প্রশাসন, পুলিশ বা সরকারি চাকুরে কোনো বড় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা বা অভিযোগ হলেই তদন্তে ধীর গতি দেখা যায়৷ এমনকি তদন্তের নামে বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়৷
বিজ্ঞাপন
একটার পর একটা তদন্ত কমিটি হয় কিন্তু তারপরও প্রকৃত ঘটনা জানা যায় না৷ আর প্রতিকার পাওয়া গেলেও তাতে বছরের পর বছর লেগে যায়৷
গত ১৪ মার্চ মধ্যরাতে কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে তার বাড়ি থেকে ‘কথিত’ মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়৷ এরপর জেলা প্রশাসকের অফিসেই তাকে নির্যাতন করা হয়৷ নির্যাতনের পর আধা বোতল মদ ও কয়েক গ্রাম গাঁজা দিয়ে মামলা ও কারাগারে পাঠানো হয় আরিফুলকে৷ এই ঘটনায় মোট তিনটি প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি হয়ছে৷ কিন্তু এখনো কোনো চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷
শুধুমাত্র তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দিনকে তার অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷ জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন এবং দুই সহকারি কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এস এম রাহাতুল ইসলামকে কুড়িগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়৷ ওই ঘটনায় কুড়িগ্রামে একটি মামলাও করেছেন সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম৷ কিন্তু সেই মামলায় এখনো চার্জশিট দেয়া হয়নি৷ জেলা প্রশাসকসহ অন্য আসামিরা জামিনও নেননি৷ আরিফুল জানান, ‘‘মামলার তদন্তে আমি তেমন কোনো অগ্রগতি দেখছিনা৷ আমাকে এখন নানা ভাবে চাপ ও প্রলোভন দেয়া হচ্ছে মামলা প্রত্যাহারের জন্য৷’’
জামালপুরের সেই জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন৷ কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তদন্ত এখনো চলছে৷ গত বছরের আগস্টে তার অফিসের এক নারী কর্মচারীর সঙ্গে তার অনৈতিক কাজের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তাকে প্রত্যাহার ও পরে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়৷ সেই নারী কর্মচারীকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷
মামলা প্রত্যাহারের জন্য আমাকে চাপ ও প্রলোভন দেয়া হচ্ছে: আরিফুল ইসলাম
চট্টগ্রামে পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু আক্তারকে ২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড় এলাকায় ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা৷ ঘটনার পর সারাদেশে এনিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়৷ পুলিশও তদন্ত শুরু করে জোরেশোরে৷ কিন্তু সেই তদন্তে এখন ভাটার টান৷ কারণ তদন্তের এক পর্যায়ে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে৷ তিনিই আবার এই হত্যা মামলার বাদী৷ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এসপি বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়৷ কিন্তু মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি৷ মামলার এখনকার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এডিশনাল এসপি মো. মঈন উদ্দিন জানান, ‘‘এই মামলার তদন্ত শেষ হতে আরো সময় লাগবে৷ আমি তদন্তের নতুন দায়িত্ব পেয়েছি৷ সব কিছু দেখতে হবে৷’ এই মামলায় এপর্যন্ত নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও চারজন এরইমধ্যে জামিন পেয়েছেন৷ বাবুল আক্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘শুরুতে মিতুর বাবা বাবুল আক্তারের পক্ষে অবস্থান নেন৷ এখন আবার গ্রেপ্তার করতে বলছেন৷ তার উচিত তদন্তকারীদের ওপর আস্থা রাখা৷ বাবুল আক্তারতো এই মামলার বাদী৷ আমরা তো তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবই৷’’
পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান মিজান ও দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের বহুল আলোচিত ঘুস কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের মামলার বিচার শুরু হয়েছে গত ১৯ আগস্ট৷ গত বছরের ১৬ জুলাই ৪০ লাখ টাকা ঘুস লেনদেনের অভিযোগে মিজান ও বাছিরের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের পরিচালক শেখ ফানাফিল্যা৷ ঘুস কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠার পর খন্দকার এনামুল বাছির ও ডিআইজি মিজানুর রহমান ওরফে মিজান সাময়িক বরখাস্ত হন৷ ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে আরো একটি দুর্নীতির মামলার তদন্ত চলছে৷ তিনি এখন কারাগারে আছেন৷ দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরও কারাগারে আছেন৷
এদিকে কক্সবাজারের টেকনাফে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় ওসি প্রদীপ কুমার দাস ও এসআই লিয়াকতকে আইনের আওতায় ও রিমান্ডে নিতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে৷ আর ওই ঘটনায় কক্সবাজারের এসপি মাসুদ হোসেনকে দায়ী করা হলেও তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ তিনি বহাল তবিয়তে আছেন৷ তিনি অবশ্য বলেছেন, ‘‘আমার যা বলার তদন্ত কমিটির কাছেই বলব৷’’ জানা গেছে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেয়ার আগে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না৷
এসব বিষয় নিয়ে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানা যায়নি৷ তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘যার দায় তাকে নিতে হবে৷ কাউকে রক্ষায় কোনো ধরনের পেশাগত চাপ সৃষ্টি করা হয় না৷ ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা অন্য কেনো ধরনের সম্পর্কের কারণে কারুর প্রতি কারুর সহানুভূতি থাকতে পারে৷’’
২৭ জুনের ছবিঘরটি দেখুন...
