নির্বাচনী বছরে সাত লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ৷ অবশ্য এর বড় একটি অংশে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে যোগান দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের৷
বিজ্ঞাপন
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আয়-ব্যায়ের পরিকল্পনা উপস্থাপন করছেন৷ বাজেটের প্রকাশিত দলিল অনুযায়ী, আসছে অর্থবছরে সরকার মোট সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ব্যয় করবে৷ এর মধ্যে রাজস্ব ও বিদেশি অনুদান থেকে পাঁচ লাখ তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা আসবে বলে অনুমাণ করছে সরকার৷ বাকি ৩৩ শতাংশ মেটানো হবে দেশি বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে৷ জিডিপির অনুপাতে ঘাটতির হার দাঁড়াচ্ছে পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ৷
বাড়ছে বহর
চলতি অর্থবছরে সরকার ছয় লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল৷ সেই হিসেবে আসছে বাজেট ১২ ভাগ বড় হচ্ছে৷ কিন্তু অন্য বছরের ধারাবাহিকতায় বিদায়ী অর্থবছরেও ঘোষিত বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না৷ সংশোধন করে তা নামিয়ে আনা হয়েছে ছয় লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটিতে৷ সেই হিসেবে নতুন বাজেটের আকার বাড়ছে ১৫ দশমিক তিন শতাংশ৷
বাজেট থেকে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা
আগামী ১ জুন বাজেট ঘোষণা করা হবে৷ ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বাজেট নিয়ে কী ভাবছেন, তাদের প্রত্যাশা কী, জানতে চেয়েছিল ডয়চে ভেলে৷
ছবি: bdnews24.com
আমরা কি ভালো-মন্দ খামু না?
নির্মাণশ্রমিক হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিতে কাজ করেন মোঃ আজগর মৃধা৷ আসন্ন বাজেট নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, ‘‘বাজেট বাদ দেন, সামনে কুরবানির ঈদের আগে যে গরুর মাংস রান্দার যেসব মেইন জিনিস লাগে, আদা আর পেয়াইজ, এগুলির দাম যে তিন গুন বাইড়া গেল, আমরা কি বছরে একদিনও ভালো-মন্দ খামু না?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাজেটের আগেই জিনিসের দাম বাড়সে
ঢাকার শ্যামলীতে কাঠমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করা মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘প্রত্যেক বছর দেখি বাজেটের সময় হওয়ার আগে দিয়া জিনিসের দাম বাড়ে নাইলে জিনিস পাওয়া যায় না, মার্কেট থেকা হাওয়া হয়া যায়৷ এইবারও ব্যতিক্রম হয় নাই, এক মাসের ব্যবধানে অনেক কিছুর দাম ডাবল হয়া গেসে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আমরা সব সহ্য করে নিচ্ছি
ঢাকার মিরপুরের এই অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘‘আমরা এখন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আছি৷ কারো বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারছি না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারছি না৷ সব ধরণের জুলুম শোষণ আমরা মুখ বুজে সয়ে নিচ্ছি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
এখন আমি লাখ টাকা ঋণী
ঢাকার কমলাপুরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন শিখা রাণী দাস৷ বাজেট নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘করোনার আগে আমার এক টাকাও ঋণ ছিল না, দিন আনছি দিন খাইসি, কিছু টাকা জমাইসি৷ করোনায় সব জমানো টাকা ভাইঙ্গা খাইসি৷ গত দুই বচ্ছরে আমার এখন লাখ টাকা ঋণ৷ সুদে ঋণ নিসি, এইটা কীভাবে শোধ দিমু, আমি জানি না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাজেটের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই
লেখক এবং আলোকচিত্রী শাহরিয়ার খান শিহাব বলেন, ‘‘আমি বাজেট বলতে বুঝি, দেশ থেকে শোষণ বিলুপ্ত হবে, দেশ সিন্ডিকেটমুক্ত হবে৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে৷ অন্যদিকে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ করে দেওয়া যাবে না, যা প্রতিবছরই করা হচ্ছে৷’’ তিনি বলেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি আয়-ব্যয়ের ঘাটতি দূর করতে হবে৷ আর বাজেট শুধু পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ না রেখে এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা জরুরি৷
ছবি: Privat
সংসার চলে না
