এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজনের দিক থেকে সবচেয়ে বড়৷ আর মেলায় নতুন বইও আসছে প্রত্যাশামতো৷ বইপ্রেমীদের সমাগমও ভালো৷ পরিবেশ নিয়েও নেই তেমন সমালোচনা৷ তবে প্রশ্ন উঠেছে মেলার ‘কর্পোরোটপ্রীতি’ নিয়ে৷
বিজ্ঞাপন
বইমেলায় এ পর্যন্ত নতুন বই এসেছে প্রায় দুই হাজার৷ আর আশা করা হচ্ছে, এবার বইমেলায় অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে পাঁচ হাজার নুতন বই আসবে৷ কারণ, মেলার শেষদিকেই বেশি বই প্রকাশ হয়৷ আর সেই হিসেবে প্রথম ১৪ দিনে এক হাজার ৯শ' ৩২টি নতুন বই প্রকাশ ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়৷
এবারের বই মেলার আয়তন সাড়ে পাঁচ লাখ বর্গফুট৷ আর সাড়ে চারশ' প্রকাশককে দেয়া হয়েছে সাড়ে ৭শ' স্টল৷ মেলার মূল আয়োজন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে৷ ২০১৪ সাল থেকে মেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয়৷ শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন আহসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার মেলার পরিবেশ ভালোই৷ নতুন বই আসছে৷ আশা করা যাচ্ছে এবার বইমেলায় পাঁচ হাজারেরও বেশি নতুন বই আসবে৷ তবে এত বই, কিন্তু পড়ার মতো বই কোথায়!’’
এবার বই মেলায় কর্পোরেট কালচারের দাপট: রবিন আহসান
রবিন আহসান বলেন, ‘‘প্রকাশের দিক দিয়ে কবিতার বই বেশি৷ আর বিক্রির দিক থেকে উপন্যাস বেশি এগিয়ে৷ এখানো হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসই জনপ্রিয়তার শীর্ষে৷ তাঁর উপন্যাসই বেশি বিক্রি হয়৷’’
এবারের মেলার বিস্তৃত পরিসর এবং নিরাপত্তা নিয়ে সন্তুষ্ট পাঠক ফাতেমা আবেদীন নজলা৷ তিনি প্রায় প্রতিদিনই বইমেলায় যান৷ তিনি বলেন, ‘‘মেলার বিস্তৃত পরিসরে ঘুরতে বেশ ভালো লাগে৷ ধুলোবালি আছে, তবে সহনীয় মাত্রায়৷ আর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভালো৷ কেউ কেউ এটাকে নিরাপত্তার কিছুটা বাড়াবাড়ি বললেও আমি মনে করি নিরাপত্তা চাইলে আমাদের লাইন দিতে হবে৷’’
ধুলোবালি আছে, তবে সহনীয় মাত্রায়: ফাতেমা আবেদীন নজলা
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মেলার তথ্যকেন্দ্র নিয়ে তেমন প্রচার নাই৷ তাই সবাই জানেন না৷ কিন্তু তথ্যকেন্দ্রে গেলে কোন প্রকাশনী নতুন কী বই এনেছে তা জানা যায়৷ কোন স্টল কোন জায়গায় তা-ও জানা যায়৷’’
লেখক সাদিয়া মাহজাবিন ইমাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বইমেলায় প্রচুর বই আসছে এবং বিক্রিও হচ্ছে ভালো৷ এটা প্রমাণ করে যে, পাঠকরা বইয়ের প্রতি আগ্রহ হারাননি৷ বরং বাড়ছে৷ বই যদি বিক্রি না হয়, প্রকাশকরা যদি ব্যবসা না করেন, তাহলে এত বই ছাপা হবে কেন?'' তবে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ চাইলে বই চেক করবে, বইয়ে নরদারি করবে, এই বিষয়টি আমার কাছে অরুচিকর ঠেকেছে৷’’
পুলিশ চাইলে বই চেক করবে, এই বিষয়টি অরুচিকর ঠেকেছে: সাদিয়া মাহজাবিন ইমাম
আর রবিন আহসান বলেন, ‘‘এবার বই মেলায় কর্পোরেট কালচারের দাপট৷ বিকাশ ছাড়া আর কোনো কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা যাবে না এই সিদ্ধান্ত বাংলা একাডেমি নিতে পারে না৷ পাঠক বই কিনে বইয়ের দাম কিভাবে পরিশোধ করবেন তা তাঁর বিষয়৷ হাইকোর্ট এই সিদ্ধান্তে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘বইমেলা নানা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেছে৷’’
