‘‘আমাদের সমাজ রক্ষণশীল৷ কিন্তু তারপরও ঐ পরিবারকেই বয়ঃসন্ধি সংক্রান্ত শিক্ষা দিতে হবে৷ গল্পের ছলে বাবা-মা সন্তানদের যৌন সচেতনতা সম্পর্কে অবহিত করবেন৷ এই শিক্ষার একটি হলো যৌনশিক্ষা৷ এখানে জড়তা দেখালে বাচ্চাদের ক্ষতি হবে৷’’
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের সঙ্গে একটি একান্ত সাক্ষৎকারে এমন কথা বলেছেন লেখক ও শিক্ষা গবেষক ফারহানা মান্নান৷ ‘বয়ঃসন্ধিকাল ও শিক্ষা' নামে একটি বইও প্রকাশ হয়েছে তাঁর৷ গত ফেব্রুয়ারিতে একুশের বইমেলায় বইটি বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে৷ ডিডাব্লিউ-র সঙ্গে আলাপচারিতার কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো৷
ডিডাব্লিউ: শিশুদের যৌন শিক্ষার প্রধান বাধা কী?
ফারহানা মান্নান: আমাদের রীতি রেওয়াজ৷ এখানে একটা সামাজিক ব্যারিয়ার তৈরি হয়ে আছে৷ কিন্তু এই ব্যারিয়ার দূর করতে হবে৷ কথা শুরু করতে হবে৷ আর এই দায়িত্ব পরিবারকেই নিতে হবে৷ বাবা-মা শিশুদের যৌন শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করবেন৷ খুব আনুষ্ঠানিকভাবে বলবেন, এমনটি নয়৷ বরং গল্পের ছলে, পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে তারা শিশুদের ধারণা দেবেন৷
শিশুরা তো এই বিষয়গুলো বলতে লজ্জা পায়?
হ্যাঁ, কারণ তাদের বয়সটাই এমন৷ ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে শিশুদের শারীরিক পরিবর্তন হয়৷ এই সময়টাতে তাদের মধ্যে এক ধরনের লাজুকতা কাজ করে৷ তাই অভিভাবকদের কাছে বলার চেয়ে বন্ধু-বান্ধবের কাছে শেয়ার করতেই তারা বেশি পছন্দ করে৷ মেয়েরা অবশ্য মায়ের কাছে অনেক কিছুই অকপটে বলে ফেলে৷ কিন্তু ছেলে শিশুরা এগুলো নিয়ে বেশি দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে৷ ফলে বাবাদের দায়িত্ব নিয়ে ছেলের সঙ্গে বন্ধুর মতো হয়ে উঠতে হবে৷
কীভাবে কথাগুলো বলবেন অভিভাবকরা?
কীভাবে বলবেন সেটা বাবা-মা'ই ঠিক করবেন৷ বিষয়টা শিশুদের কাছে প্রথমে তাঁদেরই বলতে হবে৷ শিশুদের বোঝাতে হবে যে, এই সময়টাতে তাদের বাইরে ও ভেতরে দুই ধরনের পরিবর্তন আসবে৷ কেন এই পরিবর্তন আসছে, তাও তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে৷ তিনি যখন ছোট ছিলেন তাঁরও যে এই ধরনের একটা সময় পার করতে হয়েছে, সেগুলো গল্প করেই তাদের বোঝাতে হবে৷ তা না হলে শিশুদের বড়ধরনের ক্ষতি হতে পারে৷ তখন তারা বুঝবেই না তার সঙ্গে কী হচ্ছে৷ আর যেটা হচ্ছে সেটা ঠিক না বেঠিক৷
এ বিষয়ে নিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি পর্যাপ্ত?
না, একেবারেই না৷ বায়োলজিতে এ সব বিষয়ে কিছু কিছু শেখানো হয়৷ কিন্তু বিষয়গুলো পরিষ্কার হয় না৷ যেমন ধরুন, সেক্স, এনাটমি, ইমোশনাল রিলেশনশিপ, জন্মনিয়ন্ত্রণসহ আরো অনেক কিছুই এখানে নেই৷ একটা মেয়ে বয়ঃসন্ধিকাল পার করলেই তাকে সচেতনভাবে চলতে হয়৷ এখানে সে ভুল করলে গর্ভবতী হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে৷ অবাঞ্ছিত এই ‘পেগনেন্সি' তাকে চরম বিপদে ফেলে দিতে পারে৷ তাই এগুলো সম্পর্কে তাকে জানতে হবে৷
আমাদের ধর্ম কি এক্ষেত্রে কোনো বাধা?