স্নাতকে পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে বিক্রি হওয়া পণ্য ডেলিভারি করেন সাইফুল ইসলাম৷ বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘সরকার কীভাবে কী বাজেট করে আমরা এতোকিছু বুঝি না৷ আমরা শুধু জানি আমাদের সংসার চলে না, দিনদিন কঠিন থেকে আরো কঠিন হচ্ছে সবকিছু৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাজেটে জিনিসের দাম কমে না
ঢাকার কেরাণীগঞ্জের পোশাকশিল্প কর্মী সালেহা আক্তার বলেন, ‘‘বাজেটে জিনিসপত্রের দাম বাড়ালে নিশ্চিত ধইরা নেন ঐ জিনিসের দাম বাড়বে৷ কিন্তু বাই চান্স যদি কিছুর দাম কমেও, সেইটার দাম আমগো আর কমে না৷ দেশে একবার দাম বাড়লে আর কমে না, এইটাই নিয়ম হয়া গেসে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত
মৌসুমি ফল ব্যবসায়ী মোঃ আকবর মিয়া বলেন, ‘‘আমগো দেশে দাম বাড়তে বাজেট লাগে না, প্রতিমাসেই এখন দাম বাড়তাসে জিনিসের৷ মানুষ যে এখন এক বেলা না খাইয়া আছে, আমাগো প্রধানমন্ত্রী কি এইসব দেখে না? আমার তো মনে হয় সাধারণ মানুষের দুঃখের আসল চিত্র তারে দেখানো উচিত৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আমরা চলতে পারি কিনা সেইটাই আমাদের বাজেট
ঢাকার পীরেরবাগের একটি এটিএম বুথের নিরাপত্তারক্ষী মোঃ আবদুল জলিল জানান, ‘‘বাজেট মানে আমরা বুঝি, আয় কতো আর ব্যয় কতো৷ প্রত্যেকেই আমরা মাসের শুরুতে সংসার বা নিজেগো খরচ চালাইতে একটা বাজেট করি৷ সরকারি বাজেট কী অতো বুঝি না, কিন্তু আমরা ঠিকমতো তিনবেলা খাইতে পরতে পারি কিনা, সেইটাই আমগো কাছে বাজেট৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মানুষের একটাই চাওয়া যেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক এবং অর্থনীতিবিদ ডঃ এমএম আকাশ বলেন, ‘‘বাজেটে সাধারণ মানুষের চাওয়া একটাই, যেন কর এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না হয়৷ তবে ভ্যাট এবং পরোক্ষ ট্যাক্স বেশিরভাগক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের উপরই বসানো হয় এবং দ্রব্যমূল্য বাড়ে৷ তবে এই বছরটা খুব ক্রুশিয়াল হওয়ায় সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে যেন পরোক্ষ কর বৃদ্ধি না পায়৷’’
ছবি: Mahbub Alam
10 ছবি1 | 10
করের বোঝা
বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা৷ যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি৷ তবে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার বড় একটি অংশই আদায় না হওয়ার শঙ্কা থাকছে৷ কেননা চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র দুই লাখ ৬৮ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা৷ সেক্ষেত্রে নতুন অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্চ৷
ঋণ নির্ভরতা
বাজেটে আকার বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঋণের বহরও৷ এর মধ্যে নিট এক লাখ দুই হাজার ৪৯০ কোটি টাকা সরকার ঋণ নিতে চায় বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে৷ যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৮ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা বেশি৷ বাকি এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা নেয়া হবে দেশের ভিতরের বিভিন্ন খাত থেকে৷ এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে৷ গত বছর প্রস্তাবিত বাজেটে এক লাখ ছয় ৩৩৪ কোটি টাকা নেয়ার পরিকল্পনা থাকলেও বছর শেষে তা বাড়িয়ে এক লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা করা হয়েছে৷ অর্থাৎ, আগামী অর্থবছরে এর চেয়েও প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বেশি নিতে চায় সরকার৷ যদিও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এত ঋণ নিলে তা বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে সতর্ক করছেন অর্থনীতিবিদরা৷
প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা
‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’, বাজেট বক্তৃতার এমন শিরোনাম দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী৷ বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে সাত শতাংশ৷ সেই সঙ্গে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে আটকে রাখা যাবে বলেও প্রত্যাশা করা হয়েছে৷ সাময়িক হিসাব অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার সোয়া ছয় শতাংশ আর গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে সাত শতাংশ বলে বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে৷