বাংলা একাডেমির পরিচালক (জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগ) অপরেশ কুমার ব্যানার্জী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার বইমেলার সার্বিক আয়োজন আমরা সুন্দর করার চেষ্টা করেছি৷ মেলায় বইপ্রেমীদের উপস্থিতি ভালো৷ নতুন বই প্রকাশের পরিমাণও আশাব্যঞ্জক৷ তবে মেলায় নতুন ইট বিছিয়ে পথ তৈরি করতে হয়েছে বলে ধূলো কিছুটা আছে৷ আমরা পানি ছিটিয়ে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি৷’’
এবার বিকাশ স্পন্সর হলেও আগে অন্যরা ছিল: অপরেশ কুমার ব্যানার্জী
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বিকাশ পেমেন্ট নিয়ে হাইকোর্ট যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সে ব্যাপারের আমার কোনো মন্তব্য নাই৷ তবে এর সঙ্গে বাংলা একাডেমি জড়িত নয়৷ মেলার স্পন্সরদের বিষয়৷ এবার বিকাশ স্পন্সর হলেও আগে অন্যরা ছিল৷ তখন তাদের বিজ্ঞাপন গেছে৷’’
প্রসঙ্গত গত বছর (২০১৭) বইমেলায় মোট বই বিক্রি হয় ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার৷ মেলায় মোট নতুন বই এসেছিল ৩ হাজার ৬৪৬টি৷
২০১৬ সালে বই মেলায় নতুন বই এসেছিল ৩ হাজার ৪৪৪টি৷ আর সেবার মোট বিক্রি হয়েছিল ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই৷ ২০১৫ ও ২০১৪ সালের বই মেলায় মোট বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ২১ কোটি ৯৫ লাখ ও ১৬ কোটি টাকার বই৷
প্রতিবছরই বই মেলার পরিসর বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও বাড়ছে৷ একই সঙ্গে বাড়ছে বই বিক্রি৷
মেলার বাইরে বইয়ের মেলা
রাজধানী ঢাকার কয়েকটি জায়গায় গড়ে উঠেছে বইয়ের আধুনিক কিছু দোকান৷ শুধু বই কেনাই নয়, লেখক-পাঠকদের জন্য নানান আয়োজনও আছে নতুন এ সব বইঘরে৷ ঢাকার এ রকম কয়েকটি বইয়ের জগত দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: Abdullah Al Momin
পাঠক সমাবেশ সেন্টার
ঢাকার শাহবাগে আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের বিপরীতে অগ্রণী ব্যাংকের দ্বিতীয় তলায় বৃহৎ বইয়ের দোকান ‘পাঠক সমাবেশ সেন্টার’৷
ছবি: Abdullah Al Momin
বই প্রেমীদের নতুন ঠিকানা
পাঠক সমাবেশ সেন্টার কেবল বইয়ের বিক্রয় কেন্দ্রই নয়, এখানকার বইয়ের জগতে অন্তত একবেলা সময় সাচ্ছন্দে সময় কাটাতে পারেন বইপ্রেমীরা৷
ছবি: Abdullah Al Momin
নানা আয়োজন
শুধু বই কেনা-বেচাই নয়, বইকেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠান, প্রকাশনা উৎসব, পাঠচক্র, সাহিত্য আড্ডা দেয়ারও চমৎকার জায়গা শাহবাগের এই পাঠক সমাবেশ সেন্টার৷
ছবি: Abdullah Al Momin
দীপনপুর
রাজধানীর কাটাবন মোড়ে আরেক বইয়ের জগত ‘দীপনপুর’৷ ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছিলেন প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন৷ গত বছর তাঁর ৪৫তম জন্মদিনে যাত্রা শুরু হয় এই বইঘরটির৷
ছবি: Abdullah Al Momin
দীপনের স্মৃতি
দীপনের মৃত্যুর পর তাঁর সহধর্মিনী ডা. রাজিয়া রহমান জলি স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে চালু করেন এই বইয়ের দোকান৷ জাগৃতির হাল ধরার পাশাপাশি দীপনের স্মৃতি ও চেতনাকে ধরে রাখতেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ভিন্নধর্মী এই বুকশপ ক্যাফে৷
ছবি: Abdullah Al Momin
শিশুদের জন্য ‘দীপান্তর’
দীপনপুরে শিশু-কিশোরদের জন্য রয়েছে ‘দীপান্তর’৷ শিশুরা এখানে পড়তে পারবে বই, আঁকতে পারবে ছবিও৷ পাশাপাশি আছে খেলাধুলা করার ব্যবস্থা৷