না, ধর্মীয়ভাবে আমরা রক্ষণশীল৷ তবে শিশুদের পরিবার থেকে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এই ধরনের শিক্ষা দিলে তো আর কেউ বাধা দিচ্ছে না৷ স্কুলে শিক্ষকরা ছেলে-মেয়েদের আলাদা করে নাটক বা অন্য কোনোভাবে এই শিক্ষা দিতে পারেন৷
শিক্ষা ব্যবস্থায় কি এটা নিয়ে পরিবর্তন আনা দরকার?
না, বইয়ে সব কিছু রাখা সম্ভব নয়৷ তবে পাঠ্যসূচিতে কিছু কিছু বিষয় আনতে হবে৷ এক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের ধর্মীয় বাধা ও সামাজিক বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে৷ আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন আমাদের এক ম্যাডাম সেক্সপিয়ার পড়াচ্ছিলেন৷ সেখানে একটি ‘কিস' বা চুমু খাওয়ার কথা আসতেই ম্যাডাম এমন লাজুক হয়ে গেলেন যে, মনে হলো এটা যেন বিরাট কোনো খারাপ কথা৷ এমন কথা, যেটা আমাদের সামনে বলা যাবে না৷ আসলে সাবলিলভাবে বিষয়টা শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে৷
সরকার কি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে?
সরকার তো অনেক ভূমিকা রাখতে পারে৷ টেলিভিশন বা রেডিও-র মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে পারে৷ নাটক-সিনেমায় বিষয়টা তুলে আনতে পারে৷ আমাদের বর্তমান সরকার কিছু যে করছে না, তা নয়৷ কিন্তু আরো অনেক কিছু করা দরকার৷ আসলে সবচেয়ে বেশি এবং বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্রই৷ ফলে পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে হবে৷
বাংলাদেশে যৌন শিক্ষা
পাঠ্যপুস্তকে যৌন স্বাস্থ্যের বিষয়টি ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করেছে সরকার৷ কিন্তু যৌন শিক্ষা পড়ানো নিয়ে সমস্যা হচ্ছে৷ শিক্ষকরা এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি, ছাত্র-ছাত্রীরাও বিষয়টিকে সহজভাবে নিচ্ছে না৷ কী বলছে আজকের তরুণ সমাজ?
ছবি: DW/K. Andrade
ফারজানা খানম
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী ফারজানা৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হচ্ছে যা থেকে যৌনতা সম্পর্কে জানা যায়৷ এ শিক্ষা প্রত্যেকের জীবনে প্রয়োজন৷ বাচ্চাদের পরিবার এবং শিক্ষকরা এটা শিখাতে পারেন৷ এছাড়া যৌনতা সম্পর্কে তাদের জানার উৎস হতে পারে পরিবার অথবা বন্ধু-বান্ধব৷ তাছাড়া ইন্টারনেট থেকেও যৌনতা সম্পর্কে জানা যায়, জানান ফারজানা৷
ছবি: DW
নাফিসা হক অর্পা
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্রী নাফিসা হক অর্পা৷ নারী-পুরুষের শারীরিক মিলন সম্পর্কে জ্ঞানকেই যৌন শিক্ষা৷ নাফিসার কথায়, ‘‘আমাদের সময়ে ইন্টারনেট এত সহজলভ্য ছিল না৷ তখন বন্ধু, সহপাঠী, আত্মীয়স্বজনরাই ছিলেন মূল ভরসা৷’’ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষাটাকে ট্যাবু হিসেবে না দেখে একে শিক্ষার অংশ করা উচিত৷ এতে করে যৌন বিষয়ক অপরাধ কমবে৷
ছবি: DW
জান্নাতুল ফেরদৌস কনক
নাফিসার মতোই মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করছেন জান্নাতুল ফেরদৌস কনক, তবে তিনি পড়ছেন পঞ্চম সেমিস্টারে৷ তাঁর মতে, যৌনতা হচ্ছে বয়সের পরিবর্তনে শারীরিক এক ধরণের চাহিদা৷ আগে এ নিয়ে সীমাবধ্যতা থাকলেও, এখন ছেলে-ছেলে কিংবা মেয়ে-মেয়ের যৌন সম্পর্কও বেশ জনপ্রিয়৷ ‘‘বন্ধুদের আড্ডায় এটাই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়’’, জানান কনক৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার দরকার না থাকলেও এ বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরি৷
ছবি: DW
ইমরান খান
