, লস্কর-ই-তৈয়বাসহ এশিয়ার জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে হাক্কানি গ্রুপের রয়েছে ঘনিষ্ট যোগাযোগ৷ ওসামা বিন লাদেনের মতো আল কায়েদার বর্তমান নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির সাথেও এ সংগঠনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Ausaf Newspaper
9 ছবি1 | 9
ওদিকে প্রতিবাদকারীরা ইসলামাবাদের সরকারি অফিসগুলোতে হামলা চালাতে পারে, এমন আশংকায় কর্তৃ্পক্ষ অনেক রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে৷ গত সপ্তাহ থেকে চলমান এ অবরোধে রাওয়ালাপিন্ডির সাথে ইসলামাবাদের যোগাযোগ বন্ধ থাকায় ভোগান্তির মুখে পড়েছে সাধারণ মানুষ৷ ইসলামাবাদের বাসিন্দা উসমান আজিজ বলেন, ‘‘প্রতিবাদ করা সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার৷ তবে তা করতে গিয়ে কোনো শহরকে অবরুদ্ধ করে ফেলা উচিত নয়৷''
মানবাধিকার কর্মী ফাতেমা আতিফ বলেন, ইসলামি দলগুলোর দাবির কাছে সরকার সবসময় মাথা নত করে৷তাঁর মতে, ‘‘সামরিক বাহিনীর সাথে দ্বন্দ্বে ক্ষমতাসীন দল এমনিতেই ফুটন্ত জলের উপর আছে৷ এখন প্রতিবাদকারীদের মোকাবেলা করার মতো রাজনৈতিক অবস্থান তাদের নেই৷'' অধ্যাপক তাওসিফ আহমেদের মতে, জিহাদি সংগঠনগুলোকে মূল ধারায় এভাবে পুনর্বাসিত করলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তানের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে৷ ‘‘এ ধরনের দলগুলোকে মূল ধারায় এভাবে এনে পাকিস্তান নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেন বিশ্বাস করবে যে, আমরা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়ছি?''
তবে ইসলামি দলগুলো বলছে, সংবিধান তাদের রাজনীতিতে অংশ নেয়া, নির্বাচন করা এবং ইসলামবিরোধী যে কোনো আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার দিয়েছে৷
১৯৮০ সালে কার্যকর হওয়া‘ব্লাসফেমি' আইন পাকিস্তানের অন্যতম স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ৷পাকিস্তানের অনেক ইসলামপন্থি দল গণতান্ত্রিক সংসদের বদলে দেশে শরিয়া আইনের শাসন চায়৷ অন্যদিকে, অনেক মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠন ব্লাসফেমি আইনের সংশোধন চায়৷ তবে ইসলামপন্থি দলগুলো মনে করে, এ আইনের কোনো ধরনের সংশোধন দেশে ইসলামের অস্তিত্বের জন্য হুমকি৷