ছবি: Abdullah Al Momin
দীপনপুরের যত আয়োজন
দীপনপুরে বই পড়তে পড়তে চুমুক দেয়া যাবে চা কিংবা কফির পেয়ালায়৷ প্রয়োজনীয় বইটি না থাকলে অর্ডার সাপেক্ষে যথাসময়ে বাড়িতে পৌঁছে যাবে৷ এছাড়া ক্রেতারা অনলাইনেও বই কিনতে পারেন দীপনপুর থেকে৷
ছবি: Abdullah Al Momin
বাতিঘর
ঢাকার বাংলা মোটর এলাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অষ্টম তলায় চালু হয়েছে বইঘর ‘বাতিঘর’৷ ৫০০০ বর্গফুট জায়গাজুড়ে এ বইয়ের জগতে আছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা শাখার বিষয়াবলীর পাশাপাশি খেলাধুলা, রাজনীতি ও সমকালীন বিজ্ঞান, দর্শন আর লোকসংস্কৃতির উপর রচিত লক্ষাধিক বইয়ের সংগ্রহ৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা
২০০৫ সালে চট্টগ্রামে ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করেছিল বাতিঘর৷ ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ভবনে তিন হাজার বর্গফুটের বড় পরিসরে পুরনো জাহাজের আদলে সম্প্রসারিত হয় বাতিঘর৷ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আরো বড় পরিসরে চালু হলো বাতিঘরের দ্বিতীয় শাখা৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
বইয়ের ভাণ্ডার
ঢাকার বাতিঘরে প্রায় শতাধিক বিষয়ের ১০ হাজার লেখক ও এক হাজার দেশি-বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার লক্ষাধিক বইয়ের বিষয়ভিত্তিক বৈচিত্র্যপূর্ণ সংগ্রহ রয়েছে৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
নানান কর্নার
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাতিঘরে আছে বিষয় ভিত্তিক কর্নার৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ভ্রমণ ও প্রবন্ধ কর্নার’, ‘কবিতা কর্নার’, ‘দর্শন কর্নার’,‘শীর্ষেন্দু-সুনীল-সমরেশ কর্নার’, ‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল কর্নার’ ‘ছোটগল্প কর্নার’, ‘ইতিহাস কর্নার’ ‘রহস্যগল্প কর্নার’ ইত্যাদি৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
বেঙ্গল বই
রাজধানীর ধানমণ্ডিতে দেশি-বিদেশি বই বিকিকিনির সাথে পড়ুয়াদের এক নতুন আড্ডাস্থল ‘বেঙ্গল বই’৷ গল্প, উপন্যাস থেকে শুরু করে এখানে মিলবে শিল্পকলা, সাহিত্য, স্থাপত্যবিষয়ক বইও৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
বিশাল আয়োজন
বেঙ্গল বইয়ের তিন তলা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা জুড়ে আছে দেশি-বিদেশি বই৷ নিচতলায় সব শ্রেণির পাঠকের জন্য আছে পুরনো বই ও ম্যাগাজিন৷ দোতলার বারান্দায় বসে কফি খেতে খেতে গল্প করার ব্যবস্থাও আছে৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
নানা আয়োজন
বেঙ্গল বই-এ নিয়মিত পাঠচক্র, কবিতা পাঠের আসর, নতুন লেখা ও লেখকের সঙ্গে পরিচিতিমূলক সভা, প্রকাশনা উৎসব, চিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ নানা আয়োজন থাকে৷ অসুস্থ বা প্রতিবন্ধীরা হুইলচেয়ারে পুরো জায়গা ঘুরে নিজের পছন্দমাফিক বই কিনতে পারবেন৷ প্রবীণদের জন্য রয়েছে বইয়ে বিশেষ ছাড় এবং বাগানে বসে আড্ডা দেওয়ার ব্যবস্থা৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
আকাশকুসুম
বেঙ্গল বই ভবনের তিনতলার প্রায় পুরোটাই শিশুদের জন্য৷ ‘আকাশকুসুম’ নামে সেই রাজ্যে শিশুবান্ধব পরিবেশে বইপড়া ছাড়াও গল্পবলা, আবৃত্তি, ছবি দেখা ও আঁকাআঁকির মধ্য দিয়ে শিশুরা হারিয়ে যেতে পারবে অন্য জগতে৷