রাষ্ট্রের দমন কৌশল
বাংলাদেশে যখন যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল কিংবা বিরুদ্ধমত দমন করেছে৷ কখনও আইন, কখনও প্রশাসন, কখনও সহযোগী সংগঠনের পেশি শক্তি ব্যবহার করে ভিন্ন মতের মানুষের উপর চালানো হয়েছে নির্যাতন৷
ছবি: Sony Ramany/AFP
জনতার মিছিলে পুলিশের গুলি
সরকার বিরোধী প্রতিবাদ কিংবা মিছিলে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনা বারবার ঘটেছে বাংলাদেশে৷ এরশাদের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করে৷ এমন ঘটনা অব্যাহত ছিল গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও৷ ২০০৬ সালে কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে গণবিক্ষোভে ২০ জন নিহত হয়েছে৷
ছবি: DW/H. U. Rashid Swapan
মিছিল-সমাবেশে বাধা
নব্বইয়ের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো প্রতিপক্ষকে রাস্তায় প্রতিবাদে বাধা দেয়৷ চলে পুলিশি হামলা, নির্যাতনের ঘটনা৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পরিস্থিতি আরো প্রকট হয়েছে৷ শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয় নাগরিক সমাজের প্রতিবাদেও বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটছে৷
ছবি: bdnews24.com
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন ৩৬১ জন৷ গত বছর নিহত হয়েছেন ৪২১ জন, যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি৷ এসব ক্রসফায়ারের ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাসানোর অভিযোগ আছে৷
ছবি: bdnews24.com
গুম কিংবা নিখোঁজ
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইএইচআর) হিসাবে ২০০৯-১৮ পর্যন্ত গুম হয়েছেন ৫০৭ জন৷ এর মধ্যে ৬২ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ১৫৯ জনের হদিস মেলেনি৷ গত ১০ বছরে নিজেদের ৩০০ এর বেশি নেতাকর্মী গুম হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Getty Images/AFP/O. Kose
মামলার হয়রানি
সবশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ৪,৪২৯টি মামলা করা হয়েছে৷ যাতে চার লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৫ জনকে আসামি করা হয় বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি৷ সেখানে এমনকি মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের উপর ককটেল ছুড়ে মারার মামলা হয়েছে৷ ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে আশি বছরের প্রৌঢ়ের বিরুদ্ধেও৷
ছবি: bdnews24.com
পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকে বরাবরই ব্যবহার করে আসছে বিপক্ষ বা ভিন্নমত দমনে৷ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে এমন পেশিশক্তির ব্যবহার আরও প্রকট হয়েছে৷ ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নির্যাতনে বুয়েটে আবরারের মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে৷ ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ও কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর বারবার হামলার ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: bdnews24.com
নিষ্পেষণমূলক আইন
ভিন্নমত দমনে আশ্রয় নেয়া হয় আইনেরও৷ ২০১৫ সালে করা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, ব্লগার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়েছে৷ সেটি বাতিল করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হলে সেখানেও একই ধরনের বিভিন্ন ধারা রাখা হয়৷ এই আইনে আটক হয়ে জেলখানায় বিনা বিচারে মারা যান লেখক মুশতাক আহমেদ৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
গণমাধ্যমের উপর চাপ
বাংলাদেশে এখন বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যম থাকলেও তাদের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ বিভিন্ন সময়ে টিভি চ্যানেল, নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে দেয় সরকার৷ মালিকানা, বিজ্ঞাপন বন্ধে চাপ দেয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে গণমাধ্যমগুলো নিজেরাই এখন সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ
২০১৯ সালের ২৯ জুন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, ঐ বছরের শেষ দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে বাংলাদেশ৷ তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের এখন সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হচ্ছে রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে যে কোনো ওয়েবসাইটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এটি বড় অর্জন৷’’
ছবি: picture-alliance/chromorange/C. Ohde
ফোনে আড়িপাতা
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিভিন্ন মানুষের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটছে৷ ইউটিউব বা গণমাধ্যমে সেগুলো ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, লঙ্ঘন করা হচ্ছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা৷
ছবি: imago/avanti
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যা বলছে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৯ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷ সভা-সমাবেশ ও বাকস্বাধীতার ওপর নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বিরোধী দলসহ নাগরিকদের প্রতিবাদ ও সংবাদ মাধ্যমের ওপর হামলা, মামলা এবং বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়েছে৷