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ইমরান খান৷ তিনি যৌন শিক্ষা বলতে যৌনতা সম্পর্কে সব ধরণের ধারণাকে বোঝেন৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা সবার জন্য একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়৷ আর এ কথাটা শিশুদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য৷ তবে ইমরানের কথায়, ‘‘সঠিক যৌন শিক্ষা স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, পরিবার থেকেই গড়ে উঠতে পারে৷’’
ছবি: DW
কেডিএস সাকিব
বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাফিসা আর কনকের মতো মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ছেন সাকিব, পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হলো যৌন মিলনের উপর জ্ঞান৷ তবে শিক্ষকদের কাছ থেকে নয়, বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই বন্ধুদের কাছ থেকে এ বিষয়ে জেনেছেন তিনি৷ সাকিবের মতে, পর্যাপ্ত যৌন শিক্ষা অবশ্যই দরকার৷ যৌনতা সম্পর্কে তাঁর জানার মূল উৎস বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ এবং এ সম্বন্ধে লিখা বিভিন্ন বই৷
ছবি: DW
মাহবুব টিপু
নাফিসা, কনক, সাকিব আর ফারজানার মতোই মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করছেন মাহবুব টিপু৷ অবশ্য তিনি এখনও দ্বিতীয় সেমিস্টারে৷ যৌন শিক্ষা তাঁর কাছে যৌনতা সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষাটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসে৷ এ বিষয়ে জানার সবচেয়ে বড় জায়গা বন্ধু-বান্ধব৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো সবারই কম-বেশি জানা থাকে৷ তারপরও এ বিষয়ে শেখার সবচেয়ে বড় মাধ্যম বিভিন্ন ওয়েবসাইট৷
ছবি: DW
সামিয়া রহমান
সামিয়া রহমানও মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী৷ যৌন শিক্ষা বলতে তিনি বোঝেন নারী ও পুরুষের শারীরিক সম্পর্ক বিষয়ে জ্ঞান৷ তাঁর কথায়, ‘‘যৌন শিক্ষা আমাদের দেশে নিষিদ্ধ একটি বিষয়ের মতো৷ তাই এ বিষয়ে আমি শিক্ষা পায়নি৷’’ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা খুবই জরুরি৷ এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকায় অনেকেই ভুল পথে চলে যায়৷ তাই বাবা-মায়েরও এ বিষয়ে সন্তানদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা উচিত৷
ছবি: DW
নাফিউল হক শাফিন
টিপু আর সামিয়ার মতো অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মাস কমিউনিকেশন বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী নাফিউল৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা জীবনের জৈবিক চাহিদা সম্পর্কে জানা এবং যৌনতার সঠিক প্রয়োগ ও সতর্কতাকে বোঝায়৷ তিনি শিক্ষকদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছু শেখেননি৷ তবে এই শিক্ষাটা খুবই জরুরি বলে মনে করেন তিনি৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার জন্য বড় কেউ কিংবা সহপাঠীরাই বড় মাধ্যম৷
ছবি: DW
মালিহা রহমান
মালিহা রহমানও ঐ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হলো শারীরিক সম্পর্কের হাতে কলমে শিক্ষা৷ অবশ্য তাঁর কথায়, যৌন শিক্ষা একটা স্বাভাবিক বিষয় যেটা মানুষ থেকে শুরু করে সব প্রাণীই প্রাকৃতিকভাবে জানে৷ তাঁর মতে, এ বিষয়ে আগে থেকে জানার কিছু নেই, নেই ভালো কোনো দিক৷ যখন এ বিষয়ে জানার প্রয়োজন হবে তখন এমনিতেই তা জানা যাবে৷
ছবি: DW
9 ছবি1 | 9
আপনি কি ফারহানা মান্নানের সঙ্গে একমত? জানিয়ে দিন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